বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি যে রোগ ভুল ডায়াগনোসিস হয় তার মধ্যে বাতজ্বর অন্যতম। সাধারণত মনে করা হয় গিরায় গিরায় ব্যথা কিংবা হাড়ে ব্যাথা হলেই সেটা বাতজ্বরের লক্ষন। অনেক সময় রক্ত পরীক্ষা করিয়ে বাতজ্বরের ডায়াগনসিন নিশ্চিত হয় বলে অনেক রোগি মনে করেন। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে সেরকম না যেরকম ধারণা করা হয়। তাহলে জেনে নেওয়া যাক বাতজ্বর কি, কেন, কিভাবে হয়, এর চিকিৎসা এবং এ থেকে মুক্ত হবার উপায়।
বাতজ্বর মূলতঃ বিটা-হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস নামক ব্যক্টেরিয়া ঘটিত জীবাণুর প্রদাহজনিত একটি রোগ, যা শিশুর হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব নষ্ট হওয়ার মতো ভয়াবহ ও ব্যয়বহুল রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি হয় ৫-১৫ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের। এ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত টনসিলের সঠিক এন্টিবায়োটিক প্রয়োগে চিকিৎসাব্যবস্খা করা না হলে প্রদাহের ২-৩ সপ্তাহ পর বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার নামক এ জটিল রোগ হতে পারে।
এখন আমাদের জানতে হবে কোনটি ভাইরাসঘটিত গলদাহ এবং কোনটি ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত গলদাহ?
ভাইরাসজনিত গলদাহ ধীরে ধীরে শুরু হয়। সারা শরীর ম্যাজম্যাজ করে। সাথে সর্দি ও কাশি থাকে। কাশতে কাশতে শ্বাসকষ্টও হতে পারে, চোখ লাল হয়ে যেতে পারে, চোখ থেকে পানি পড়তে পারে, কণ্ঠস্বর ভেঙে যেতে পারে। এই গলদাহ সাধারণভাবে ‘ঠান্ডা লাগা’ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে স্ট্রেপজনিত গলদাহর স্ট্রেপ জীবাণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের গলায় প্রবেশ করে বাসা বাঁধতে পারে। এরপর রোগী জ্বরসহ গলাব্যথায় ভোগে। গলদাহ প্রধানত শিশু-কিশোরদের হয়ে থাকে। ব্যথার মাত্রা কম হলে তারা মা-বাবাকে সমস্যার কথা জানায় না। অন্যদিকে স্ট্রেপ গলদাহ নিজে নিজে ভালো হয়ে যায় বলে অনেকেই একে গুরুত্ব দেয় না এবং চিকিৎসা করায় না। এভাবেই কেউ অজান্তেই কেউ কেউ বাতজ্বরের শিকার হয়। এই গলদাহের মূল উপসর্গ হচ্ছে গলায় ব্যথা, যা মূলত ঢোক গেলার সময় হয়ে থাকে। ব্যথা হঠাৎ করে শুরু হয় এবং সঙ্গে জ্বর থাকে (সাধারণত ১০১ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। রোগীকে হাঁ করিয়ে পরীক্ষা করলে টনসিল ও গলবিল লালচে ও ফোলা দেখা যাবে। টনসিলের এই প্রদাহ থেকে বাতজ্বর হতে পারে। গলার সামনে অবস্থিত টনসিলের লিম্ফগ্রন্থি বড় হবে এবং চাপ দিলে ব্যথা হবে। গলার শ্লেষ্মা ‘কালচার’ (জীবাণু নিরীক্ষণ) করলে স্ট্রেপ পাওয়া যেতে পারে।
বাতজ্বর নির্ণয়ের উপায়?
বাতজ্বর নির্ণয়ের উপায়?
বাতজ্বরের ডায়াগনোসিস রোগীর মূখ্য ও গৌণ লক্ষনের মাধ্যমে করা যায়। এর মধ্যে যদি মূখ্য লক্ষণ ২টি ও গৌণ লক্ষন ১টি কিংবা গৌণ লক্ষণ ২টি ও মূখ্য লক্ষণ ১টি পাওয়া যায় তাহলে বাতজ্বরের ডায়াগনসিস নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। সাথে অবশ্যই বিটা হিমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাসের প্রদাহজনিত গলাব্যথার ইতিহাস থাকতে হবে।
মুখ্য লক্ষণ রয়েছে ৫টিঃ
মুখ্য লক্ষণ রয়েছে ৫টিঃ
১। হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ, যা হলে রোগীর জ্বর, বুকে ব্যথা, বুক ধড়ফর করা, নাড়ীর গতি বেড়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা হয়।
২। গিরায় ব্যথা, যা হলে মূলত বড় গিরায় যেমন হাঁটু, গোড়ালি, হাতের কবজি, কনুই ও কোমরে ব্যথা হয়, ফুলে যায় ও লালচে বর্ণ ধারণ করে। প্রথমে যেকোনো একটি গিরায় ব্যথা ও ফোলা থাকে, তার সেই গিরার ব্যথা ও ফোলা ২-৩ দিন পর কমে গিয়ে আরেকটি গিরাকে আক্রান্ত করে। এভাবে প্রদাহ এক গিরা থেকে অন্য গিরায় ছড়িয়ে পড়ে।
৩। ইরিথেমা মারজিনেটাম অর্থাৎ বুকে ও পিঠের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন আকৃতির লাল বর্ণের চাকা দেখা দেয়া, যেগুলোতে কোনো ব্যথাও হয় না, আবার চুলকায়ও না, তবে একটু ফুলে ওঠতে পারে এবং নিজে নিজেই ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যায়।
৪। সিডেনহ্যাম কোরিয়া, যা মস্তিষ্কের এক ধরনের সমস্যা। এর ফলে রোগীর মেজাজ খুব খিটখিটে হয়। হাত-পা বা শরীরের কোনো অংশ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অযথা কাঁপতে থাকে।
৫। চামড়ার নিচে ছোট দানা, যেগুলো সিমের বীচির মতো আকৃতির, শক্ত ও ব্যথাযুক্ত। এগুলো সাধারণত কনুই, ঘাড়, কবজি বা পায়ের সামনের দিকে দেখা যায়।
গৌণ লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ
১। স্বল্পমাত্রার জ্বর ও শুধু গিরার ব্যথা।
২। রক্তে ইএসআর এবং এএসও টাইটার বেশি হওয়া।
বাতজ্বর থেকে বেঁচে থাকার উপায়ঃ
বাতজ্বর থেকে বাঁচার জন্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সঠিক পুষ্টি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং গলদাহ হলে সময়মতো এর চিকিৎসা করা।
শিশুর পরিমিত পুষ্টি নিশ্চিত করুনঃ শিশুর শরীরের পুষ্টিমান সঠিক হলে গলায় জীবাণু ঢুকলেও বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা কম। অপুষ্টি বাতজ্বরের সূতিকাগার। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলায় দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টিতে ভোগে তাদের বাতজ্বরের আশঙ্কা যেসব শিশুর রক্তে আমিষ ও লৌহের অভাব রয়েছে, তাদের বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করা জরুরি।
সর্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুনঃ ‘স্ট্রেপ’ জীবাণু নাক, গলা ও ত্বকে বাস করে। লোকজন যদি অপরিষ্কার থাকে, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন না থাকলেও স্ট্রেপ একজন থেকে অন্যজনে ছড়াতে থাকবে। পরিবারের সবাই যদি প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোসল করে এবং হাত ও নাক পরিষ্কার করে, তাহলে ঘরে স্ট্রেপ জীবাণুর পরিমাণ কমে যাবে। সাথে দৈনিক অন্তত একবার গড়গড়া করে গলা পরিষ্কার করে এগুলোর বিস্তার প্রতিহত করতে হবে।
বাতজ্বরের চিকিৎসা নিনঃ বাতজ্বরের আক্রমণের সংখ্যা যত বাড়বে, বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি হবে। তাই এব্যাপারে কোন অবহেলা করা যাবেনা। বাতজ্বরের চিকিৎসা সহজ ও সস্তা। কিন্তু এ চিকিৎসা ব্যবস্থা দীর্ঘমেয়াদি। মোট পাঁচ বছর অথবা ২২ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত নিতে হবে। এর মধ্যে যেটি দীর্ঘতর হবে, সেটিই প্রযোজ্য হবে। যেমন যার বয়স ১০ তাকে নিতে হবে বার বছর, আর যার বয়স ২০, তাকে নিতে হবে পাচ বছর। যাদের হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হয়েছে, তাদের কমপক্ষে ১০ বছর অথবা ৩০ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত নিতে হবে (এর মধ্যে যেটি দীর্ঘতর হয়)। অন্যদিকে যাদের বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ হয়েছে, এমনকি যারা ভাল্বের অস্ত্রোপচার করেছে, তাদের আজীবন নিতে হবে।
বাত জ্বর নিয়ে কিছু কথা জেনে রাখা জরুরীঃ
গিরাব্যথা ও জ্বর হলেই বাতজ্বর নয়ঃ গিরা ফোলা বা ব্যথাসহ জ্বর আরও বেশ কিছু রোগে হতে পারে। তাই গিরাব্যথা হলেই বাতজ্বর হয়েছে বলা যাবে না। তবে গিরা ফুলে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। মনে রাখবেন, বাতজ্বরের গিরা ফোলা বা ব্যথা সহজেই ভালো হয়ে যায়। তাই চিকিৎসা নেওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো রোগীর গিরাব্যথা ভালো না হয়, তাহলে রোগটি বাতজ্বর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বাংলাদেশে যারা বাতজ্বরের চিকিৎসা নিচ্ছে, তাদের অধিকাংশই এ ধরনের রোগী।
রক্তের এএসও টাইটার বেশি মানেই বাতজ্বর নয়ঃ বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট রক্ত পরীক্ষা নেই। তাই বাতজ্বর সন্দেহ হলে চিকিৎসকেরা রক্তের অ্যান্টি-স্ট্রেপটোলাইসিন-ও (এএসও) পরীক্ষা করে থাকেন। এএসও বেশি হওয়ার অর্থই বাতজ্বর নয়। স্ট্রেপ দ্বারা গলদাহ হলেই রক্তে এএসওর মাত্রা বাড়বে। বাতজ্বর হলে অবশ্যই উপরোল্লিখিত মূখ্য ও গৌণ লক্ষণগুলো থাকতে হবে। লক্ষণ বা উপসর্গের অনুপস্থিতিতে এ ধরনের রক্ত পরীক্ষা মূল্যহীন।
বাতজ্বর হলেও গর্ভধারণ করা যায়ঃ মেয়েদের বাতজ্বর হলে বিয়ে বা সন্তান ধারণে অসুবিধা নেই। গর্ভধারণ করলেও পেনিসিলিন চালিয়ে যেতে হবে। এতে সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ গুরুতর হলে সন্তান নেওয়া মায়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তাই বাতজ্বরজনিত হৃদরোগীরা গর্ভধারণের আগে বাতজ্বরে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
উপসর্গ ভালো হলেই ওষুধ বন্ধ করা যাবে নাঃ উপসর্গ ভালো হয়ে গেলেই বাতজ্বরের প্রতিষেধক চিকিৎসা বন্ধ করা সঠিক নয়। বাতজ্বর একবার হলে বারবার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই বাতজ্বরে আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শমতে নিয়মিত ও ক্রমাগত পেনিসিলিন ব্যবহার করতে হবে, যাতে পুনরায় বাতজ্বর না হয়। মনে রাখবেন, এই পেনিসিলিন গ্রহণ বাতজ্বরের পূর্ববর্তী আক্রমণের জন্য নয়। এটি ভবিষ্যতে বাতজ্বর না হওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদি টিকা হিসেবে কাজ করে।
বাতজ্বর ছোঁয়াচে রোগ নয়ঃ বাতজ্বর ছোঁয়াচে রোগ নয়। বাতজ্বরের রোগীর সঙ্গে থাকলে, খেলে, ঘুমালে, এমনকি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলেও বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা নেই। গর্ভাবস্থায় মা থেকে শিশুতেও সংক্রমণের আশঙ্কা নেই। কিন্তু স্ট্রেপ গলদাহের সময় কাছাকাছি থাকলে, কথা বললে অন্যের গলদাহ হতে পারে। তাই শিশুর গলাব্যথা হলে সেসময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।