সারা
শরীরজুড়ে অসংখ্য পোড়া দাগ। মাথায় আঘাতের চিহ্ন আর কয়েক জায়গায় থেঁতলানো। দুই
কানের লতি প্লাস দিয়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। শরীরজুড়ে দগদগে ঘা নিয়ে অর্ধমৃত
অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার দেশে ফিরেছেন ফরিদপুরের কিশোরী তাছলিমা (২২)। মধ্যযুগীয়
কায়দায় বর্বর নির্যাতনের শিকার তাছলিমা এখন প্রায় বাকরুদ্ধ। গতকাল তাছলিমাকে
জরুরি ভিক্তিতে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস
সেন্টার) ভর্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ফরিদপুর
শাখার সদস্যরা তাছলিমাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। সংস্থাটির জেলা শাখার প্রধান
শিপ্রা গোস্বামী জানান, তাকে আইনগত সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, জেলার চরভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর ইউনিয়নের চরসালেপুর
গ্রামের দিনমজুর কাইমুদ্দিনের কিশোরী কন্যা তাছলিমা বেগম দালালদের মাধ্যমে কাজের
জন্য ২০১০ সালের ৫ জানুয়ারি লেবাবন যান। ভালো বেতন ও বাড়িতে কাজ করার কথা বলে
তাছলিমাকে লেবাননে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে গিয়েই বছরের পর বছর শারীরিক
নির্যাতনের শিকার হন তাছলিমা।
হাসপাতালে
ভর্তি তাছলিমা গতকাল এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হলে জানায়, লেবাননের
নবাতিয়ে শহরের স্থানীয় ব্যবসায়ী হাম্মাদ হযরতের বাসায় কাজের লোক হিসেবে যোগ
দেন। হাম্মাদের স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করতেন। চাকরিতে যোগ দেওয়ার
কয়েকদিন পর থেকে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। হাম্মাদের স্ত্রী লামা সুমেরো প্রায়
প্রতিদিনই তার ওপর নির্যাতন চালাত। ভালো কাজ করতে পারি না অভিযোগ করে চাকু দিয়ে
শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়। লোহার রডজাতীয় জিনিস দিয়ে আঘাত করে মাথা
ফাটিয়ে দেয়। তা ছাড়া গরম আয়রন দিয়ে শরীরের অসংখ্য জায়গায় ছ্যাঁকা দেওয়া
হয়। প্লাস দিয়ে দুই কানের লতি টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়। বর্বর এসব নির্যাতন সহ্য
করতে না পেরে কয়েকবার জ্ঞান হারাই। আমাকে একবেলা রুটি খেতে দিত। নির্যাতনের কারণে
আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলেও আমাকে কোনো চিকিৎসা দেওয়া হতো না। হাম্মাদের ছোট
ছেলে মাঝে মধ্যে আমাকে লুকিয়ে খাবার দিত। অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে
আমি বেশ কয়েকবার পালিয়ে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। এক পর্যায়ে আমার
শারীরিক অবস্থা এতটাই খারাপ হয়, আমি মরে গেছি ভেবে ম্যাডাম আমাকে কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে রাখে। গত
কয়েকদিন আগে তারা আমাকে বলে, তুই তাড়াতাড়ি মারা যাবি। তোকে আর এখানে থাকতে হবে না। আমার
ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা আমাকে খালি হাতে দেশে পাঠিয়ে দেয়। তাছলিমার
বাবা কাইমুদ্দিন বলেন, আমার বড় অভাবের সংসার। ৫ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে কোনো রকমে
দিনমজুরি করে সংসার চালাতাম। দালালের কথা শুনে ও মেয়ের সুখের আশায় তাকে বিদেশ
পাঠিয়েছিলাম। একজনের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা ধার করে দালাল শফিকে দিয়েছিলাম।
মেয়েকে বিদেশ পাঠানোর পর তার সঙ্গে তেমন একটা যোগাযোগ করতে পারিনি। দালালকে বললেই
বলত, তোর মেয়ে ভালো আছে। একদিন মেয়ে আমাকে গোপনে ফোন করে তার ওপর
নির্যাতনের কথা বলে। আমি তাকে পালিয়ে দেশে আসতে বলি। মেয়ের ওপর নির্যাতনের কথা
শুনে তার চিন্তায় গত বছর আমার স্ত্রী মারা যায়। আমি গত বৃহস্পতিবার যখন
বিমানবন্দর থেকে মেয়েকে আনি তখন নিজেই চিনতে পারিনি এটা আমার মেয়ে। একটি মানুষকে
কী ভয়ঙ্করভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি
দালালদের বিচার চাই।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৯-০৪- ২০১৩
ইং
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।