সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: সজল কথা রাখেননি -এভারেস্ট বিজয়ী সজল খালেদ নিয়ে লেখা

সজল কথা রাখেননি -এভারেস্ট বিজয়ী সজল খালেদ নিয়ে লেখা


এভারেস্ট জয় করে না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন মোহাম্মদ খালেদ হোসেন। পরিচিত ছিলেন সজল খালেদ নামে। তৈরি করেছেন চলচ্চিত্র, লিখেছেন বই। স্বপ্ন ছিল আরও অনেক কিছু করার। এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর পর আর ফিরে এলেন না দুঃসাহসী এই তরুণ!


সুস্মিতের বাবার নাম সজল খালেদ। সুস্মিতের বয়স এখন প্রায় দুই বছর। জীবনের এই ক্ষুদ্র সময়ে সে মুখোমুখি নির্মম এক সত্যেরআর কোনো দিন বাবাকে কাছে পাবে না সে! আর কোনো দিন পারবে না বাবাকে বাবা বলে ডাকতে! ২০ মে এভারেস্ট জয় করে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন সজল। অথচ কথা ছিল, এভারেস্ট জয় করে তিনি ফিরবেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। এভারেস্টে আরোহণের জন্য সজল কাঠমান্ডু ছেড়েছিলেন গত ২৫ এপ্রিল। যাওয়ার আগে স্ত্রী তাহমিনা খানকে কথা দিয়েছিলেন, সামিট করার পর তোমাকেই প্রথম ফোন করব। তোমার আর সুস্মিতের জন্য ফিরে আসব আমি।’ সজল কথা রাখেননি! এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন তাহমিনা খান। ২৫ মে শুরু হয় সজলের মরদেহ উদ্ধারের অভিযান। কিন্তু অভিযানকারীরা বলছেন, এভারেস্টের প্রায় ২৮ হাজার ২১৫ ফুট উঁচুতে সজলের মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন নানা মত। তাহমিনা দিন গুনছেন একটা মিরাকলের আশায়এখনো হয়তো সজল বেঁচে আছেন! হয়তো এখনো তাঁর হূৎস্পন্দন থেমে যায়নি। এমন আশায় হয়তো পথ চেয়ে আছেন সজলের মা সখিনা বেগম কিংবা তাঁর বাবা আবদুল আজিজও। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন সজল। সবচেয়ে যে শেষে এসেছিল/ সে গিয়েছে সবার আগে সরে! মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার সিংপাড়া হাসারগাঁও গ্রামে জন্ম নেওয়া সজল যেন কবিতার সেই ছিন্নমুকুল! মা-বাবা এ কষ্ট কী করে ভুলবেন! যেমন কষ্ট ভুলতে পারছেন না আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের তাঁর এক বন্ধু। ব্লগে লিখেছেন, ২০০৯ সালের আগস্টের ২ তারিখ। ফেসবুকের ইনবক্সে একটি নতুন মেসেজ আর সাথে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। ম্যানিমেল তোরে চেনা চেনা লাগতেছে! আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। ১৬ বছর পর ওই বিদঘুটে নামে আমাকে সম্বোধনের সাহস করবে শুধু একজনই, এই বিকৃত নামের স্রষ্টা আমার স্কুলজীবনের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র সজল।

২.
আক্ষরিক অর্থেই বর্ণময় চরিত্রের ছিলেন সজল। আমরা এসব জানি তাঁর কাছের বন্ধুদের স্মৃতিচারণা থেকে। সজল চেয়েছিলেন ঢাকা শহরের ময়লা-আবর্জনা রিসাইকেল করতে, কুমির ও চন্দনকাঠের ফার্ম গড়ারও ঝোঁক চেপেছিল মাথায়, বিদেশগমনে ইচ্ছুক নিরক্ষর মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ আরও কত ইচ্ছা ছিল তাঁর! ঘুড়ি উৎসব হচ্ছে, সজল খালেদ আছেন। রমনা পার্ক পরিষ্কার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সজল খালেদ উপস্থিত। কিংবা দল বেঁধে হচ্ছে সাইক্লিং, ম্যারাথনসদাহাসিমুখ সজল আছেন পুরোভাগে। এমন এক বন্ধুকে কী করে ভোলা যায়! এ বছরই বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম অনূদিত বইপর্বতের নেশায় অদম্য প্রাণ। বইটিতে লিখেছিলেন এড ভিশ্চার্স নামের এক অসমসাহসী পর্বতারোহীর ১৪টি পর্বত অভিযানের গল্প। কিন্তু তাঁর নিজের অভিযানের গল্পটি যে অজানাই রয়ে গেল! বন্ধুদের জন্য যেমন ভালোবাসা ছিল তাঁর, ভালোবাসা ছিল দেশের জন্যও। এইচএসসি পাস করেন ১৯৯৫ সালে। তারপর পাড়ি জমান জার্মানিতে। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স কোলোগনেতে। পড়াশোনা শেষ করেন কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের ওপর, স্নাতকোত্তর করেন ফিল্ম স্টাডিজে। দেশে ফিরেই তৈরি করেন স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র নিয়ে তথ্যচিত্র একাত্তরের শব্দসেনা।

ছবি বানানোর পোকা তাঁর মাথায় ঢুকেছিল অনেক আগেই। নিজেকে তৈরিও করেছিলেন ছবি বানানোর ওপর পড়াশোনা করে। পড়াশোনা শেষ করার পর আরও খানিকটা সময় নিয়েছিলেন ছবি বানানো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। বলা যায়, সেটা ছিল প্রস্তুতিপর্ব। অতঃপর ২০১৩ সালে তৈরি করেন মুহম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে প্রথম ছবি কাজলের দিনরাত্রি। সরকারি অনুদানে তৈরি ছবিটি এ বছর দেখানো হয়েছিল আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে। সজল চেয়েছিলেন এভারেস্ট জয়ের পরই মুক্তি দেবেন ছোটদের জন্য বানানো কাজলের দিনরাত্রি। কিন্তু সেটা আর হলো কই! কাজলের দিনরাত্রি আছে, সজল যে নেই! সজলের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর সাদাসিধে কলামে লিখেছেন, ...আট হাজার মিটার কিংবা পঁচিশ হাজার ফুট উচ্চতায় আসলে মানুষের বেঁচে থাকার কথা না, আক্ষরিক অর্থেই এটি হচ্ছে মৃত্যু উপত্যকা। যারা বেঁচে থাকে তারা শুধুমাত্র তাদের শারীরিক আর মানসিক শক্তির জোরে নিশ্চিত মৃত্যুকে পরাস্ত করে বেঁচে থাকে। ...সজল সেটি জানত, আমরা যতটুকু জানতাম সে তার থেকে বেশি জানত। এর আগে সে হিমালয়ের অন্য চূড়ায় উঠেছে, এভারেস্টের কঠিন পথেও চেষ্টা করেছে। সবকিছু জেনেও সে এই পথে গিয়েছে, বাংলাদেশের পতাকাটি এভারেস্টের চূড়ায় উড়িয়ে এসেছে। ফিরে এসে আমাদের সেই কাহিনি বলতে পারেনিএই কষ্টটি আমরা কোথায় রাখব?

৩.
এভারেস্ট জয়ের আগে সজল বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন সিকিমের ফ্রে পর্বত (২০০৬), হিমালয়ের মেরা পিক (২০০৭), অন্নপূর্ণা রেঞ্জের সিংগুচুলি পর্বত (২০০৮), নেপালের মাকালু (২০০৯), হিমালয়ের বাংলাদেশ-নেপাল ফ্রেন্ডশিপ পিকের (২০১০) ওপরে। এ ছাড়া এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিলেন আরও একবার, ২০১১ সালের মে মাসে। তিব্বতের নর্থ ফেস ধরে সেবার উঠেছিলেন প্রায় ২৩ হাজার ফুট পর্যন্ত। কিন্তু ফুসফুসে পানি জমে যাওয়ায় নেমে আসতে হয়েছিল শেষমেশ। এভারেস্ট জয়ের এত কাছ থেকে ফিরে আসা নিশ্চয়ই মেনে নিতে পারেননি সজল। তাই ২০ মে ঠিকই এভারেস্টের চূড়ায় উড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের পতাকা। পার্বতী উপত্যকা শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সজলের। হিমালয়ের একাংশে চালানো অভিযানের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ছোট্ট একটি লেখা। একদম শেষভাগে লিখেছিলেন, পরদিন দুপুরে ক্যাম্প ত্যাগের সময় দেখি, অন্ধ্রপ্রদেশের সদ্য তরুণ ছোটকুর চোখে পানি। ভাবলাম কারও সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। ওকে দুষ্টুমি করে পেটে ঘুষি দেওয়াতে সে আমাকে ধরে চিৎকার করে কান্না শুরু করল। তখন বুঝলাম যে একসঙ্গে এত দিন থেকে এখন বন্ধুদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টেই তার এই কান্না। আমাদের সবার মনই বিষণ্ন। আবার কবে মা হিমালয়ের বুকে আসব, সেই কথা ভাবতে ভাবতেই রুকস্যাক কাঁধে আবারও পথে নামলাম।
সজল চেয়েছিলেন আবার হিমালয়ের বুকে ফিরে যেতে। সেটা তিনি গিয়েছিলেনও। সজল নিশ্চয়ই চাননি হিমালয়ের বুকেই তাঁর শেষ ঠাঁই হোক! কিন্তু সেটাই হয়েছে। এভারেস্টে আরোহণের আগে ২২ এপ্রিল স্ত্রী তাহমিনার সঙ্গে তোলা ছবি এখনো ফেসবুকে আছে। সজল সেখানে মন্তব্যের জায়গায় দুষ্টুমি করে লিখেছিলেন, আই অ্যাম লুকিং ওল্ড বিসাইড শৈলী (তাহমিনা খানের ডাক নাম)। ছবিতে সজলকে বয়সী লাগছিল না। এবং তাঁর বয়স তো আটকে রইল ৩৬-এর ঘরেই! সুস্মিতের বাবার বয়স ৩৬-এর বেশি হবে না আর কোনো দিনও!


সূত্রঃ প্রথম আলো০১ জুন ২০১৩

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।