সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে কালিজিরা-পোল্ট্রিতে প্রয়োগে সাফল্য

ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে কালিজিরা-পোল্ট্রিতে প্রয়োগে সাফল্য



উৎপাদন বাড়াতে দেশের ডিম, দুধ, মাছ ও মাংসের যোগানদাতা পোল্ট্রি, ডেইরি, চিংড়ি ও ফিশারিজ শিল্পে ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে কালিজিরার প্রয়োগের কথা ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। গবেষণার মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে পোল্ট্রি মুরগিতে কালিজিরার প্রয়োগে সাফল্য এসেছে। মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক খাবারের সাথে ব্যবহারের কারণে মুরগি এবং মানবদেহে ব্যকটেরিয়া ও অন্যান্য রোগজীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধি ক্ষমতা অর্জন করে। ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েও প্রায় ক্ষেত্রেই কোনো কাজ হচ্ছে না। এটি এখন বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপি এক বড় সমস্যা। সেজন্য ইউরোপসহ বাংলাদেশেও পোল্ট্রি ও মাছ চাষে অ্যান্টিবায়োটিক নিষিদ্ধ করে আইন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অ্যান্টিবায়োটিকের উত্তম বিকল্প না থাকায় এটির অপপ্রয়োগ থামানো যাচ্ছে না।

 গবেষকরা মনে করছেন, পোল্ট্রির মতো প্রাণিসম্পদের অন্য খাত ডেইরি, চিংড়ি  ও ফিশারিজ শিল্পেও কালিজিরার প্রয়োগে সাফল্য আসতে পারে। ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগে উৎপাদিত মুরগির মাংস ও ডিম খেয়ে বিশ্বের অনেক দেশে যখন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারানোসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে তোলপাড় চলছে, তখন এ ধরণের উদ্ভাবন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কালিজিরা নিয়ে বিশ্বজুড়ে অসংখ্য গবেষণা হলেও বাংলাদেশে পোল্ট্রি শিল্পে অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে এর প্রয়োগে সাফল্য এটাই প্রথম বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট গবেষক। বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম এ সংক্রান্ত গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। ড. ইসলাম বাংলানিউজকে জানিয়েছেন এ গবেষণার বিস্তারিত। তিনি জানান, গৃহপালিত পশুপাখিকে রোগমুক্ত রেখে অল্প সময়ে অধিক উৎপাদনের জন্য খাবারের সাথে ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ সার্বিকভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করছে। ব্যথানাশক বা ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগে রোগাক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়া গবাদিপশুর শব খেয়ে বিষক্রিয়ার প্রভাবে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
একইভাবে, এসব মাংস, দুধ, ডিম বা এর দ্বারা প্রক্রিয়াজাত কোনো খাবার খেয়ে মানবদেহেও স্লো-পয়জনিং হচ্ছে। এর ফলে আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত জনস্বাস্থ্যও রয়েছে চরম হুমকিতে। এসবের ক্ষতিকারক প্রভাবে দেশ থেকে ইউরোপে চিংড়ি রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পথে বসেছিল। সংকট উত্তরণে তাই অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রাকৃতিক উপাদানের দারস্থ হওয়ার বিষয়টি ধীরে ধীরে জোরালো হতে থাকে। গবেষণার উপাত্ত তুলে ধরে তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, অনিরাপদ অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং এদের দ্রুত বিস্তার ঘটে। প্রাণীদের ছাড়াও কৃষি আবাদেও অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুপ প্রভাব কাজ করে। গত বছর জার্মানিতে সবজির মধ্যে ই-কোলাই নামক ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়। সেই সবজি খেয়ে ৩৩ ব্যক্তির মৃত্যু হয়। সম্প্রতি মুরগির মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া জার্মানিতে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে।  

তিনি বলেন, আমরা দীর্ঘ গবেষণায় পোল্ট্রিতে কালিজিরার প্রয়োগ করে দেখেছি-এর মাধ্যমে ল্যাকটুভেসিলাস নামক এক প্রকারের উপকারি ব্যাকটেরিয়ার দ্রুত বংশ বিস্তার ঘটে এবং তা মুরগির পাকস্থলীতে দ্রুত পরিপাকক্রিয়া সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। অপরদিকে, কালিজিরার ব্যবহারে মুরগির পাকস্থলিতে ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ২৫ শতাংশ কমে যায়। মানবদেহ সারাদিনের জন্য ২১৪-২২০ মাইক্রো গ্রাম কোলেস্টরেল গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু বাজারে যে পোল্ট্রি ডিম পাওয়া যায়, তাতে এক ডিমেই এ পরিমাণ কোলেস্টরেল রয়েছে। অন্য খাবারের মাধ্যমেও কম বেশি কোলেস্টরেল গ্রহণ করি আমরা। সেভাবে মানবদেহে বাড়তি কোলেস্টরেল জমে হৃদরোগসহ অন্য দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
কিন্তু কালিজিরার প্রয়োগে মুরগির ডিমে শতকরা ৪৩ ভাগ কোলেস্টরেল কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সুতরাং কম কোলেস্টরেলযুক্ত নিরাপদ মুরগির ডিম উৎপাদনে কালিজিরার প্রয়োগ অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। যদিও এ ডিম দিয়ে বাচ্চা ফুটানো সম্ভব হবে না কিন্তু পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে আমরা প্রতিদিন একটি ডিম খেতে পারবো। ড. তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক ভাবে লেয়ার ও ব্রয়লার মুরগিতে কালিজিরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। ধীরে ধীরে ডায়াবেটিকস সহ অন্য মানবরোগেও এটি প্রয়োগে সাফল্য আশা করছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ডোজ ও কোর্স সুনির্দিষ্ট করা জরুরি বলে মত তাঁর। বাংলাদেশে এখনো কালিজিরার ব্যবহার ও উৎপাদন কম। পোল্ট্রির মতো বিশাল সেক্টরে যদি এর প্রয়োগ করা যায়, তবে বানিজ্যিক ভিত্তিতে এর চাষ ও বিপণরের প্রচুর সম্ভাবনাও রয়েছে। তোফাজ্জল ইসলাম আরো বলেন, গবেষণার মাধ্যমে আমরা কালিজিরার অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান শনাক্তের চেষ্টা চালছে । এটি সম্ভব হলে রাসায়নিকভাবে বানিজ্যিক ভিত্তিতে এর উৎপাদন করা যাবে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালে দিনাজপুরে অবস্থিত হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এ গবেষণা সম্পন্ন করেন অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলাম। একই বছরের শেষের দিকে আন্তর্জাতিক জার্নাল অব এনিমেল এন্ড ফুড সাইন্স’-এ এই সংক্রান্ত একটি নাতিদীর্ঘ গবেষণা নিবন্ধও প্রকাশিত হয়।

যেভাবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরাঃ
পোল্ট্রি সেক্টরে পূর্বাপর সংকটের জন্য বার্ডফ্লুসহ জটিল রোগব্যাধিকেই অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয়। ক্ষতিকারক অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ এজন্য দায়ি- বিশেষজ্ঞদের এমন মতামতের সঙ্গে একমত পোল্ট্রি খামারি ও এখাত সংশ্লিষ্ট অন্যরাও। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ড্রান্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম-মহাসচিব খন্দকার মো. মহসিন এ বিষয়ে একমত পোষণ করে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন, আমরা এ ধরণের উদ্ভাবনকে স্বাগত জানাবো। ইতোমধ্যে সীমিত করে হলেও অর্গানিকের (জৈব রাসায়নিক) ব্যবহার শুরু হয়েছে। আমরাও এর ব্যবহার করছি। কালিজিরা অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রয়োগে সাফল্য আসলে একে বাণিজ্যিকভাবে এগিয়ে নেয়া যেতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক(পোল্ট্রি) ডা. আজিজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, পোল্ট্রি সেক্টরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে ঝুঁকি আছে এটা সত্য, তবে কালিজিরা এক্ষেত্রে কতটা সহায়ক হবে তা গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই বলা যাবে না, সম্প্রসারণের পর মন্তব্য করতে হবে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-র খাদ্য ও পানি বাহিত রোগ কেন্দ্রের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগের সহযোগী বিজ্ঞানী এবং গবেষক দলের প্রধান ড. আমিনুল ইসলাম কালিজিরা গবেষণাকে ইতিবাচক উল্লেখ করে বাংলানিউজকে বলেন, এটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি খবর। আমাদের পোল্ট্রি ফার্মগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ করা হয় না। মাত্রাতিরিক্ত প্রয়োগ করা হয়, যার ফলে পশুপাখীর মলমূত্রের সাথে অবমুক্ত হয়ে তা পরিবেশকেও দূষিত করে, রোগব্যাধিও ছড়িয়ে দেয়।

তিনি বলেন, এখনও এমন প্রতিষেধক বা উপাদান আবিষ্কার হয় নাই যা দিতে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলা যায়। পোল্ট্রি, ডেইরি বা ফিশারিজে মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ ব্যাকটেরিয়ার বংশ বিস্তার বাড়িয়ে দেয়। এর ফল হিসেবে মানবদেহে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি নিরাময়ে চিকিৎসাও অনেক ক্ষেত্রে কাজে আসে না। আমাদের দেশের ভাল গবেষণা কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু তিক্ত বাস্তবতার কথা তুলে ধরে ড. ইসলাম আরো বলেন, এরকম অনেক ভাল গবেষণা এদেশে ইতিপূর্বেও হয়েছে। তবে নানা কারণেই তা বেশিদূর অগ্রসর হয় না। তবে কালিজিরার এ গবেষণাকে খুবই প্রাসঙ্গিক ও সময়োপযোগী উল্লেখ করে এর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল দিয়ে এই গবেষণার পরবর্তী কাজ এগিয়ে নেয়া ও বাণিজ্যিকভাবে একে সফল করার পরামর্শও দেন তিনি।

আশরাফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।