সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: রমজান ও ডায়াবেটিস

রমজান ও ডায়াবেটিস


সামনে রমজান মাস। যাঁরা ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তাঁদের রোজা রাখা না-রাখা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো রয়েছে, তার জবাব নিয়ে স্বাস্থ্যকুশলের এই বিশেষ আয়োজন। বিশ্বের প্রায় ১৫৭ কোটি মুসলিমের মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৫ কোটি ডায়াবেটিসের রোগী রমজান মাসে রোজা পালন করেন। ১৩টি মুসলিমপ্রধান দেশে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, প্রায় ৮০ শতাংশ টাইপ ২ ডায়াবেটিসের রোগী নিয়মিত রোজা পালন করে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে একজন সুস্থ ও সুনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগীর রোজা পালন করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু রমজান মাসে পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের ধরন ও ডায়াবেটিসের ওষুধ বা ইনসুলিনের পরিবর্তিত মাত্রা ও সময় সঠিকভাবে জেনে নিয়ে একজন ডায়াবেটিস রোগী রোজা পালনের জন্য সঠিকভাবে তৈরি হয়ে নেবেন। সুপরিকল্পিত ও সঠিক নির্দেশিত উপায় অবলম্বন করলে রমজান মাসে একজন ডায়াবেটিসের রোগীর কোনো রকমের সমস্যা বা অসুস্থ হওয়ার কথা নয়, কিন্তু এর বিপরীতটি ঘটলে অনেক সময় বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে।

ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর ইফতারি হওয়া চাই সুষম ও পুষ্টিকর। ছবিটি প্রতীকী
ছবি: সৈকত ভদ্র

রোজা পালনে ঝুঁকি আছে কাদের?
রমজান মাস শুরু হওয়ার অন্তত দুই থেকে তিন মাস আগেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন এবং আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে দিন। প্রথমেই জেনে নিন আপনার রোজা পালনে কোনো বাধা আছে কি না। গত তিন মাসের মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া) এবং ডায়াবেটিস কোমায় আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তিদের ঝুঁকি থেকেই যায়। যাঁদের বারবার হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার ইতিহাস আছে, যাঁরা হাইপোগ্লাইসেমিয়া-অসচেতন রোগী, যাঁদের রক্তে সুগার একেবারেই অনিয়ন্ত্রিত, যাঁরা যকৃত, কিডনি, হূদ্যন্ত্র ও অন্যান্য রোগে আক্রান্ত, ডায়ালাইসিস করছেন, এমন রোগী, অত্যধিক বয়স্ক রোগী এবং গর্ভবতী ডায়াবেটিসের রোগীরা রোজা থেকে বিরত থাকলেই ভালো। নিজের সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে রমজানের দুই থেকে তিন মাস আগে একটি সম্পূর্ণ চেকআপ করিয়ে নিন। এ সময় রক্তের সুগার, সুগারের গড় মাত্রা বা এইচবিএওয়ানসি, কিডনি ও লিভার পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। এসব পরীক্ষার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আসন্ন রোজা পালনের পরিকল্পনা নিন।

কী কী বিপদ হতে পারে?
রমজানের আগে ও সময় সঠিকভাবে প্রস্তুতি ও শিক্ষা না নিলে অন্ততপক্ষে চার রকমের বিপদ ঘটতে পারে এ সময়। এক. হঠাৎ করে রক্তে সুগার অনেক কমে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন অর্থাৎ হাইপোগ্লাইসেমিকে আক্রান্ত হতে পারেন। দুই. রক্তে সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতে পারে। তিন. ডায়াবেটিস কিটোএসিডোসিস বা কোমা হয়ে যেতে পারেন। চার. পানিশূন্যতা ও থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হতে পারেন।

রমজানের খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামঃ
একজন ডায়াবেটিসের রোগী রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতেন, রমজান মাসেও তার হেরফের হবে না, কেবল এর সময়সূচি ও উপাদান পরিবর্তিত হতে পারে। ইফতারির সময় ও পরে হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ না করা, চিনি, মিষ্টি ও ভাজাপোড়া খাবার থেকে বিরত থাকা এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসের মাধ্যমে এ সময় অনেকটাই সুস্থ থাকা যায়। রক্তে দ্রুত সুগার বাড়ায় না, এমন খাবারকে লো গ্লাইসেমিক ফুড বলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে পড়ে লাল আটা, লাল চালের ভাত, গোটা শস্য, শস্যবীজ ইত্যাদি। রোজার মাসে এসব খাবারের পরিমিত গ্রহণ রক্তে সুগারের মাত্রা দীর্ঘক্ষণ ধরে সুষম রাখতে সাহায্য করবে। হাই ক্যালরি ও হাই গ্লাইসেমিক ফুড যত সুস্বাদু ও মুখরোচকই হোক না কেন, যেমন জিলাপি, লাড্ডু, শরবত, হালুয়া, কেক, আলুনি, সফট ড্রিংক ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। বেশি পরিমাণে তেল আছে এমন খাবার, যেমনকাবাব, বেগুনি, পেঁয়াজু বা ভাজাপোড়ায় কেবল ওজনই বাড়াবে না, রক্তে চর্বি বাড়িয়ে দেবে, পেটে বদহজম ও গ্যাস সৃষ্টি করবে। রোজা রাখলে সূর্যাস্তের পর অন্তত তিনবার খাদ্য গ্রহণ করুন। ইফতারির সময় সুষম ও পুষ্টিকর পরিমিত আহার, রাত ১০টার দিকে রুটি বা হালকা ডিনার এবং অবশ্যই শেষ রাতে ভাত বা রুটিসহযোগে যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ ও তরল খাদ্য গ্রহণ করুন। সেহির না খেয়ে কোনো অবস্থাতেই রোজা রাখা উচিত নয়। রোজা রেখে দিনের বেলা অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে রক্তে সুগার হঠাৎ কমে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। সন্ধ্যার পর হালকা ব্যায়াম বা আধা ঘণ্টা হাঁটা যেতে পারে। যাঁরা নিয়মিত দীর্ঘ ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়ে থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এটিই ব্যায়ামের বিকল্প, আলাদা করে ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই।

নিয়মিত সুগার মাপুনঃ
বিশ্বের বড় বড় ইসলামি চিন্তাবিদ ও শাস্ত্রবিদেরা আগেই রায় দিয়েছেন যে রোজা রেখে রক্তে সুগার পরীক্ষা করালে তাতে রোজা ভেঙে যায় না। রমজান মাসে বাড়িতে গ্লুকোমিটারে মাঝেমধ্যে নিজের রক্তের সুগার নিজে মেপে দেখুন। অন্তত সপ্তাহে এক বা দুই দিন সেহিরর দুই ঘণ্টা পর এবং ইফতারির অন্তত আধা ঘণ্টা আগে সুগার মাপুন। সেহিরর পর সুগার আট মিলিমোল বা এর কম এবং ইফতারির আগে ছয় মিলিমোল বা এর কম থাকা বাঞ্ছনীয়। এর মধ্যে দিনের যেকোনো সময় খারাপ লাগলে বা শরীর কাঁঁপলে, ঘেমে উঠলে, মাথা ফাঁকা লাগলে অবশ্যই সুগার মাপুন। দিনের যেকোনো সময়ে সুগার ৩ দশমিক ৩ মিলিমোল বা তার কম এবং দিনের পূর্বাহ্নেই ৩ দশমিক ৯ মিলিমোল বা তার কম হয়ে গেলে সেদিন রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। দিনের যেকোনো সময় রক্তে সুগার ১৬ মিলিমোলের বেশি হয়ে গেলেও রোজা ভাঙতে হবে।

ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময় জেনে নিনঃ
রমজান মাসে ডায়াবেটিসের ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়। সোজা নিয়মে সকালের ডোজটি দেওয়া হয় ইফতারির সময় এবং রাতের ডোজটি অর্ধেক করে শেষ রাতে দেওয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ ধরনের পরিবর্তন করা উচিত নয়। কোন ওষুধ এবং কোন ধরনের ইনসুলিনের জন্য কোন ধরনের পরিবর্তন ঠিক কোন রোগীর জন্য প্রযোজ্য হবে, তা চিকিৎসকই বলতে পারবেন। কাজেই রমজানে নিজের ওষুধের মাত্রা ও সময় জেনে নেওয়ার জন্য আগে থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নিন।





তানজিনা হোসেন |
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ,
বারডেম হাসাপাতাল

সূত্রঃপ্রথম আলো, ১৮ জুলাই ২০১২ ইং

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।