সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: Abraham Lincoln - মুচির ছেলে যখন প্রেসিডেন্ট

Abraham Lincoln - মুচির ছেলে যখন প্রেসিডেন্ট


পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের উত্থানটা বিস্ময়কর। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অনেকে ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেছেন,নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসের অস্তাকুঁড়ে। আবার সেই ভাগ্যের অসাধারণ ম্যাজিকে অনেকে অর্জন করেছেন অসামান্য খ্যাতি। সময়কে পরাজিত করে হয়ে উঠেছেন সর্বকালের সেরা কিংবা আলোচিত একজন। এদের মধ্যে অনেকে আবার একেবারে শূন্য থেকে জীবন শুরু করে পৌঁছেছেন পূর্ণতার শীর্ষে। এদেরই একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। মার্কিন ইতিহাস তো বটেই, সমগ্র বিশ্বেই সর্বকালের সেরা শাসক কিংবা রাজনীতিবিদের তালিকায় অনায়াসে চলে আসে তার নাম। আব্রাহাম লিঙ্কনের ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষতার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও দারুণ শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। লিঙ্কনের শৈশব ছিল নিদারুণ কষ্টে ভরপুর। দরিদ্রতার কশাঘাতে জর্জরিত ছিল তার পরিবার। বাবা মুচি ছিলেন। জুতা সেলাইয়ের কাজ করে সংসার ঠিকমতো চালাতে পারতেন না। মাঝে মাঝে লিঙ্কন নিজেও বাবার কাজে সহযোগিতা করতেন। এ পরিবেশেই আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তখনো কেউ ভাবতে পারেনি এই ছেলে একদিন ইতিহাস হবেন। ইতিহাস লিখবেন। বিস্ময়কর সেই উত্থানের গল্প নিয়েই রকমারির এ আয়োজন।

জন্ম ও বেড়ে ওঠা
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি রাজ্যের একটি ছোট গ্রামে কিংবদন্তি আব্রাহাম লিঙ্কনের জন্ম। তার বাবা টমাস লিঙ্কন যে মুচি ছিলেন তা আগেই বলা হয়েছে। তিনি লেখাপড়া কিছুই জানতেন না। অতি কষ্টে দীন-দরিদ্রের মতো তিনি সংসার চালাতেন। লিঙ্কনের বয়স যখন চার,তখন পাল্টে যায় তার আবাসস্থল। টমাস লিঙ্কন তখন পরিবার নিয়ে ইন্ডিয়ানা রাজ্যের অরণ্যময় অঞ্চলে পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করলেন। বলা বাহুল্য,সে জায়গাটি তখনো মানুষের বসবাসের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বাড়ির চারদিকে জন্তু-জানোয়ারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বড় বড় খুঁটি পোঁতা থাকত। তখন লিঙ্কনের বাবার পেশাও পাল্টে যায়। কাঠের কাজ আর শিকার করেই নতুন করে সংসারের হাল ধরেন তিনি। এ কঠিন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে বসবাস করতে করতে লিঙ্কন হয়ে ওঠেন পরিশ্রমী,সাহসী। 

লিঙ্কনের বয়স যখন ছয়, তখন হঠাৎ করেই তার মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তখন সেখানে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। এক গ্রাম্য ডাক্তার থাকতেন ৩৫ মাইল দূরে। প্রায় বিনা চিকিৎসায়ই সাত দিন পর মারা গেলেন লিঙ্কনের মা। মা মারা যাওয়ার এক ছর পরের ঘটনা। লিঙ্কনের বাবার পূর্বপরিচিত এক মহিলার কিছু দিন আগে স্বামী মারা গিয়েছিলেন। সংসারে একজন মহিলার প্রয়োজন বিবেচনা করে তাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন টমাস। আব্রাহাম লিঙ্কনের সৎমা অবশ্য তাকে আদর করতেন। মূলত সৎমায়ের আগ্রহে লিঙ্কন শিখেছিলেন লিখতে,পড়তে,অঙ্ক করতে। পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন,'আমার স্কুলজীবন সাকল্যে এক বছরের বেশি নয়।ধীরে ধীরে কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে পা দিলেন লিঙ্কন। দীর্ঘ দেহ,উচ্চতায় ছয় ফুট চার ইঞ্চি। লম্বা হাত, বলিষ্ঠ দেহ। দেহ অনুপাতে মাথাটি ছোট,যখন হাঁটতেন শরীরটা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ত। তার বয়স যখন উনিশ,তখন নিউ অর্লিয়েন্স বন্দরে কিছু পণ্য নিয়ে যাওয়ার ভার পড়ল তার ওপর। পণ্যবোঝাই একটি বড় নৌকা নিয়ে রওয়ানা হলেন লিঙ্কন।

সেখানে এসেই লিঙ্কন প্রথম দেখলেন নিগ্রো শিশু-নারী-পুরুষদের দাস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে। দাসপ্রথার ব্যাপকতা দেখে তিনি এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন যে তার এক সঙ্গীকে বলেই ফেললেন,'যদি আমি কোনো দিন সুযোগ পাই এই জঘন্য প্রথার বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানব।'নিউ অর্লিয়েন্সে ভালোই ব্যবসা করলেন লিঙ্কন। তার কাজে খুশি হয়ে পণ্যের মালিক তাকে নিউ সালেমের গুদামের ম্যানেজার করে দিলেন। এখানে কাজের তেমন চাপ ছিল না। অবসরটুকু তিনি নানা বিষয়ের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন।

জুতা সেলাই প্রসঙ্গ
আব্রাহাম লিঙ্কন যুক্তরাষ্ট্র তথা আধুনিক দুনিয়ার ইতিহাসের এক কিংবদন্তি। তিনি দেশটির ১৬তম প্রেসিডেন্ট। জন্মগ্রহণ করেন ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৮৬৫ সালের ১৫ এপ্রিল। অত্যন্ত গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় প্রচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিপতি হতে পেরেছিলেন। তার শৈশব ও কৈশোর ছিল দরিদ্রতা আর সংগ্রামে ভরপুর। এর পরও তিনি তার ভাগ্যকে পাল্টে ফেলতে পেরেছিলেন।

লিঙ্কনের বাবা মূলত জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন। এ পেশার আয় দিয়েই সংসার চালাতেন। জুতা তৈরিতে তার খ্যাতি ছিল। কিন্তু সামান্য আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হতো। কখনো কখনো লিঙ্কন নিজেও বাবার কাজে হাত লাগাতেন। বাবার কাছ থেকে জুতা সেলাইয়ের কাজ ভালোভাবেই রপ্ত করেছিলেন। ছোটবেলায় লিঙ্কনকে সবাই মুচির ছেলে বলে খেপাত। সবাই তাকে নিচু দৃষ্টিতে দেখত। বাবা আর দরিদ্রতাকে নিয়ে সবাই উপহাস করত। বন্ধুদের মধ্যে কেউই লিঙ্কনের সঙ্গে খুব একটা মিশতে চাইত না। তবে লিঙ্কন ছিলেন অদম্য। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড মানসিক দৃঢ়তা ছিল তার। কোনোমতেই দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। নিজের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে জীবনে এগিয়ে চলেন। এরপর আস্তে আস্তে উত্থান শুরু হয় নতুন এক লিঙ্কনের। পরের গল্পটা সাফল্যে মোড়া।

কিন্তু মুচির ছেলে ছিলেন বলে তাকে সব সময়ই অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। তখন তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে মাত্র পরিচিতি লাভ করছেন। একবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা দিতে শুরু করলে এক ধনী ব্যক্তি তাকে থামিয়ে দেন। লোকটি তাকে বলেন,'লিঙ্কন! আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন আপনি একজন মুচির ছেলে। আপনার বাবা লোকের জুতা সেলাই করে। এমনকি তিনি আমাদের পরিবারের জন্য জুতা তৈরি করে দেন।'এ নিয়ে তখন হাস্যরসের সূচনা হয়। কিন্তু লিঙ্কন লজ্জা পেলেন না। বরং দৃঢ়ভাবে এর জবাব দেন। তিনি উত্তর দেন,'হ্যাঁ,আমার বাবা জুতা তৈরি করেন। তিনি খুবই দক্ষ একজন মুচি। কেউ কখনো আমার বাবার তৈরি জুতা নিয়ে অভিযোগ করেননি। আপনিও মনে হয় আমার বাবার তৈরি জুতা নিয়ে কোনো অভিযোগ রাখছেন না। যদি তার জুতা নিয়ে কোনো অভিযোগ না থাকে তাহলে মানতেই হবে তিনি সেরা। আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ববোধ করি এবং আমি নিজেও জুতা সেলাই করি।লিঙ্কনের এ উত্তরে সবার হাস্যরস বন্ধ হয়ে যায়। উল্টো সবাই মুগ্ধ হয়। এভাবেই জীবনের পরতে পরতে ছড়িয়ে থাকা বাধাগুলো ডিঙিয়ে সাফল্যের শীর্ষে উঠে আসেন লিঙ্কন।


রাজনীতির অন্দরে
গুদামের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে পরিচয় ঘটে লিঙ্কনের। একটি প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তিনি নির্বাচন কেন্দ্রে কাজকর্ম দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। এরপর নিজের অজান্তেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। মধুর ব্যক্তিত্ব,সহযোগিতামূলক আচরণ,স্পষ্টবাদিতার কারণে অল্প দিনেই তিনি নিউসালেমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এ সময় তিনি পরিচিত হলেন স্থানীয় একটি সরাইখানার মালিক জেমস রুটলেজর সঙ্গে। তিনি লিঙ্কনকে স্থানীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন। এর মধ্যেই ইলিনয় রাজ্যের নির্বাচন শুরু হলো। কয়েকজনের উৎসাহে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন লিঙ্কন। কিন্তু রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার কারণে নির্বাচনে পরাজিত হলেন। বেকার হয়ে পড়লেন। এরপর বাধ্য হয়ে নিউসালেমে পিয়নের চাকরি নিলেন। ১৮৩৪ সালে আবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। এবার তিনি জয়লাভ করলেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তাকে যেতে হলো ইলিনয়ে। পরিষদের কাজকর্মের অবসরে অখণ্ড সময়, তখনই তিনি আইন পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।

সাফল্যের শীর্ষে
রাজনৈতিক অভিপ্রায় যখন তার মধ্যে জেগে উঠল,লিঙ্কন দেখলেন তিনি তার কথার শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে কাবু করে ফেলার ক্ষমতা রাখেন এবং তিনি তাদের প্রতি কড়া সমালোচনা ছুড়ে দিলেন। ১৮৪০ সালে এক রাজনৈতিক সভায় তিনি তার প্রতিপক্ষ লেস থমাসের নকল করে তাকে মজা করেছিলেন, যা দর্শক তুমুল করতালি দিয়ে স্বাগত জানায়। অল্প দিনের মধ্যেই ইলিনয়ের রাজনৈতিক জগতে নিজেকে অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশেষে ১৮৪৭ সালে ওয়াশিংটন পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি প্রত্যক্ষ করলেন ওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ হোয়াইট হাউসের অদূরেই গড়ে উঠেছে নিগ্রো দাসদের খোঁয়াড়। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিগ্রো দাসদের এখানে নিয়ে আসা হতো তারপর দক্ষিণের বাজারে চালান করে দেওয়া হতো। 

দীর্ঘদিন ধরেই লিঙ্কন ছিলেন এ প্রথার বিরোধী। লিঙ্কন পার্লামেন্টের সভায় কলম্বিয়া প্রদেশে দাস ব্যবসা বন্ধের জন্য একটি বিল উত্থাপন করলেন। সম্মিলিত বিরোধিতায় সে বিল অগ্রাহ্য হলো। ব্যর্থ হয়ে লিঙ্কন ফিরে এলেন স্প্রিং ফিল্ডে। আবার আইন ব্যবসা শুরু করলেন। রাজনীতিতে আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তার। কিন্তু দাসপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি সরব হয়ে উঠলেন ঠিকই। ১৮৫৪ সালে নতুন রিপাবলিকান পার্টি গঠিত হলো। এ দলের অন্যতম প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি এ দলের রাজনৈতিক আদর্শের কথা এত সুস্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করলেন,পুরো দেশ তার বাগ্মিতায় মুগ্ধ হলো। এর অল্প দিনের মধ্যে এক ঐতিহাসিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন লিঙ্কন। দক্ষিণের দেশগুলো দাসপ্রথার সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার দাবি তুলতে শুরু করেছিল। অন্যদিকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য ডগলাস প্রবলভাবে দাসপ্রথার সমর্থন করতে শুরু করলেন।

দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য জোরাল দাবি পেশ করছিল লিঙ্কন বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন,একটি রাষ্ট্র কখনো দ্বিধাবিভক্ত হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই এক এবং ঐক্যবদ্ধ থাকবে। এ সময় রিপাবলিকান দলের জাতীয় সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য লিঙ্কনের নাম ঘোষণা করা হলো। রিপাবলিকানের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামলেন লিঙ্কন আর তার বিরুদ্ধে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হলেন চিরপ্রতিদ্বন্দ্ব্বী ডগলাস। ডগলাসকে হারিয়ে লিঙ্কন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। ১৮৬১ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিঙ্কন স্প্রিংফিল্ড ছেড়ে ওয়াশিংটনের দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে স্ত্রী মেরি। তার এত দিনের স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এ জয় আমৃত্যু লিঙ্কনের সমস্ত মানসিক শান্তিকে কেড়ে নিয়েছিল।

স্বশিক্ষিত লিঙ্কন
লিঙ্কনের তেমন কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। স্কুলে যাওয়াটাও নিয়মিত হয়নি। কিন্তু স্বশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন তিনি। বাইবেল বা শেক্সপিয়র থেকে অবলীলায় দরকারি উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে পারতেন। ইংরেজি ভাষায় যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। জন্মস্থান কেন্টাকির ছোট্ট লগ হাউসের কেবিন থেকে লিঙ্কনের হোয়াইট হাউস যাত্রাকে দেখা হয় আমেরিকান স্বপ্নের নকশা হিসেবে। ১৮৩০ সালের পর লিঙ্কন সিদ্ধান্ত নেন আইনজীবী হওয়ার। নিজে নিজেই আইনের বই পড়া শুরু করেন। নিজের এ শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে লিঙ্কন বলেছিলেন,'আমি কারও সঙ্গে পড়াশোনা করি না।'১৮৩৬ সালে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজের অনুমতি পান। আইনজীবী হওয়ার আগেই অবশ্য লিঙ্কনের রাজনীতির হাতেখড়ি হয়ে গিয়েছিল উহিগ পার্টিতে। এরপর তিনি রিপাবলিকান পার্টির একজন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ভূমিকা রাখেন।

আইনজীবী ও ব্যক্তিজীবন
১৮৩৬ সালে লিঙ্কন কৃতিত্বের সঙ্গে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ওকালতি শুরু করলেন। বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ থাকা সত্ত্বেও অল্প দিনেই লিঙ্কন আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেন। একটি বড় কারণ ছিল তার সততা, নির্লোভ মন। তিনি কখনো কোনো অন্যায়কে মেনে নিতেন না। মিথ্যা মোকদ্দমায় তাকে নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি তা ফিরিয়ে দিতেন। এর পরও আইনজীবী হওয়ার চেয়ে রাজনীতির প্রতিই লিঙ্কন ক্রমে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। ১৮৩৮-১৮৪০ সালে পরপর দুবার তিনি ব্যবস্থাপক সভার সভ্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। এ সময় ব্যবস্থাপক সভায় স্টিফেন ডগলাস নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় লিঙ্কনের। এই ডগলাস পরবর্তী জীবনে লিঙ্কনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতার সূত্রপাত এক নারীকে কেন্দ্র করে। সেই সুন্দরীর নাম মেরি টড।

এক রাতে ডগলাস আর লিঙ্কন যান নাচের আসরে। সে আসরে এসেছেন মেরি। ডগলাস ছিলেন সুদর্শন। অন্যদিকে লিঙ্কন তার সম্পূর্ণ বিপরীত। চেহারায় রুক্ষতা আর আদিম ভাব। কিন্তু ডগলাস নন,বরং লিঙ্কনের সেই রুক্ষতার প্রতিই আকৃষ্ট হলেন মেরি। কিছু দিন পর মেরিকে বিয়ের প্রস্তাব করলেন লিঙ্কন। কিন্তু মেরি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তা ছাড়া সন্দেহ, ঈর্ষাবোধও ছিল প্রবল। বিয়েতে একমত হতে পারছিলেন না তিনি। এর মধ্যেই রাজি হলেন মেরি। ১৮৪২ সালের ৪ নভেম্বর তাদের বিয়ে হলো। পরে স্ত্রীর আগ্রহে রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন লিঙ্কন।


দাসপ্রথা লোপ
দাসপ্রথা সমর্থনের ব্যাপারে এর আগে উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মতবিরোধ ছিল। দক্ষিণের রাজ্যগুলো স্থির করল তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সাউথ ক্যারোলিনার নেতৃত্বে আলাবামা,ফ্লোরিডা,মিসিসিপি, লুসিয়ানা,টেক্সাস ও জর্জিয়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ঘোষণা করে এক পৃথক যুক্তরাষ্ট্র স্থাপন করল। এই নবঘোষিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেফারসন ডেভিসের নাম ঘোষণা করা হলো। লিঙ্কন চেয়েছিলেন দাসপ্রথা নির্মূল হোক,কিন্তু দেশ বিভক্ত হলে কখনই তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হবে না। তাই নিজের সীমিত শক্তিকে সম্বল করেই দক্ষিণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। শুরু হলো যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ১৮৬৩ সালের ১ জানুয়ারি লিঙ্কন চূড়ান্তভাবে ক্রীতদাসদের মুক্তি ঘোষণায় স্বাক্ষর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনত ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটল। এ ঘোষণায় তিনি বলেছিলেন,'আমি আব্রাহাম লিঙ্কন আদেশ দিচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে উলি্লখিত রাজ্যগুলোয় ক্রীতদাসরূপে যারা বন্দী রয়েছে তারা এখন থেকে স্বাধীন,মুক্ত।'যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে দক্ষিণের সেনাপতি লির অসাধারণ নৈপুণ্যের কারণে উত্তরাঞ্চলের সেনাবাহিনী পরাজিত হতে থাকে। লিঙ্কন দেশের সব মানুষের প্রতি আহ্বান জানালেন যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সৈন্যদলে নাম লেখাল ৪০ বছরের এক প্রাক্তন ক্যাপ্টেন, নাম গ্র্যান্ট। গ্র্যান্ট সৈনিক হিসেবে ছিলেন বীর, সাহসী। শেষ পর্যন্ত গ্র্যান্টের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পিছু হটতে শুরু করলেন লি। দক্ষিণের একটার পর একটা শহর তার হাতছাড়া হয়ে গেল। শেষে লি আশ্রয় নিলেন রিচমন্ড শহরে। শহরের উপকণ্ঠে তখন গ্র্যান্টের কামান গর্জন করছে। অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যুদ্ধ শেষ হলো। লি আত্মসমর্পণ করলেন। জিতে গেলেন লিঙ্কন। ওয়াশিংটনে ফিরে এলেন তিনি। শত শত মানুষের অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে গেলেন তিনি।

রহস্যময় মৃত্যু
দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলো। যুদ্ধজয়ী লিঙ্কন সবার আগ্রহের কেন্দ্রে। ওয়াশিংটনে তখন জনগণের ভিড় কমতেই একে একে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা এলেন। এদিকে রাতের বেলায় থিয়েটারে যাওয়ার কথা। অনেকটা মেরির অনুরোধেই রাজি হন লিঙ্কন। থিয়েটার হলে পৌঁছাতেই সব দর্শক তাকে অভিনন্দন জানাল। নিজের আসনে গিয়ে বসলেন লিঙ্কন আর মেরি। দুই ঘণ্টা কেটে গেছে,বক্সে দরজার সামনে যে প্রহরী ছিল তার কাছে একজন লোক এসে বলল প্রেসিডেন্টকে একটা সংবাদ দিতে হবে। রক্ষী ভিতরে যাওয়ার অনুমতি দিতেই আততায়ী ভিতরে ঢুকে লিঙ্কনের মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালাল। চেয়ারের ওপর লুটিয়ে পড়লেন লিঙ্কন।

লিঙ্কনকে ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হলো থিয়েটার হলের সামনের একটা বাড়িতে। আঘাতের বিরুদ্ধে তার বলিষ্ঠ দেহের প্রাণসত্তার দ্বন্দ্ব চলল নয় ঘণ্টা ধরে। সকাল ৭টায় অজ্ঞান অবস্থায় লিঙ্কন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মৃত্যুর সময় লিঙ্কনের বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর। প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন খুন হন উইলকিস বুথের গুলিতে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের কিছু রাজ্য স্বাধীন হয়ে যেতে চাইছিল,কিন্তু লিঙ্কন দেশের একত্রীকরণে আগ্রহী ছিলেন। অচিরেই বুথকে খুঁজে বের করা হয়। এরপর বুথ আত্মহত্যা করেন। সমস্যা হলো,ধরা পড়ার সময় বুথ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্যারালাইজড অবস্থায় ছিলেন,যিনি কি না নিজের হাত পর্যন্ত নাড়াতে সক্ষম ছিলেন না। তাহলে বুথ কীভাবে মারা গেলেন? ফলে লিঙ্কনের মৃত্যুরহস্য আজও উন্মোচন করা যায়নি।

অনন্য একজন
১৮৬৩ সালের জুলাইয়ের যুদ্ধের চার মাস পর ১৯ নভেম্বর পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে এক স্মরণসভায় সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন লিঙ্কন। বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে ফটোসাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররা ঠিকমতো ক্যামেরা সেট করার আগেই মাত্র তিন মিনিটে ২৭২ শব্দের বক্তৃতা শেষ করেন লিঙ্কন। এ ভাষণে তার দেওয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞা যেন এক কালজয়ী মহাকাব্য। বক্তব্যের শুরুতে তিনি স্মরণ করেন তার পূর্বপুরুষদের,যারা ৪৭ বছর আগে স্বাধীনতা ও সবার মাঝে সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা মহাদেশের গোড়াপত্তন করেন। মাঝে তার কণ্ঠে ফুটে ওঠে গৃহযুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির করুণ আর্তনাদ। আর বক্তৃতা শেষ করেন এক ঐতিহাসিক উক্তি দিয়ে যা পৃথিবী থেকে কখনো হারিয়ে যাবে না।
তিনি তার ভাষণে বলেন, ‘Government of the People, by the People, for the People’. অর্থাৎ, 'গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য'; যা গণতন্ত্রের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংজ্ঞা হিসেবে আজও বিবেচিত। এ বক্তৃতার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে উপস্থিত জনতা। এমনকি হাততালি দিতেও ভুলে যায় তারা। অনেকের ক্যামেরা সচল করার আগেই শেষ হয়ে যায় তিন মিনিটের বক্তৃতা। প্রচলিত নিয়মে অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন পেশাদার এবং বাকপটু অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট,যিনি প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। অ্যাডওয়ার্ড এভার্ট দুঃখ করে বলেন,'আমি যদি আমার দুই ঘণ্টার বক্তৃতায় লিঙ্কনের তিন মিনিটের বক্তৃতার মূল কথার কাছাকাছি কিছু বলতে পারতাম, তাহলে আমার জীবন ধন্য হতো।১৮৬৩ সালের ১ থেকে ৩ জুলাই গেটিসবার্গে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু হলে এক ধর্মযাজক কথা প্রসঙ্গে লিঙ্কনকে বলেছিলেন,'মিস্টার প্রেসিডেন্ট! আসুন,আমরা বিশ্বাস রাখি এবং প্রার্থনা করি যে এই দুঃসময়ে ঈশ্বর আমাদের পক্ষে থাকবেন।'উত্তরে লিঙ্কন বললেন,'ঈশ্বর নিয়ে আমি মোটেও চিন্তিত নই। কারণ আমি জানি যে ঈশ্বর সব সময় ন্যায় ও সত্যের পক্ষেই থাকেন। এর চেয়ে বরং আসুন,আমরা প্রার্থনা করি,এ জাতি যেন সব সময় ঈশ্বরের পক্ষে থাকতে পারে।'



সূত্রঃ বিডি-প্রতিদিন/০৯ জুন, ২০১৫

1 টি মন্তব্য:

  1. অনুপ্রেরণা ও সফলতার গল্প, শিক্ষামূলক ছোট গল্প, ইসলামিক ঘটনা, মোটিভেশনাল উক্তি, রহস্য গল্প এবং অবাক করা সব ঘটনা পড়তে ভিজিট করুন অনুপ্রেরণা ডটকম।

    উত্তরমুছুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।