সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: কবি নজরুলের প্রেম কাহিনী

কবি নজরুলের প্রেম কাহিনী


সবার কাছে কাজী নজরুল ইসলামের প্রধান পরিচয় বিদ্রোহী কবি হিসেবে। কিন্তু প্রেমের কবিতায় তাঁর তুলনা নেই। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি প্রেমে পড়েছিলেন বারবার। কবি যাঁদের প্রেমে পড়েছিলেন, তাঁদের নিয়ে লিখেছেন গান, কবিতা আর প্রেমপত্র। আজকে শুনবো সেই রকম কিছু কাহিনী। 


নার্গিসঃ
প্রথমেই আসে নার্গিসের কথা। ১৯২১ সালের মার্চ কি এপ্রিল মাস। কবি নজরুল তাঁর বন্ধু আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে। সেখানে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। নজরুল ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সবাইকে গান শুনিয়েছিলেন। নজরুলের গানের সুর মাতিয়ে দিল সৈয়দা খাতুনকে আর সৈয়দা খাতুনের রূপ মুগ্ধ করে ফেলল নজরুলকে। কবি প্রেমে পড়ে গেলেন প্রথম দর্শনেই। সৈয়দা খাতুনও সমান আগ্রহে কবির প্রেমে সাড়া দিয়েছিলেন। তারপর তাঁদের সময় কাটতে লাগল গান আর সুর নিয়ে। সৈয়দা খাতুনকে ভালোবেসে কবি তাঁর নামও বদলে দিলেন। তিনি তাঁর নাম দিলেন নার্গিস। 
নার্গিস
নার্গিস ইরানি এক সাদা গুল্মপুষ্পের নাম। কত দিন নজরুল নার্গিসের সঙ্গে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন? বেশি দিন কিন্তু একেবারেই নয়। কবির অস্থির মন। দৌলতপুরে থাকা অবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নার্গিসকেই তিনি বিয়ে করবেন। বিয়েও হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। কিন্তু ইতিহাস রচনা করল এক দুঃখের নাটক। বিয়ে হলো ঠিকই, বাসর আর হলো না। কোনো এক অজানা অভিমানে বাসর রাতেই নজরুল বাড়ি ছেড়ে যান। দৌলতপুর থেকে চলে আসেন কুমিল্লায়। কিন্তু কবির সেই অভিমানের কারণ কবি কোনো দিন কাউকে মুখ ফুটে বলেননি। ইতিহাসও তা স্পষ্টভাবে খুঁজে বের করতে পারেনি।

ফজিলাতুন্নেসাঃ
এর পর পর যদি কারও নাম আসে, সেটি মিস ফজিলাতুন্নেসার। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী। ইতিহাস বলে, এই প্রেম ছিল একতরফা, মানে শুধু কাজী নজরুল ইসলামের দিক থেকেই। ফজিলাতুন্নেসা নজরুলের আকুতিতে সাড়া তেমন একটা দেননি। কিন্তু তাতে কী? কবির মন তো প্রেমের জলে কানায় কানায় পূর্ণ। তাই তিনি বেশ কিছু চিঠি পাঠিয়েছিলেন মিস ফজিলাতুন্নেসাকে। নজরুল আসলে সেসব চিঠি দিতেন তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনকে। ফজিলাতুন্নেসা মোতাহার হোসেনকে শ্রদ্ধা করতেন বড় ভাইয়ের মতো। কাজী মোতাহার বন্ধুর হয়ে ফজিলাতুন্নেসাকে পৌঁছে দিতেন কবির প্রেমময় চিঠিগুলো। সরাসরি কেন চিঠি পাঠাতেন না, তার কারণও উল্লেখ করেছেন কবি, ঐ এক চিঠি পেয়েই যত দূর বুঝেছিআমায় তিনি দ্বিতীয় চিঠি দিয়ে দয়া করবেন না। 
ফজিলাতুন্নেসা
ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির পরিচয় হয় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কবি তখন মুসলিম সাহিত্যসমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন ঢাকায়। কবি একটু-আধটু জ্যোতিষবিদ্যা জানতেন। কাজী মোতাহার হোসেন সে কারণে কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেসার বাসায়। ব্যস! শুরু হয়ে গেল হাত দেখা। প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ। কবির মন প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কবি চলে গেলেন ঢাকা ছেড়ে। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তাঁর মন জুড়ে। তার পর থেকে নজরুল লিখে চললেন একটার পর একটা প্রেমপত্র। 

রানু সোমঃ
নজরুলকে ঘিরে আরও কিছু নারীর নাম এসেছে। তাঁদের একজন রানু সোম। পরে তিনি বুদ্ধদেব বসুকে বিয়ে করেন এবং প্রতিভা বসু নামে খ্যাত হন। সংগীতজ্ঞ দীলিপকুমার রায় রানুকে নজরুলের গান শেখাতেন। তাঁর কাছেই নজরুল রানুর কথা শোনেন। উৎসাহী নজরুল নিজেই ঠিকানা খুঁজে ঢাকায় রানুদের বাড়িতে হাজির হন। শুরু হয় রানুকে গান শেখানো। এই গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক পাড়ার যুবকদের সহ্য হয়নি। 
রানু সোম
রানু সোম (বাঁমে)
একদিন রানুদের বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তারা নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুলও পাল্টা আক্রমণ করেন। ব্যাপারটা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায়। শিল্পী কানন দেবীকেও নজরুল গান শিখিয়েছিলেন। কলকাতার পত্রিকা শনিবারের চিঠি এ নিয়ে নানা রসাল কাহিনি ছাপতে থাকে। রটানো হয়েছিল যে কবিকে কোথাও না পেলে কানন দেবীর বাড়িতেই পাওয়া যাবে। গান শেখাতে গিয়ে রাত হয়ে গেলে কানন দেবীর বাড়িতে কবির থেকে যাওয়ার ঘটনাকে নিন্দুকেরা গুজব ছড়ানোর জন্য বেছে নেন।

কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তাঃ
তবে শেষ পর্যন্ত নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা। প্রমীলার ডাকনাম ছিল দুলি। তাঁদের এই বিয়ে প্রেম থেকে নয়, বরং পারিবারিক সম্মতিতে স্থির হয়। তবে জানা যায়, নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালে প্রমীলার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। প্রমীলার সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় ছিল। তাঁর এই প্রেমের কথা তাঁর বিজয়িনী কবিতায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম। বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩।
প্রমীলা সেনগুপ্তা
প্রমীলা সেনগুপ্তা

প্রেম নাকি কবিমানসের প্রধান প্রেরণা। প্রেমিক কবি নজরুলের মন তো প্রেমময় হবেই। আর তাই প্রেম নজরুলের জীবনে এসেছিল বারবারকখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে।


সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৪ মে ২০১৩

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।