অপরিসীম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার আমাদের এই পৃথিবী। আর এই সৌন্দর্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে গাছপালা-ফুল-পাখি-নদী-জল। পৃথিবীর নানা প্রান্তে জালের মতো জড়িয়ে আছে নানা নদ-নদী। কোনো কোনো নদী দেশ-কাল আর জাতির সীমা ছাড়িয়ে পেয়েছে বৈশ্বিক রূপ। এসব নদীর সৌন্দর্য যেমন যে কাউকে বিমোহিত করে, তেমনি ভৌগোলিক ভারসাম্যে এদের অবদান অনস্বীকার্য। কোনোটি ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত, তো কোনোটি আবার দৈর্ঘ্যের দিক থেকে সর্ববৃহৎ। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিখ্যাত সব নদ-নদীর গল্প পড়ুন।
উত্তরের মিসিসিপি
উত্তর আমেরিকার ড্রেনেজ সিস্টেম ব্যবস্থাপনার প্রধান নদী মিসিসিপি। যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই নদীটি প্রবাহিত হয়েছে। এর ড্রেনেজ সিস্টেম এতটাই দীর্ঘ যে, তা কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত। ড্রেনের দীর্ঘ ব্যাপকতায় আমেরিকার ৩১টি রাজ্য এবং কানাডার দুটি রাজ্য যার মধ্যে রয়েছে রকি এবং আপ্পালাচেইন পর্বতমালা। মিসিসিপি নদীটি পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে। আর বিস্তৃতির দিক দিয়ে দশম স্থানে। নদীটি মার্কিন মুলুকের মিনেসোটা, উইসকনসিন, লোওয়া, ইলিনেহিচ, মিসৌরি, কেনটাকি, টেনেসে, আরকানসাস, মিসিসিপি এবং লুইজিয়ানার মতো উল্লেখযোগ্য রাজ্য দিয়ে কিংবা অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়েছে।
নদীটির তীর ঘেঁষে বসতি আছে আদিবাসী
মার্কিনিদের। বসবাসরত আদিবাসী মার্কিনিদের
অধিকাংশের পেশা শিকার করা বা কৃষিকাজ। তবে ১৫০০ সালে নদীটির তীরে ইউরোপিয়ানদের অনুপ্রবেশ ঘটলে আদিবাসী মার্কিনিদের
জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। নদীটি
নিউ স্পেন, নিউ ফ্রান্স এবং আমেরিকা আবিষ্কারের প্রথম দিকে নদীপথে যোগাযোগ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উনিশ
শতকে পশ্চিম দিকে আমেরিকার
বিস্তৃতিতে মিসিসিপি এবং মিসৌরির মতো নদীগুলো যোগাযোগের ক্ষেত্রে ছিল খুবই কার্যকর। মিসিসিপি নদীর উপত্যকাকে ফসল
উৎপাদনের জন্য পৃথিবীর মধ্যে
অন্যতম উর্বর ভূমি বলে মনে করা হয়। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় নদীটি ইউনিয়ন নামক শক্তির হাতে চলে যায়। কারণ হিসেবে ছিল
বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে
নদীটির উপযুক্ততা। উনিশ শতকের দিকে নদীটির তীরে একদিকে যেমন শহর প্রতিষ্ঠা হয়, ঠিক
তেমনি কল-কারখানাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো গড়ে ওঠে। আর বর্তমান সময়ে উন্নতির জোয়ারে নদীটির
তীরে চাষাবাদ আর জনসংখ্যা এতটাই বেড়ে গেছে যে, তা এখন পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। বর্তমান সময়ে প্রতিনিয়তই নদীর তীরে গড়ে উঠছে নিত্যনতুন শিল্প-কলকারখানা, বসবাসের জন্য আবাসন।
আলতাই থেকে ওবি
ওবি নদীটি পশ্চিম সাইবেরিয়া আর রাশিয়ার বিখ্যাত নদী। এটি পৃথিবীর সপ্তম দীর্ঘতম নদী। সুমেরু মহাসাগরে মিলিত হওয়া সাইবেরিয়ান নদীগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এ নদীটিকে খানটি সম্প্রদায়ের লোকজন ইয়েমা আর সাইবেরিয়ান টাটারসরা উমার বলে চেনে। নদীটির দৈর্ঘ্য তিন হাজার ৪৫৯ মাইল। নদীটি সাইবেরিয়ান বিয়া এবং কাতুন নদী থেকে ২৬ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। আর এ নদীটির উৎপত্তিস্থল আলতাই পর্বতমালা। যদিও নদীটি একভাবে দীর্ঘ তবু এটির মোহনায় চায়নার বিখ্যাত এবং এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম নদী ইরথিশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
ওবির আকৃতি উত্তর এবং পশ্চিমের দিকে এঁকেবেঁকে ৫৫ ডিগ্রি বেঁকে ৬০০ মাইল দূরের কারা সমুদ্রে মিশেছে। আর ওবি-ইরিতাশ নদী দুটি একত্রে ৫,৪১০ কিলোমিটার। নদী দুটির বেসিন এলাকা দুই লাখ ৯৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। ভৌগোলিকভাবে নদীটির বেসিনগুলো তাইজা, সুয়াম্পস, তুন্দ্রা এবং সেমি ডেজার্ট। বন্যার সময় নদীটির পানিতে অনেক লেক এবং হ্রদ প্লাবিত হয়। নভেম্বরের শুরু থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত ওবি নদীর দক্ষিণাংশে অবস্থিত রারনাউল অঞ্চল বরফ আচ্ছাদিত থাকে। আর উত্তরাংশের সালেকহার্ড অঞ্চলের ১০০ মাইল পর্যন্ত অংশ অক্টোবরের শেষ থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত বরফ আচ্ছাদিত থাকে। নদীটি অনেকগুলো জলবায়ু অঞ্চল অতিক্রম করেছে। ওবি ভ্যালির উপরের অংশের দক্ষিণ দিকে আঙুর, তরমুজ জন্মে। অপরদিকে নিম্নাংশ সুমেরু তুন্দ্রা অঞ্চলে মিশেছে। প্রাকৃতিক আবহাওয়ার ভিন্নতার কারণে নদীটির তীরবর্তী অঞ্চল মানুষের বসবাসের জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয়।
সাত রাজ্যের ইয়েলো
ইয়েলো নদী বা হোয়াংহো এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী। আর পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীগুলোর মধ্যে এর অবস্থান ষষ্ঠ। নদীটি পাঁচ হাজার ৪৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। পশ্চিম চীনের কুইনঘাই রাজ্যের বায়ান হার পর্বতমালা থেকে নদীটির উৎপত্তি। ইয়েলো নদীটি চীনের সাতটি রাজ্যের অভ্যন্তরে প্রবাহিত হয়েছে। এ ছাড়া সানডং রাজ্যে অবস্থিত বোহাই সমুদ্রে পতিত হয়েছে। ইয়েলো নদীর বেসিন পূর্ব-পশ্চিমে ১৯০০ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ১১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। আর নদীটির পুরো বেসিন এলাকা সাত লাখ ৪২ হাজার ৪৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত।
ইয়েলো নদীটিকে প্রাচীন চীনা সভ্যতার সূতিকাগার বলা হয়। কারণ চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে সমৃদ্ধ অঞ্চল এটির বেসিন ওয়ে নদী উপত্যকায় পড়েছে। তবে ঘন ঘন বন্যা এবং নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় অনেকের কাছে নদীটি 'চীনের দুঃখ' বলে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীন চীনা সাহিত্যে শুধু ইয়েলো নদীকে নদী বলে আখ্যায়িত করলেও হান শাসনামলে নদীটিকে তার কাদাপানির রং হলুদের সঙ্গে মিলিয়ে ইয়েলো নদী নামকরণ করেছে। বর্তমান চীনা সভ্যতা বিনির্মাণে ইয়েলো নদীর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। এর তীরে সাম্প্রতিক সময় কৃষিকাজের পাশাপাশি শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
মিশরের নীল নদ
বিশ্বের দীর্ঘতম নদের নাম নীল নদ। যার দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার। প্রাথমিক স্তরের সমাজ বইয়ে নীল নদ ও মিসরীয় সভ্যতার ইতিহাস আমাদের সবারই জানা। নীল নদের ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে প্রাচীন মিসরের সভ্যতা। প্রতি বছর নীল নদের বন্যায় পলি পড়ে অতিমাত্রায় উর্বর হয়ে ওঠা উভয় তীরে প্রচুর ফসল হতো। এ ছাড়া খালের সাহায্যে পানি নিয়ে নীল নদের দুই তীরের দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতেও চাষাবাদ করা হতো। আফ্রিকা মহাদেশের এই নীল নদ বিশ্বের দীর্ঘতম নদীরও স্বীকৃতি পেয়েছে। এর দুটি উপ-নদ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে শ্বেত নীল নদ ও নীলাভ নীল নদ। এর মধ্যে শ্বেত নীল নদ দীর্ঘতর। শ্বেত নীল নদ আফ্রিকার মধ্যভাগের হ্রদ অঞ্চল হতে উৎপন্ন হয়েছে। এর সর্বদক্ষিণের উৎস হলো দক্ষিণ রুয়ান্ডাতে। এটি এখান থেকে উত্তরদিকে তাঞ্জানিয়া, লেক ভিক্টোরিয়া, উগান্ডা ও দক্ষিণ সুদানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নীলাভ নীল (ব্লু নাইল) নদ ইথিওপিয়ার তানা হ্রদ হতে উৎপন্ন হয়ে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে সুদানে প্রবেশ করেছে। দুটি উপনদই পরে সুদানের রাজধানী খার্তুমের কাছে মিলিত হয়েছে। নীল নদের উত্তরাংশ সুদানে শুরু হয়ে মিসরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মিসরীয় সভ্যতা প্রাচীনকাল থেকেই নীলের ওপর নির্ভরশীল।
মিসরের জনসংখ্যার অধিকাংশ এবং বেশির ভাগ শহরের অবস্থান নীল নদের উপত্যকায়। প্রাচীন মিসরের অনেক সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার অবস্থানও এখানে। কঙ্গো, তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, মিসর জুড়ে বিস্তৃত নীল নদ ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে। পৃথিবীর সব নদ-নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হলেও নীল নদ দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যের আরও একটি নদ হচ্ছে সিন্ধু। এটি দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করাচি বন্দরের পাশ দিয়ে আরব সাগরে পড়েছে। এই নদের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো বছরের নির্দিষ্ট সময় পৃথিবীর অন্যান্য নদী যখন শুকিয়ে যায় তখন নীল নদ পানিতে কানায় কানায় পূর্ণ থাকে। আর নীল নদ যখন শুকিয়ে যায় তখন অন্যান্য নদী পানিতে পূর্ণ থাকে। বিশাল ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে নীল নদ ভূমধ্যসাগরে গিয়ে মিশেছে।
জলপ্রপাতে স্নিগ্ধ পারানা
পারানা
নদীটি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত। নদীটি
ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে
এবং আর্জেন্টিনার চার হাজার ৮৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। দক্ষিণ আমেরিকার নদীগুলোর মধ্যে আমাজান
নদীর পরই পারানার
স্থান। পারানা নামটি টুপি ভাষা থেকে আগত একটি শব্দ যার, অর্থ সমুদ্রের
মতো।
নামকরণের সঙ্গে যথার্থতা পাওয়া যায় নদীটির ব্যাপকতা দেখলেই প্রথমত
নদীটি প্যারাগুয়ের নদীর সঙ্গে মিশে নিম্নমুখী প্রবাহে উরুগুয়ের নদী হয়ে
আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে। দক্ষিণ দিকে ৬১৯ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে
নদীটি প্যারাগুয়ের শহর সারাটোচ ডেল গুয়াইরার তীরে ঠেকেছে। আর এখানেই প্রাকৃতিকভাবে
সৃষ্টি হয়েছে পারানা ওয়াটার ফলস। ইতিহাসে এটি দক্ষিণাংশের
সবচেয়ে বিখ্যাত ওয়াটার ফলস বা জলপ্রপাত বলে খ্যাত। তবে ১৯৮৪ সালে
ইতাইপু ডেম নির্মাণ করা হলে জলপ্রপাতটি তার স্বকীয়তা হারিয়ে দক্ষিণ দিকে ২০০
কিলোমিটার এলাকায় প্রবাহিত হয়ে প্রাকৃতিকভাবে প্যারাগুয়ে এবং ব্রাজিলকে
বিভক্ত করেছে।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।