সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: বরফ রাজ্য

বরফ রাজ্য




অ্যান্টার্কটিকা মানেই বরফের রাজ্য। সেখানে বছরজুড়ে শুধু সাদা বরফের সারিই দেখা যায়। কিন্তু এই বরফের রাজ্য কবে গঠিত হয়েছিল, তার আগেই বা কি ছিল সেখানে, তা এখনো এক বিস্ময়ের ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় হয়তো বলতে পারেন, কতদিন আগে গঠিত হয়েছিল এই বরফরাজি। তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন চমক জাগানিয়া এক খবর। একসময় নাকি অ্যান্টার্কটিকার মাটি সবুজে ঘেরা এক সুন্দর বনভূমিতে আচ্ছন্ন ছিল। সম্প্রতি 'নেচার' জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দাবি করেন, ৫২ মিলিয়ন বছর আগে অ্যান্টার্কটিকায় বিশাল এক রেইন ফরেস্ট ছিল। একই সঙ্গে তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, অব্যাহত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এক সময়ের অ্যান্টার্কটিকা আগামী কয়েক দশকে বরফশূন্য হয়ে যেতে পারে। চমৎকার প্রকৃতির এ স্থানটিতে সবারই ইচ্ছা করে আজীবন থেকে যেতে। কারণ, মহাদেশটির পশ্চিম প্রান্তে আছে নোনাজলের উপসাগর। তার পেছনে চকচক করছে হিমবাহ আর পাথুরে পাহাড়ের চূড়া। এর ঠিক উত্তরেই আগ্নেয়গিরি এরিবাস। এমন স্থানে বাস করতে কার না মন চায়! কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা কি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের উপযুক্ত?

মোটেও না। কারণ, গ্রীষ্মেও এখানে থাকে শীতল বরফে ঢাকা। তাপমাত্রা থাকে শূন্য ডিগ্রির নিচে অর্থাৎ মাইনাস ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর বাতাসের গতিবেগ থাকে ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার। তবে কয়েক কোটি বছর আগে অ্যান্টার্কটিকার অবস্থা মোটেও এমন ছিল না। তখন এখানে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিক। অ্যান্টার্কটিকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর বৃহত্তম মহাদেশ গন্ডোয়ানাল্যান্ড। নামকরণটি করা হয়েছিল ভারতের গন্ডোয়ানার নামানুসারে। ঘন অরণ্যের এ মহাদেশে তখন পশুপাখিও ছিল। কিন্তু একদিন গন্ডোয়ানাল্যান্ড ভাঙতে শুরু করে।
ভেঙে কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অ্যান্টার্কটিকা অংশ গিয়ে হাজির হয় দক্ষিণ মেরুতে। প্রায় ৫৪ লাখ বর্গমাইলের এই বিশাল মহাদেশে যে পরিমাণ বরফ আছে, তা পৃথিবীর মোট বিশুদ্ধ পানির প্রায় আটষট্টি শতাংশ! ১৮৪১ সালে অ্যান্টার্কটিকার ভূভাগের কেন্দ্রস্থল সাউথ পোলেতে প্রথম মানুষের পা পড়ে। ব্রিটেনের পর্যটক জেমস ক্লার্ক রস প্রথম এ মহাদেশে বেড়াতে আসেন। পরে অপার সৌন্দর্যের এ স্থানটিতে আস্তানা গড়ে তোলেন বিশ্বের ১৬টি দেশের গবেষকরা। এখানে অবস্থান করে তারা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রকৃতির নানা বিষয়ের ওপর। এখানে আছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পেংগুইনসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি। তিমিসহ আরও ২০০ প্রজাতির মাছ। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই অনিন্দ্য সুন্দর মহাদেশটি আজ হুমকির মুখে। বিজ্ঞানীদের নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং অবহেলার কারণে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে। এ ছাড়া আছে পর্যটকদের উৎপাত। প্রতি বছর এখানে যেসব পর্যটক বেড়াতে আসেন, তাদের হৈচৈ, চিৎকার এবং মদ, বিয়ার ও সিগারেটের টুকরোয় নোংরা হয়ে পড়ে বিশাল অঞ্চল। তাদের উৎপাতে নিরীহ প্রাণীগুলোও সব সময় থাকে আতঙ্কে। বিশ্বের 'খাসভূমি' হিসেবে পরিচিত অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে তাই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মহাচিন্তিত। তাদের আশঙ্কা, গ্যাস, তেল অনুসন্ধানকারীদের যাত্রা একবার শুরু হলে এ অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা অনুমান করা খুবই কষ্টকর। বিভিন্ন দেশ অ্যান্টার্কটিকাকে নিজেদের দখলে রাখতে বিভিন্ন সময় নিয়েছেন নানারকম কৌশল। ১৯৩০ সালে জার্মান বৈমানিকরা পেনিনসুলাতে নেমে পুঁতেছিলেন নিজ দেশের জাতীয় পতাকা সংবলিত হাজার হাজার খুঁটি। ১৯৪৬ সালে আমেরিকাও এই মহাদেশটি নিজেদের দখলে নিতে হাজার হাজার সৈন্য, যুদ্ধবিমান নিয়ে দিয়েছে মহড়া। দখলদারিত্বের রাজনীতিতে মজার কাজটি করেছে আর্জেন্টিনা। তারা গর্ভবতী এক মহিলাকে তাদের গবেষণাগারে এনে রেখে দেয়। ওই মহিলা এখানেই বাচ্চা প্রসব করে। ধারণা করা হয়, ওই শিশুটিই জন্মসূত্রে অ্যান্টার্কটিকার প্রথম স্থায়ী নাগরিক!

অ্যান্টার্কটিকা পূর্ব উপকূলের সমুদ্রতলের মাটি পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা 'পরাগরেণুর ফসিল' পেয়েছেন। তাদের ধারণা, আনুমানিক ৩৪-৫৪ মিলিয়ন বছর আগে ইয়োসেনি যুগে এ মহাদেশের মাটি ক্রান্তীয় চিরসবুজ বনভূমির মতো সবুজ বনানীতে আচ্ছাদিত ছিল। গবেষণায় অংশ নেওয়া অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানী ও কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেভিন ওয়েলস জানান, 'পরীক্ষাধীন স্থানের মাটিতে প্রাপ্ত তাপসংবেদী অণুগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ওই এলাকা একসময় অনেক উষ্ণ ছিল এবং আনুমানিক ৫২ মিলিয়ন বছর আগে তাপমাত্রা ছিল প্রায় ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি।' তিনি আরও বলেন, 'তখন হয়তো এখানে বনভূমি ছিল, তাপমাত্রাও উষ্ণ ছিল এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বর্তমানে আমরা অ্যান্টার্কটিকা বলতে যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর বরফের সারি বুঝি, তা হয়তো ছিল না।'


ধারণা করা হয়ে থাকে, অতি উচ্চমাত্রায় কার্বন-ডাই-অঙ্াইডের উপস্থিতির কারণে সুদূর অতীতে বরফমুক্ত ছিল অ্যান্টার্কটিকা এবং এই মাত্রাটা ছিল প্রতি মিলিয়নে ৯৯০ থেকে ২০০ হাজার পয়েন্ট পর্যন্ত। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের হার অত্যন্ত বেড়ে গেছে এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোই মূলত এর জন্য দায়ী। বিজ্ঞানীদের হিসাবে বর্তমানে পৃথিবীর বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৩৯৫ পিপিএম। ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) সঙ্গে একমত পোষণ করে ওয়ালস বলেন, 'কবে নাগাদ অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাবে তা বলা মুশকিল, কারণ তা নির্ভর করছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও মানুষের আচরণের ওপর।' তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন, বর্তমানের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী শতকে অ্যান্টার্কটিকায় আর বরফ থাকবে না। থাকবে না আর সাদা বরফের রাজ্য।


শামছুল হক রাসেল



সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৪-০২- ২০১৩ ইং

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।