সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: ফুলে আরার হাসপাতাল

ফুলে আরার হাসপাতাল

                                                         
সুজনের ভীষণ ঠান্ডা লেগেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আশপাশের কবিরাজ দেখিয়ে কোনো লাভ হলো না। সুজনের অবস্থা আরও খারাপ হলো। ওকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার চেষ্টা চলল। এরই মধ্যে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। ঘাটে এসে আর নৌকা পাওয়া যায় না। অগত্যা আবার বাড়ির দিকে রওনা। সুজনকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে নিতেই সুজনের হূৎস্পন্দন থেমে যায়। সেবার কোলেপিঠে করে বড় করা ছোট ভাই সুজনকে হারিয়েছিলেন কিশোরী ফুলেআরা। বিনা চিকিৎসায় এভাবেই কি চরের মানুষকে মরে যেতে হবে? ভাবতে থাকেন ফুলেআরা।
চরের চারদিকেই যমুনা নদী। গ্রাম থেকে হাট-বাজারে বা উপজেলা সদরে যাওয়ার একমাত্র বাহন নৌকা। যেতে সময় লাগে দেড়-দুই ঘণ্টা। সন্ধ্যা থেকে নৌকা চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়। নাটুয়ারপাড়া চরের এমনই একটি গ্রাম জোড়গাছা। এই গ্রামেরই কিশোরী ফুলেআরা। ১১ বছর বয়সী এই কিশোরীর ছোট ভাই সুজন। মাত্র তিন বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে চলে যায় না ফেরার দেশে। ঘটনাটি ১৯৮২ সালের।

ভাঙা-গড়ার খেলা
এখানে ঘুম ভাঙে পানির শব্দে। জেগে উঠে চোখ মেললেই ধু ধু প্রান্তর আর পানির জোয়ার-ভাটা চোখে এসে লাগে। সারা দিন কেটে যায় পানির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই। বেঁচে থাকতে হয় নিয়মিত বাড়িঘর হারানোর শঙ্কা নিয়ে। নদীর ভাঙা-গড়ার খেলা এখানে রোজকার চেনা ঘটনা। যমুনা এক গ্রাম ভাঙে তো আরেক গ্রাম জাগিয়ে তোলে। তাই স্থায়ী বাড়িঘর করতে ভয় পায় মানুষ। যাদের কাছে যমুনা রাক্ষুসী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তাদের তো ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তবুও জীবন বহিয়া চলে। ঝুঁকি নিয়েই সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া চরে বসবাস করে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। চরের ফসল আর যমুনার মাছ অভাবী এই মানুষগুলোর বেঁচে থাকার উৎস। এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা নেই বললেই চলে। নেই ভালো যোগাযোগব্যবস্থাও। সরকারিভাবে চালু করা হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। সেটি খোলা থাকে দিনের বেলায়। রাতে কেউ অসুস্থ হলে বা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করতে হয় সকাল পর্যন্ত। উপজেলা সদরে যাওয়ার নৌকা তো মিলবে দিনের আলোয়। বেশি অসুস্থ হলে রাতের অন্ধকারের মতোই অনেকের জীবনেও নেমে আসে অন্ধকার। সুজনের মতো বিনা চিকিৎসায় শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা এখানে নতুন নয়। আর সেই সব শিশুর রোগের তালিকার শুরুতেই আছে নিউমোনিয়ার নাম।
দশে মিলে করি কাজ
ছোট ভাইকে হারানোর এক বছর পরই বিয়ে হয় ফুলেআরার। স্বামী ইমাম হোসেন তখন ছাত্র। এইচএসসি পাস করে সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে ডিএমএফ (ডিপ্লোমা অব মেডিকেল ফ্যাকাল্টি) বিষয়ে কোর্স করেছেন। তিন বছরের কোর্স শেষ করে দুই বছর বেকার জীবন পার করেন। পড়াশোনা থেকে শুরু করে সব খরচই বহন করেন ফুলেআরার বাবা। ইমাম হোসেনের বেকার জীবন শেষ হয় ১৯৮৬ সালে। ওই বছরই যোগ দেন উপসহকারী মেডিকেল অফিসার হিসেবে। স্বামীর চিকিৎসক হিসেবে চাকরি পাওয়ার পরই ফুলেআরার স্বপ্ন দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৯০ সালের দিকের কথা। নিজের স্বপ্নের কথাটা খুলে বলেন স্বামী ইমাম হোসেনকে। এই খানে, এই চরে শিশু ও নারীদের চিকিৎসার জন্য স্থায়ীভাবে কিছু করা যায় না? ফুলেআরার কথা শুনে ইমাম হোসেন খুশি হলেও নিজের আর্থিক অনটনের কথা ভাবলেন। নিজের পড়াশোনাই তো চালাতে হয়েছে শ্বশুরের টাকায়। উপায় বের করেন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা ফুলেআরাই। সংসারে একজন কাজের লোক রাখলে তো তাকে খাবার, পোশাক এমনকি বেতনও দিতে হতো। তার জন্য একটা খরচ হতো। সেই খরচ বাঁচাবেন ফুলেআরা। সংসারে আর কোনো কাজের লোক রাখবেন না বলে জানিয়ে দেন স্বামীকে। একই সঙ্গে বিসর্জন দেন নিজের শখ-আহ্লাদ। দামি শাড়ি, অলংকার, এমনকি দামি খাবারের কথাও মুখে আনেন না তিনি। গৃহকর্মীর বেতন বাবদ স্বামীর কাছ থেকে মাসিক ৫০০ টাকা করে জমানো শুরু করেন। এরই মধ্যে ফুলেআরার বাবার গ্রাম জোড়গাছা বিলীন হয়ে যায় যমুনার করাল গ্রাসে। সবাই এসে ঠাঁই নেয় রেহাইশুড়ীবেড় গ্রামে। চলতে থাকে চরের জীবন, বড় হতে থাকে ফুলেআরার স্বপ্ন। মাস শেষে জমানো ৫০০ টাকার বাক্সটাও ভারী হতে থাকে। ২০০৫ সালে ফুলেআরা সঞ্চয়ের এক লাখ টাকা তুলে দেন স্বামী ইমাম হোসেনের হাতে। স্বামী টাকা পেয়ে স্ত্রীর স্বপ্নপূরণে নামেন। চরের বুকে জন্ম নেয় নতুন এক আশার আলো। বাজারের ঠিক কাছেই সবার জন্য চালু করেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকেন্দ্র। খুলে যায় গরিবের জন্য ফার্মেসি। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন একজন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকও। প্রায় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা চলতে থাকে এখানে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ইমাম হোসেন সরকারি চিকিৎসক হয়ে কেন হোমিওপ্যাথি ফার্মেসি খুললেন? খানিকটা পেছনে ফিরে গিয়ে উত্তর দেন ফুলেআরা, চরের মানুষের মধ্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ওপর আস্থা বেশি। তাই হোমিওপ্যাথি দিয়েই যাত্রা শুরু করি। হোমিও চিকিৎসা দিয়ে আপাতত সেবা দিতে থাকে ফুলেআরার চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। কিন্তু আবারও বাদ সাধে ওই যমুনাই। ২০০৭ সালে স্থায়ীভাবে করা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাকেন্দ্রটি চলে যায় যমুনার পেটে। আবারও স্বপ্নভঙ্গ হয় ফুলেআরার। নিজেদের বেশ কিছু জমিজমা নদীগর্ভে চলে যায়। আবারও চর জাগে। ঘর ওঠে। জীবন শুরু হয়। কিন্তু মানুষের জন্য কি কিছু করা সম্ভব হবে আর? যে মেয়েটি সেই কিশোর বয়সে স্বপ্ন দেখেছে মানুষের জন্য কিছু একটা করার, তাঁর স্বপ্নকে কী করে দমিয়ে রাখা যায়! এবার ফুলেআরা নিজের জমানো আরও কিছু টাকা স্বামীর হাতে দিয়ে আবারও হাসপাতাল তৈরির কথা বলেন। কিন্তু ফুলেআরার অর্থে তো বড় কিছু করা সম্ভব নয়। বাধ্য হয়ে ইমাম হোসেন হাত পাতেন সমাজের বিত্তবান লোকদের কাছে। কেউ কেউ ফুলেআরার স্বপ্ন এবং ইমাম হোসেনের চাওয়াকে পাগলের প্রলাপ বলে আখ্যা দেন ওই সময়। বিভিন্নভাবে হেয় করা হয় তাঁকে। হাল ছেড়ে দেন ইমাম হোসেন। শেষতক চরের সাধারণ মানুষ, যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যাদের অভাব আর সমস্যা নিত্যসঙ্গী, তারাই পাশে এসে দাঁড়ায়। একটি টিন, এক টুকরো কাঠ, এক কেজি পেরেক, যার কিছু নেই তার একবেলার শ্রম নিয়ে পাশে দাঁড়ায় ইমাম হোসেন ও ফুলেআরার। সব মিলিয়ে ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো যাত্রা শুরু করে আমিনা-দৌলতজামান মানবসেবা হাসপাতাল।

যমুনার চরে
কাজিপুর থেকে নাটুয়ারপাড়া চরে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ইঞ্জিনচালিত নৌকা। তা-ও নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর ছাড়ে। নৌকা থেকে নামলেই চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ চর। সাদা চিকচিকে বালি। আর একটু এগোলেই নাটুয়ারপাড়া বাজার। বাজারে এসে দাঁড়ালেই হাসপাতালে যাওয়ার বাহন হিসেবে পাওয়া যায় দুই চাকার ঘোড়ার গাড়ি অথবা মোটরসাইকেল। তাদের কাছে শুধু বলতে হয় মানবসেবা হাসপাতালে যাব। চরের দুর্গম বালিময় রাস্তা পার হওয়ার সময় শক্ত হাতে বাহনটি ধরতে ধরতেই পৌঁছে যাওয়া যায় মানবসেবা হাসপাতালে। রাস্তার সামনে বিশাল সাইনবোর্ড আর গাছপালা। সেটি পেরিয়ে হাসপাতালের সামনে আসতেই নজরে পড়ে অপেক্ষাগার, হাসপাতাল ও মহিলা মাদ্রাসা। দোতলা বাড়িটির সঙ্গেই ফুলেআরা দম্পতির বাড়ি। গ্রামের আর দশজন গৃহবধূর মতোই লাজুক মুখে কথা বলেন তিনি। বাড়িতে পা দিয়েই বোঝা গেল আভিজাত্যের চিহ্নমাত্র নেই। ঘরে ঢুকে এ ব্যাপারে আরও বেশি নিশ্চিত হওয়া গেল। ফুলেআরার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই পাশে এসে বসলেন ছোট বোন রেনুকা ও ইমাম হোসেন। ফুলেআরা বলে গেলেন তাঁর শুরুর কথা। স্বপ্নের কথা। বলেন, চিকিৎসা নিয়ে হাসিমুখে যখন কেউ বিদায় নেয়, তখন আমি তাদের মধ্যে আমার ছোট ভাই সুজনকে খুঁজে পাই। বলতে বলতে ফুলেআরা ওড়নায় চোখ মোছেন। ছোট বোন রেনুকা পিঠে হাত রাখেন তাঁর। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ফুলেআরা বলেন, নিজের শখ-আহ্লাদ আগেই বিসর্জন দিছি। পুরো সংসারের কাজ একা করছি। কখনো কোনো কাজের মানুষের চিন্তা করিনি। এত দিনে মনে হয় মানুষের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি।
হাসপাতালের সামনে একটি নামফলক ও সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ডের সহযোগিতার পাশে লেখা রয়েছে সর্বশ্রেণীর জনগণ। সেই সর্বশ্রেণীর জনগণের সহযোগিতায় কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি বাড়িটিই হাসপাতালের ভবন, যার মূল অংশ নিচতলায় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি সোলার প্যানেল। এসব যন্ত্রপাতির পাশেই রয়েছে ফার্মেসি। ২৪ ঘণ্টা খোলা এ মানবসেবা হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র সবার জন্য ফ্রি।
কিন্তু ফার্মেসি থেকে সচ্ছল ব্যক্তিরা চাইলে কিনে নিতে পারেন ওষুধ। আর দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য ওষুধও ফ্রি। ওষুধ বিক্রির লাভের একটি অংশ চলে যায় হাসপাতালের উন্নয়ন তহবিলে। হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক ফুলেআরার স্বামী ইমাম হোসেন বলেন, চারদিকে যখন অন্ধকার নেমে আসে, রাতের আঁধারে যখন কোথাও যাওয়ার উপায় থাকে না, নদী পাড়ি দেওয়ার কোনো উপায় থাকে না; তখন কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার সেবা করার জন্যই আমরা জেগে থাকি। মানবসেবাকেন্দ্রের সঙ্গেই আমার বাড়ি। তাই যেকোনো সময় এসে ডাকলেই চিকিৎসাসেবা পায় যে কেউ। স্থান ও সামর্থ্যের অভাবে আমরা হাসপাতালে একসঙ্গে দু-চারজনের বেশি রোগী ভর্তি রাখতে পারি না। কিন্তু আমরা চেষ্টা করি যথাসাধ্য সেবা দেওয়ার।
কাঠ ও টিনের দোতলা সেই বাড়িতে চারটি ঘর, যার নিচতলায় চিকিৎসাকেন্দ্র। দোতলায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য খোলা হয়েছে ফ্রি কোচিং সেন্টার। এখানেই শেষ নয়, ফুলেআরা ইমাম দম্পতি স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফলদ বৃক্ষ রোপণের একটি কাজও হাতে নিয়েছেন। এরই মধ্যে প্রায় তিন শতাধিক বৃক্ষ রোপণের কাজ শেষ হয়েছে।
ইমাম হোসেন বলেন, হাসপাতালটি চালাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন। মানুষের কাছ থেকে পাচ্ছি, কিন্তু তা দিয়ে ব্যয় নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে একটি জেনারেটর ও অ্যাম্বুলেন্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য একটি ইজি বাইক বা এই জাতীয় গাড়ি দরকার। কিন্তু কত দিনে সম্ভব হবে, বুঝতে পারছি না।

সেবা নেন যারা
রেহাইশুড়ীবেড় গ্রামের আমিনা-দৌলতজামান মানবসেবা হাসপাতালের বারান্দায় বসে কথা হয় শিউলি খাতুনের সঙ্গে। তিনি এসেছেন পানাগাড়ি গ্রাম থেকে। বলেন, নাতি সাব্বির বেশ কয়েক দিন ধরেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। কয়েক দিন ধরে এখানে এসে নিয়মিতভাবে নিউমোনিয়ার চিকিৎসা নিয়ে যান। সাব্বিরের মা ঢাকায় পোশাকশিল্প কারখানায় কাজ করেন। তাই নানির দায়িত্ব নাতিকে দেখভাল করার। রেনুকা খাতুন জানান, বর্ষা ও শীতকালে এখানে সাধারণত নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেশি হয়। আর এ রোগে আক্রান্ত হয় শিশুরাই। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, হাঁপানি, কাটা-ফাটা, বিষ খাওয়াসহ নানা ধরনের রোগী আসে মানবসেবাকেন্দ্রে। নাটুয়ারপাড়াসহ আশপাশের আরও ১৫ চরের প্রায় দুই লাখ মানুষের কাছে আশার আলো এই আমিনা-দৌলতজামান মানবসেবা হাসপাতাল।

সূত্রঃ প্রথম আলো

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।