লক্ষ্য করে দেখেছেন, আজকাল ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলি যেন আগের তুলনায় অনেক কম টেকসই হয়ে পড়েছে৷ বিকল হলে মেরামতের
উপায় নেই, ফেলে দিয়ে নতুন
কিনতে হয়৷ এমন অভিজ্ঞতা
কার না হয়েছে? গ্যারান্টি শেষ
হওয়ার ঠিক পরেই প্রিন্টার
বা কফি মেশিন বিকল হয়ে গেছে৷ স্মার্টফোনের
ব্যাটারি বদলাতে চান? সেটা যদি আইফোন, আইপ্যাড বা আইপড হয়, তাহলে তো ব্যাটারি কোথায়, তাই জানতে পারবেন না৷ ফলে সেটি বের করে বদলানোরও উপায় নেই৷ ল্যাপটপের যন্ত্রাংশ বদলাতে
গেলে শুনবেন, নতুন মডেলের দাম নাকি তার থেকে কম! অর্থাৎ বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে এরকম৷ জেনেশুনেই
কোম্পানিগুলি তাদের ডিভাইস এমনভাবে তৈরি
করছে, যার আয়ু সীমিত
হতে বাধ্য৷ বিকল হলে ফেলে
দিন, নতুন মডেল কিনুন৷ মেরামত করা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না৷
এটাই তারা চায়৷ কারণ সস্তার যন্ত্রাংশ মানে
উৎপাদন প্রক্রিয়ার
ব্যয় কমে যায়৷ আর চাহিদাও বজায় থাকে৷
কোম্পানিগুলির মুনাফা হচ্ছে, ভালো কথা৷ কিন্তু এমন ‘বিজনেস মডেল'এর ফলে ক্রেতাদের কি ক্ষতি হচ্ছে না? তাছাড়া পরিবেশের জন্যও এমন বিকল যন্ত্রপাতি ক্ষতিকারক৷ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে
প্রাকৃতিক সম্পদের উপর বাড়তি চাপ পড়ে৷ তারপর শিল্পোন্নত দেশগুলি থেকে বিষাক্ত
বিপজ্জনক ইলেকট্রনিক বর্জ্যও পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেই সব দেশে৷জার্মানিতে অনেক ক্রেতাই বিষয়টি
নিয়ে বিরক্ত৷ তাঁদের মধ্যে অনেকে একটি ওয়েবসাইটে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লেখেন৷ কোন
কোম্পানি জেনেশুনে তাদের কোন পণ্যকে এমনভাবে
তৈরি করেছে, যাতে তার আয়ু
কম হয় বা দ্রুত অচল হয়ে
পড়ে – এ বিষয়ে অনেকে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন৷ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের
ক্ষেত্রেই এমনটা সবচেয়ে
বেশি দেখা যায়৷ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকার শীর্ষে রয়েছে রেডিও, টেলিভিশন বা
সিডি প্লেয়ারের মতো
মনোরঞ্জনের উপকরণ৷ তারপর নানা রকমের কম্পিউটার এবং সাধারণ ও মোবাইল টেলিফোন৷ অভিযুক্ত
কোম্পানিগুলির নামও কারো অজানা নয় – এপসন, ব্রাদার, ফিলিপস ও অ্যাপল'এর মতো বহুজাতিক সংস্থা প্রায়ই দেখা যায়৷ নভেম্বরের শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘স্যামসাং' ছিল শীর্ষে৷
কোনো ডিভাইস বা পণ্যকে দ্রুত বাতিল
করতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সস্তার যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়৷ কিছু জায়গায় খরচ
বাঁচাতে প্রায়ই ধাতুর বদলে প্লাস্টিক
বসানো হয়৷ তবে সে সব অংশ খুব
ছোট হওয়ায় সহজে তা চোখে পড়ে না৷ কোলোন শহরে
জার্মান অর্থনীতি ইন্সটিটিউট'এর বিশেষজ্ঞ
ডমিনিক এনস্টে এ বিষয়ে বললেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, যে কোম্পানিগুলি মোটেই টেকসই পণ্য তৈরি করতে চাইছে না৷ অর্থাৎ সম্পদের
সদ্ব্যবহার করে টেকসই উন্নয়নের ধারণা বা সামাজিক দায়িত্ববোধের বিষয়টির সঙ্গে তা মোটেই খাপ খাচ্ছে
না৷'' এমন পণ্য
উৎপাদনের পিছনে সার্বিক পরিকল্পনা রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ অনেক ক্ষেত্রে
নতুন পণ্য বাজারে আনার আগেই যখন ভাবনা-চিন্তা করা হয়, তখনই সেটিকে একেবারেই বেশি টেকসই না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷
মোটামুটি তিন বছর অক্ষত
রাখতে যে অর্থ ব্যয় করতে হয়, নির্মাতারা
সেটুকুর বেশি করতে চায় না৷ কারণ উৎপাদনের পর সাধারণত ৩ বছর
পর্যন্ত গ্যারান্টি থাকে৷ তারপর আর কোনো কোনো দায়-দায়িত্ব থাকে না৷ এর মধ্যে পরবর্তী প্রজন্মের
পণ্য বাজারে আনার তাগিদ
তৈরি হয়৷
কিন্তু সমস্যা হলো, ইলেক্ট্রনিক পণ্যের আয়ু কমানোর ফলে
কাঁচামালের চাহিদা নিয়ে সমস্যা
দেখা দিচ্ছে৷ ইলেক্ট্রনিক
পণ্যে সোনা, রুপো, তামা, রেয়ার আর্থ ইত্যাদি নানা ধাতুর প্রয়োজন হয়৷ সেগুলির দাম কম নয়৷
উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অনেক বিষাক্ত
দ্রব্যও ব্যবহার করা হয়৷ আর
ইলেক্ট্রনিক পণ্যের অনেক জ্বালানির প্রয়োজন হয়৷ডমিনিক এনস্টে অবশ্য সব দোষ কোম্পানিগুলির
ঘাড়ে চাপাতে প্রস্তুত নন৷ তিনি বললেন, ‘‘সবার শেষে বিষয়টি ক্রেতা বা ভোক্তাদের হাতে চলে যায়৷ মানুষ
আজকাল সস্তার
জিনিসপত্রের দিকেই বেশি ঝোঁকে৷ এমন চাহিদার ফলেও কোম্পানিগুলি তাদের খুশি রাখতে বাধ্য হয়৷'' বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, শেষ পর্যন্ত এই মডেল অর্থনীতির
ক্ষতিসাধন করে৷ ধারাবাহিক
চাহিদার ফলে উৎপাদন বাড়ে এবং
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয় ঠিকই, কিন্তু তার পরিণাম ও তার মূল্য সহজে চোখে পড়ে
না৷ কাঁচামাল হিসেবে প্রাকৃতিক
সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত
ব্যবহার ও বর্জ্য পদার্থ নিয়ে সমস্যার ফলে যে কোনো দেশের ক্ষতি হয়৷ এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের সচেতনতা
বাড়ানো প্রয়োজন৷ তারা
যাতে ভেবেচিন্তে ইলেক্ট্রনিক পণ্য কেনে, সে বিষয়ে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন৷ পাঁচ বছরের জন্য সস্তায় দুটি যন্ত্র কেনার বদলে
কিছু বেশি খরচ করে এমন
যন্ত্র কেনা যায়, যা ৫ বছর
টিঁকবে৷
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।