সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: বিচিত্র সব পাখির বাসা

বিচিত্র সব পাখির বাসা



পাখিরা বর্ণালি রংয়ে, সুরেলা গানে যেমন মুখর করে রাখে প্রকৃতি এবং পরিবেশকে, তেমনি ওদের ডিম পাড়া, বাচ্চা ফুটানো ও লালন-পালন করার জন্য ওরা যে বিচিত্র সব বাসা বানায় তাও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। তবে সব পাখির বাসা যে সুন্দর তা কিন্তু নয়। বিশেষ করে বড় বড় শিকারি পাখি যেমন ঈগল, শকুন, বাজ, কাক, চিল এবং জলচর পাখিদের মধ্যে পানকৌড়ি, বক, হাড়গিলা, সারস_ এসব পাখির বাসা অগোছালো। শুকনা ডালপালা, খড়, শুকনা পাতা এসব জড়ো করে এরা গোলাকার ধাঁচের বাসা তৈরি করে। প্রথম পর্যায়ে বাসার সাইজ ছোট থাকে। কিন্তু এসব স্থিতু পাখি সাধারণত কোনো ঝুট-ঝামেলা না হলে বাসা বদলায় না। প্রতি প্রজনন মৌসুমে এরা পুরনো বাসায় নতুন খড়কুটা এনে বাসাটিকে মেরামত করে নেয়। ফলে পুরনো বাসা সাইজে বড় হলেও এতে কোনো শিল্পকর্ম নেই। অতি অল্প সময়ে এবং কম পরিশ্রমে এরা বাসা তৈরির কাজ শেষ করে। তবে বড় জাতের শিকারি পাখিরা সাধারণত উঁচু গাছের মগডালে বাসা বানানোর স্থান নির্ধারণ করে থাকে।

তবে বাবুই, টুনটুনি, মৌটুসি, ফিঙে, ঘুঘু, পাপিয়া_ এসব ক্ষুদ্রাকৃতি পাখির বাসা অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং পরিশ্রমসাধ্য ও শিল্পসম্মত। বাবুই গোত্রের পাখিদের বলা হয় তাঁতি পাখি। চিরল পাতায় কুঁড়েঘরের মতো ঝুলন্ত বাসা বানায় বলেই এদের এ নামে ডাকা হয়। বাবুই পাখির দুই পাতার ওপর এসব বাসা শুধু দেখতেই সুন্দর নয়, বেশ মজবুতও বটে। প্রচণ্ড ঝড়-বাতাসেও এসব বাসা ছিঁড়ে পড়ে না।

ছোট্ট পাখি টুনটুনি, নীল রং মৌটুসি, হামিং বার্ড_ এসব খুদে পাখির বাসাগুলো একেকটা সুন্দর শিল্পকর্ম। খুদে টুনটুনিকে বলা হয় দর্জি পাখি। এরা সাধারণত ছোট এবং বড় পাতাওয়ালা গাছে বাসা বানায়। এরা দুটি পাতা উল্টিয়ে এনে গাছের আঁশ দিয়ে অপূর্ব কৌশলে জুড়ে দেয়। দুই পাতার ভেতরে থাকে তুলা, আঁশ, নয়তো অন্য পাখির নরম পালক বিছানো, যাতে পাখিরা ডিম পড়ে। দুই পাতার ওপর অংশে থাকে সামান্য ফাঁক, যা দিয়ে ওরা যাতায়াত করে। টুনটুনির বাসাগুলো ছোট সাইজের গাছের ঘন পাতার আড়ালে এমনভাবে লুকিয়ে ওরা তৈরি করে যে, অতি সহজে তা খুঁজে পাওয়া দুষ্কুর। মৌটুসি, হামিং বার্ড_ এরা তুলা গাছের ডালের আঁশ মিলিয়ে ছোট আঁটসাঁট বাটির আকৃতির বাসা বানায়।

সবচেয়ে মজার বাসা বানায় সালাংগান সুইফট পাখি। ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোর গিরিগুহায় এই পাখিরা নিজের মুখের আঠালো লালা দিয়ে গোলাকার বাটির মতো পাঁচ থেকে ছয় সেন্টিমিটার বাসা বানায়। এরা সাধারণত পাহাড়ের গুহা ও খাড়া দেয়ালকে বাসা বানানোর স্থান হিসেবে বেছে নেয়। এরপর বাসার অদৃশ্য নকশা এঁকে নেয়। তারপর দুই পায়ের নখ দিয়ে পাথুরে দেয়াল আঁকড়ে মুখের আঠালো লালা দেয়ালে আটকিয়ে নেয়। মুহূর্তেই সে লালা বাতাসের সংস্পর্শে মাকড়সার জালের মতো শুকিয়ে যায়। এভাবে প্রতিদিন লালা ঢেলে গোলাকার বাদামি রংয়ের বাসা তৈরি করে এসব পাখি। সালাংগান সুইফট প্রতিদিনি চার থেক পাঁচ ঘণ্টা কাজ করে চল্লিশ থেকে পঁয়তালি্লশ দিনে একটি বাসা তৈরি করে।

বিশ্বের সবচেয়ে মজার বাসা বানানো পাখি হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার বোয়ার বার্জ বা কুঞ্জ পাখি। সুন্দর ইউ আকৃতির কুঞ্জদৃশ বাসা বানায় বলে এই পাখি বেশি সুখ্যাতি অর্জন করেছে। নীল রংয়ের পুরুষ পাখি লম্বা লম্বা চিকন গাছের ডাল মাটিতে পুঁতে ঊর্ধ্বমুখী ইংরেজি 'ইউ' আকৃতির কুঞ্জ বানায়। এই দুই পাশের ডালের সংযোগস্থলে খড়কুটা, নীল কাচ, নীল ফুলসহ বিভিন্ন নীল রংয়ের জিনিস কুড়িয়ে এনে এরা বাসা সাজায়। বাসা সাজানোর ক্ষেত্রে এদের নীল রংপ্রীতি এতই বেশি যে, পাখি পর্যবেক্ষকরা বোয়ার বার্ডের বাসায় নীল রংয়ের চশমা, চাবির রিংও খুঁজে পেয়েছে।

মাটির গর্তে বাসা বানায় মাছরাঙ্গা, বি-ইটার, গাংশালিক, কাদাখোঁচা, স্লাইপ, সুইচোরাসহ জলচর আরও অনেক পাখি। এরা সাধারণত লম্বা খারালে নদীর খাড়া পাড়ের মাটিতে ১৪ থেকে ১৮ ইঞ্চি গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এদের বাসায় ঢোকার মুখটা সঙ্কুচিত হলেও ভেতরের ডিম ও বাচ্চা লালন-পালনের স্থানটি যথেষ্ট প্রশস্ত। মরুভূমির এক জাতের পেঁচা আছে। এরা সমতল বালু মাটিতেই গভীর গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। এছাড়া শুধু বালু, পাথুরে ভূমি এবং ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাটিতে বাসা বানায় নীল হাঁস, প্লোভার বার্ড, ববি ট্রিপ, হাজেল গ্রাউজ, বুনো মুরগি, বুনো হাঁস, করালি হাঁস, রাজ হাঁস, এলবাট্রস, গাংচিল, যাযাবর ও হাঁস প্রজাতির পাখি। এদের বাসায় পাখির বুকের নরম পালক, শুকনো জলজ উদ্ভিদ সুন্দর করে বিছিয়ে তাতে ডিম পাড়ে। খোলামেলা মাটিতে বাসা হলেও ঝোপঝাড়, বালুর ঢিবি ও পাথরের চাঁইয়ের আড়ালে লুকানো বাসাগুলো সহজে কারও নজরে পড়া ভার। জলচর ফ্লেমিংগো জলাভূমির পাশে কাদামাটি দিয়ে গোলাকার উঁচু ঢিবির মতো বাসা বানায়। ফ্লেমিংগো পাখিরা একসঙ্গে কলোনি গড়ে তুলে বসবাস করে।

মজার বাসা বানায় বিশাল ঠোঁটের হর্ণবিল পাখি। এরা গাছের কাণ্ডে বড় গর্ত খুঁড়ে বাসা বানায়। বাসার কোটরে শুধু মেয়ে পাখিটিই ঢুকে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়া শেষ হলে মেয়ে পাখি ডিমে তা দিতে বসে। বাচ্চা না ফোটা পর্যন্ত ১৭ থেকে ১৯ দিন পাখিটি বাসা থেকে বের হয় না। এছাড়া গাছের কোটরে ঠুঁকে ঠুঁকে বাসা বানায় কাঠ-ঠোকরা, বসন্ত বাউরি, পেঁচা, এক জাতের ঝুঁটি শালিক, উড কক, স্টার্লিং, থ্রাশসহ আরও অনেক পাখি। কোনো ঝামেলা না হলে একটি বাসা এরা দীর্ঘকাল ব্যবহার করে। তবে গাছের কোটরে এরা ছোট ছোট খড়কুটা বিছিয়ে সেখানে ডিম পাড়ে। পানির ওপর কলমি, শাপলা, পদ্মফুল বা জলজ কোনো উদ্ভিদের ঝোপে খড়কুটা দিয়ে বাসা বানায় ডাহুক, কালিম ও অন্য কিছু জলচর পখি। অনেক সময় পানির চলমান স্রোতে কলমি বা কচুরিপানার সঙ্গে এসব পাখির বাসাও ভেসে যেতে থাকে। সে ক্ষেত্রে ডিম বা বাচ্চাওয়ালা ভাসমান বাসার সঙ্গে বাসার মালিকও ভেসে যেতে থাকে অজানার উদ্দেশে।

ছোট জাতের আডেলি পেঙ্গুইন সমুদ্রতটের পাথুরের গিরিখাতে নয়তো পাথরের স্তূপের আড়ালে জলজ উদ্ভিদ, সমুদ্র শ্যাওলা বিছিয়ে বাসা বানায় অগোছালভাবে। তবে বড় এমপারার বা অন্য জাতের পেঙ্গুইনরা বাসা বানায় না। এসব পাখি একটি বা দুটি ডিম পাড়ে। ডিম দুটি দু'পায়ের পাতায় রেখে ওদের তলপেটের ঘন লোমে ঢেকে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। মেয়ে-পুরুষ দুটি পাখি মিলেই তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানোর দায়িত্ব সারে। আবার দক্ষিণ আমেরিকার কোকিল প্রজাতির পাখিরা পাঁচ থেকে ১০টির ক্ষুদ্র একটি দল করে একটি বড় বাসা বানায় খড়কুটা দিয়ে এবং সবাই পালাক্রমে বসে ডিমে তা দেয়। সে জন্য এসব পাখির বাসায় ত্রিশ থেকে চলি্লশ বা তারও বেশি ডিম পাওয়া যায়। আমাদের চিরচেনা ভাত শালিক, গোবরে শালিক, চড়ুই, দোয়েল পাখি বাসা বানায় যততত্র খড়কুটা জড়িয়ে দায়সারাভাবে। চড়ুই তো বাসাবাড়ির ভেন্টিলেটরের ফাঁকফোকরেই বাসা বানায় বেশি, আর দোয়েলও তাই।
 

সূত্রঃ   বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৭ এপ্রিল ২০১২ খ্রিঃ।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।