বিপিএলে ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে মোহাম্মদ আশরাফুলকে
সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। আজ মঙ্গলবার দুপুরে
মিরপুরে বিসিবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই সাময়িক নিষেধাজ্ঞার কথা
জানান বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান। এর আগে বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন
বোর্ড সভাপতি। গত পরশু আরেক দফা তদন্ত শেষে ঢাকা ছাড়েন আইসিসি
দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) দুই কর্মকর্তা। যাওয়ার আগে তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা
সম্পর্কে বিসিবি সভাপতিকে অবহিত করেন তাঁরা। এ নিয়ে অবশ্য মুখ খুলছিলেন না
বিসিবির কেউই। নাজমুল হাসানও আকসুর তদন্ত
প্রতিবেদন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কিছু বলতে রাজি হননি। শুধু বলেছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
মোহাম্মদ আশরাফুল |
নাজমুল জানিয়েছেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়
প্রকাশিত প্রতিবেদনে আশরাফুল নিজে আকসুর কাছে সব অপরাধ স্বীকার করেছেন বলে খবর
প্রকাশিত হয়েছে, যে খবরগুলোর প্রতিবাদ
আশরাফুল করেননি। ফলে আপাতত তাঁকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে দূরে রাখার
সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিসিবি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন আসার পর স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ
নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন নাজমুল। এবারের
বিপিএলে তিনটি ম্যাচ নিয়ে সন্দেহ আছে আকসুর। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-চিটাগং এবং ১১
ফেব্রুয়ারি ঢাকা-খুলনা এবং ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-বরিশাল—এই তিন ম্যাচে নানা অনিয়ম হয়েছে বলে আকসুর কাছে
আশরাফুল স্বীকারও করেছেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের কয়েকটি আন্তর্জাতিক
ম্যাচ নিয়েও যে আকসু তদন্ত করছে, সেটাও স্বীকার করেছেন
নাজমুল।
আশরাফুল যা বললেন
ঢাকার বনশ্রীতে তাঁর বাসায় সাংবাদিকদের ভিড় নতুন কিছু
নয়। জাতীয় দলের অনেক উজ্জ্বল মুহূর্ত জন্ম দেওয়ার পর সেই বাড়িতে ছুটে গেছেন
সাংবাদিকেরা, জেনেছেন তাঁর গর্বিত মা-বাবার
প্রতিক্রিয়া। কখনো তিনি নিজেও কথা বলেছেন। কিন্তু আজ মঙ্গলবার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক
মোহাম্মদ আশরাফুল হাজির হলেন সাংবাদিকদের সামনে। কদিনের না-কামানো দাড়িগোঁফের
আড়াল থেকে স্পষ্ট ভেসে আসছে থমথমে মুখটা। ভেতরে ভেতরে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, সেটা তাঁকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে আলোচনার
শীর্ষে তিনি। আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের (আকসু) কাছে দেওয়া তাঁর স্বীকারোক্তি
ক্রীড়াঙ্গনের চৌহদ্দি পেরিয়ে সারা দেশে সাড়া ফেলেছে। কিন্তু নিজের মুখে
প্রকাশ্যে আশরাফুল কিছুই বলছিলেন না। আজই প্রথম মুখ খুললেন তিনি। এবং শুরুতে
স্বীকার করে নিলেন সব অপরাধ। ক্রিকেটের স্বার্থে ও বিবেকের দংশনে আকসুর কাছে
স্বীকারোক্তি দিয়েছেন জানিয়ে আশরাফুল দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও চান।
নিজের
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে এই প্রথম এমন অবস্থার মুখোমুখি হলেন জানিয়ে আশরাফুল বলেন, ‘১২ বছরের ক্যারিয়ারে এই প্রথম আকসু আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ
করেছে। ১২ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছি। এই ১২ বছরে বাংলাদেশের হয়ে প্রায়
আড়াই শ ম্যাচ খেলেছি ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি
মিলিয়ে। চেষ্টা করেছি সব সময়ই আমার সেরাটা দেওয়ার। আমি যত অন্যায় কাজ করেছি, আকসুর কাছে প্রথমবারেই সব স্বীকার করে নিয়েছি।’ আকসুর কাছে কিছুই লুকাননি বলেও দাবি করেছেন তিনি, ‘আমার কাছে মনে হয়েছে, আমি কিছু অন্যায় করেছি, সেগুলোই বলার চেষ্টা করেছি। যতটুকু সম্ভব আইসিসিকে
সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। প্রতিটা ম্যাচ ধরে ধরে বলেছি। আমার ১২ বছরের
ক্যারিয়ারের সব ঘটনাই বলেছি, একটা কথাও মিথ্যা বলিনি।
সবগুলোই সত্য।’ কথা বলতে বলতে প্রায়ই ধরে
আসছিল তাঁর গলা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, এভাবে নায়কের আসন থেকে
একেবারে খলনায়ক হয়ে যাওয়াটা তিনি নিজেও যেন মেনে নিতে পারছেন না। আবেগ জড়ানো
গলায় আশরাফুল বলেন, ‘আপনারা সবাই আমাকে চেনেন
আমি কেমন। ১২ বছর ধরে খেলছি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমি কেমন মানুষ, সেটা আপনারা সবাই জানেন। আইসিসির প্রতিবেদন যেহেতু এখনো
দেওয়া হয়নি, আপনাদের অপেক্ষা করা উচিত।’
শুধু
বিপিএল নয়, আশরাফুল আকসুর কাছে বেশ
কিছু আন্তর্জাতিক ম্যাচের অনিয়ম নিয়েও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে
চাইলে তিনি বলেন, ‘সবকিছুই আমি বলেছি। আমার
ক্যারিয়ারে, আমার জীবনে অন্যায় কাজ
যতগুলো করেছি, সব স্বীকার করেছি। এখন আমি
এই বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে পারব না, যেহেতু প্রতিবেদনটা এখনো
প্রকাশিত হয়নি।’ আজই বাংলাদেশ ক্রিকেট
বোর্ডের (বিসিবি) বিশেষ সভা হয়েছে। ওই সভা শেষে দেওয়া সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির সভাপতি
নাজমুল হাসান তদন্তের পূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত আশরাফুলকে সব ধরনের
ক্রিকেট থেকে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধের কথা বলেছেন। ‘অপরাধী’ আশরাফুল সব ধরনের শাস্তি মেনে নিতে প্রস্তুত বলেই
জানালেন। কেন এভাবে নিজেকে অন্ধকার
এক জগতের সঙ্গে জড়ালেন বাংলাদেশের লাখো মানুষের নায়কটি? এর সদুত্তর মেলেনি। আশরাফুল শুধু বলেছেন, ‘ওইটা আসলে আপনাদের বোঝানো যাবে না। আমি যে খারাপ কাজগুলো
করেছি, কী অবস্থায় করেছি, ওগুলো বলে বোঝাতে পারব না। যারা এমন পরিস্থিতির মধ্যে
পড়েছে, শুধু তারাই বুঝবে।’ সবশেষে দেশবাসীর কাছে কাতরকণ্ঠে ক্ষমা চেয়েছেন, ‘আমি শুধু একটা কথাই বলব, আমাকে সবাই ক্ষমা করে
দিয়েন। আমি আসলে ক্রিকেটের ভালোর জন্যই সব সত্য কথা বলেছি। এভাবে অন্যায় করাটা
আসলে ঠিক হয়নি। জাতির সঙ্গে এমনকি আমার নিজের সঙ্গেও। আমি বিবেকের দংশনে ভুগছি। এ
কারণেই আমার মনের ভেতরে যত কিছু ছিল, সব খুলে বলেছি।’ আর কিছু না বলে বাসার ভেতরে চলে যান আশরাফুল। কে জানে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তাঁর ‘প্রস্থানে’র প্রতীকই হয়ে গেল কি না
এই চলে যাওয়া!
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।