ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ
শিক্ষা নেয় না। দুনিয়ার অনেক শাসককে এ জন্য খেসারত দিতে হয়েছে, দিতে হয়েছে চরম
মূল্য। ক্ষমতায় থাকতে যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে তাদের পড়তে হয়েছে করুণ পরিণতিতে। হতে
হয়েছে নাজেহাল ও ইতিহাসের নির্মম
শিকার। এমনকি খেসারত দিতে হয়েছে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদেরও। তাদের পতন কাহিনী এখনো নাড়া দেয়
মানুষের বিবেককে।
রেজা শাহ পাহলভি
ইরানের রাজ সিংহাসনের শেষ শাহ বা রাজা মোহাম্মদ
রেজা শাহ পাহলভি। প্রতাপশালী ও কঠিন শাসনব্যবস্থার জন্য যে ক'জন রাজা বা রাষ্ট্রনেতা ইতিহাসের পাতায়
আজো অম্লান তাদের
মধ্যে রেজা শাহ পাহলভি অন্যতম। তার জন্ম ১৯১৯ সালের ২৬ অক্টোবর ইরানের রাজধানী তেহরানে। তিনি ১৯৪১
সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিংহাসনে বসেন এবং ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের অভ্যুত্থানের
পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
ছিলেন। হাউস অব পাহলভি সিংহাসনের দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী ছিলেন। মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি একজন
রাজা হিসেবে অনেক উপাধি লাভ করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য_ হিজ ইম্পেরিয়াল
ম্যাজেস্ট্রি, শাহানশাহ আরইয়ামেহের ইত্যাদি। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধকালীন তার পিতা রেজা শাহর হাত ধরে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। শাসক হিসেবে তিনি
হোয়াইট রেভ্যুলেশন বা সাদা আন্দোলনের পথিকৃৎ। এ আন্দোলন ইরানের অর্থনীতি, আর্থ-সামাজিক এবং
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক
প্রভাব বিস্তার করে। এ ছাড়া এ সময় পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়।
দেশজুড়ে গড়ে ওঠে একাধিক শিল্প-কারখানা। একজন অসাম্প্রদায়িক মুসলিম শাসক হিসেবে
পরিচিতি পাওয়ার পর ধীরে ধীরে শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। বিশেষত আধুনিক ইরান গড়ে তোলার মনোবাসনা তার
জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়াও ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে মতের অমিল, ইসরায়েলকে
স্বীকৃতি প্রদান তার গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধা হয়ে আসে। অধিকন্তু নানাবিধ অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত, সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট তুদেহ পার্টিকে
নিষিদ্ধ ঘোষণা ইত্যাদি কার্যক্রমে তার সঙ্গে দেশের মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর দূরত্ব বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৯ সালে রাজনৈতিক
অস্থিরতা গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আর ১৯৭৯ সালের ১৭ জানুয়ারি তিনি দেশত্যাগে বাধ্য হন। এর পর
১৯৮০ সালের ২৭ জুলাই মিসরে
অবস্থানকালে ৬০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
দ্বিতীয় নিকোলাস
রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের কথা উঠলেই যার নাম সবার
আগে উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন দ্বিতীয় নিকোলাস। মূলত এই নিকোলাসের
মাধ্যমেই দীর্ঘ জার সাম্রাজ্যের সমাপ্তি ঘটে। তার জন্ম ১৮৬৮ সালের ১৮ মে। তিনিই রাশিয়ার
শেষ সম্রাট। ফিনল্যান্ডের
গ্রান্ড ডিউক এবং পোল্যান্ডের সম্মানসূচক রাজাও ছিলেন। তিনি ১৮৯৪ সাল থেকে শুরু করে ১৯১৭ সালে অসুস্থ
হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশ শাসন করেন। তার শাসনামলে রাশিয়া পৃথিবীর সুপার পাওয়ারে পরিণত
হয়। তবে তার শত্রুরা তাকে 'ব্লাডি নিকোলাস' বলে ডাকত। কারণ
বিরুদ্ধাচরণকারী রাজনীতিবিদদের নির্বিচারে
ফাঁসি প্রদান করতেন নিকোলাস। নির্বিচারে গণহত্যা করেছেন রাশিয়ার এই সম্রাট। এ ছাড়া তিনি
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে মিলিটারি ক্যাম্পেইন করতেন। তবে নিজ দেশের
স্বাধীনতার জন্য বরাবরই আপসহীন
ছিলেন নিকোলাস। এ বিষয়ে কাউকে তিনি ছাড় দেননি। তার নেতৃত্ব জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ
করে রাশিয়া। রাজ্যের শীর্ষ কর্তাব্যক্তি হওয়ায় তার অনুমতিতেই রাশিয়া ১৯১৪ সালে
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যে
যুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ রাশিয়ান আত্দাহুতি দেয়। সে সময় জনরোষের কবলে পড়েন এই সম্রাট। শেষ পর্যন্ত
সৈন্যরাও জনগণের সঙ্গে বিদ্রোহে যোগ দেয়। সংঘটিত হয় ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারির বিপ্লব। ভেঙে
দেওয়া দুমার সদস্যরা সৈন্য এবং
সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলে গঠন করেন প্রভিশনাল সরকার। আর এই সরকারই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়ায়
নিকোলাসের জীবনে। শেষ পর্যন্ত ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি এবং তার পরিবার আলেকজান্ডার প্যালেসে বন্দী হন। ১৯১৮ সালে
নিকোলাসকে স্থানীয় সোভিয়েতদের হাতে তুলে দেন তৎকালীন কমিশনার ভ্যাসিলি ইয়াকোভলেভ। ১৯১৮ সালের
১৬ অথবা ১৭ জুলাই স্ত্রী
আলেকজান্দ্রা, ছেলে অ্যালেক্স নিকোলাইভিচ, চার কন্যা, পারিবারিক চিকিৎসক, রাঁধুনিসহ
নিকোলাসকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে বলশেভিকরা।
জোসেফ স্ট্যালিন
জোসেফ স্ট্যালিন। একজন রুশ সমাজতন্ত্রী
রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯২২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট দলের কেন্দ্রীয়
কমিটির সাধারণ সচিব ছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসে ওই সময়ে স্ট্যালিনের নেতৃত্বে প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদ 'স্ট্যালিনবাদ' নামে পরিচিত। এ
মতবাদ গোটা বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দেয়। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে
উঠে আসে স্ট্যালিনবাদ।
শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সচিব হিসেবে স্ট্যালিনের ক্ষমতা সীমিত ছিল। ধীরে ধীরে স্ট্যালিন
ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে নেন এবং পার্টির নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনক্ষমতা
কুক্ষিগত করেন। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত
হওয়ার পরপর দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে তার সহযোগীরা। বিশেষ করে কুক্ষিগত করেন দেশের অর্থনীতির
চাকা। ফলে গোটা দেশে পড়ে যায় হাহাকার। শুরু হয় লুটপাট। তার শাসনামলে অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের
দরুন লাখ লাখ মানুষ
দুর্ভিক্ষে মারা যায়, যা আজো ইতিহাসের
পাতায় এক করুণ অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। ১৯৩০-এর দশকে স্ট্যালিন নিজের ক্ষমতা শক্ত করার জন্য নিপীড়ন শুরু করেন। শুরু করেন অত্যাচার।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কোনো রকম ছাড় দেননি তিনি। যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু সন্দেহে
অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। এ
ছাড়া যাদের হত্যা না করা হতো তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো সাইবেরিয়ার নির্যাতন কেন্দ্রে। এমনকি
রাশিয়ার অনেক জাতিগোষ্ঠীকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়।
ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, এই নেতা ১৫ মিলিয়ন
মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। শুধু ১৯৩২ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ৬০ লাখ মানুষ মারা যায়
সরকারি বাহিনীর অত্যাচারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে মানসিক অবসাদগ্রস্ত অবস্থা
থেকে স্ট্যালিন প্রচুর ধূমপান
করতেন। ফলে তিনি মারাত্দকভাবে শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন। ১৯৪৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অতিরিক্ত ধূমপানের
কারণে কয়েকবার হার্টঅ্যাটাক করেন তিনি। অবশেষে ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন এই নেতা।
এডলফ হিটলার
এডলফ হিটলার। তার সম্পর্কে আর নতুন করে কিছু
বলার নেই। ইতিহাসের সম্ভবত সবচেয়ে কুখ্যাত এবং আলোচিত একনায়কের নাম এডলফ হিটলার।
একনায়কতন্ত্রের জন্য ইতিহাসের পাতায় আজো উচ্চারিত হয় তার নাম। হিটলারের জন্ম ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অস্ট্রিয়ায়। অনেক মানুষ এখনো
জীবিত আছে, যারা তার
নিষ্ঠুরতার সাক্ষী। তিনি ১১ থেকে
১৪ মিলিয়ন মানুষ হত্যার জন্য দায়ী_ এর মধ্যে ছয় মিলিয়নই ছিল ইহুদি। তিনি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত
জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪
থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের ফিউরার ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তিনি সবচেয়ে বড়
খলনায়ক ছিলেন। সেই হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন।
ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণটা সব সময়ই
হিটলারের ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে কাজ করেন এবং যুদ্ধ শেষে
জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। দলের মধ্যে তিনি নিজের আসন
পাকাপোক্ত করতে থাকেন।
১৯২০ সালে এই দলের নাম পরিবর্তন করে নতুন
নাম রাখা হয় নাৎসি পার্টি। সে বছরই একটি ডানপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বার্লিনে সামরিক ক্যু করার চেষ্টা করে নাৎসিরা। কিন্তু এই
ক্যু ব্যর্থ হয়। ফলে হিটলারকে জেল খাটতে হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার
মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও
সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে থাকেন দেশবাসীর মধ্যে। এভাবেই এক সময় জনপ্রিয় নেতায়
পরিণত হন। ১৯২১ সালে তিনি নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব লাভ করেন। তার চিন্তাধারায় ছিল একটা নতুন
ওয়ার্ল্ড অর্ডার, যার নেতৃত্ব দেবে
নাৎসি জার্মানরা। ১৯২৩ সালে মিউনিখে অভ্যুত্থান করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে তাকে জেলও খাটতে
হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও
সমাজতন্ত্র বিরোধিতা ছড়াতে
থাকেন তিনি। এভাবেই এক সময় জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন হিটলার। জেল খাটার ঠিক ১০ বছর পর ভোটে
জিতে জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। ১৯৩৩ সালে তিনি জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হন।
তারই নির্দেশে নাৎসিরা তাদের
বিরোধী পক্ষের অনেককেই হত্যা করে। তিনি রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজান, সামরিক বাহিনীকে
নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করেন। সর্বোপরি একটি সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী
একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। নাৎসিবাদের প্রবক্তা ১৯৩৪ সালে নিজেকে সমগ্র জার্মানির
প্রভু হিসেবে ঘোষণা করেন। জাহির করেন নিজের ক্ষমতা। নাৎসিরা তাদের বিরোধী পক্ষের অনেককেই হত্যা করেছিল।
১৯৩৯ সালে ক্ষমতাসীন নাৎসিরা পোল্যান্ড
অধিকার করে এবং ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের অক্ষশক্তি
তথা জার্মানির নেতৃত্বাধীন শক্তি ইউরোপ মহাদেশীয় এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কিছু অঞ্চল দখল
করে নিয়েছিল। কিন্তু অবশেষে
মিত্রশক্তি বিজয় লাভ করে। ১৯৪৫ সালের মধ্যে জার্মানি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হিটলারের রাজ্য
জয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লাখ লাখ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়। হারাতে হয় ঘরবাড়ি। এককথায়
বলতে গেলে গোটা দেশ হয়ে ওঠে
শরণার্থী শিবির। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রবাহিনী যখন বার্লিন শহর দখল করে নিচ্ছিল, তখন পরাজয়
নিশ্চিত জেনে ৩০ এপ্রিল হিটলার নিজেকে গুলি করে আত্দহত্যা করেন। মৃত্যুর পর তার লোকেরা তারই নির্দেশ মোতাবেক লাশকে আগুনে জ্বালিয়ে
দেয়। এভাবেই শেষ হয় বিশ্বের সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী এক শাসকের উপাখ্যান।
ইদি আমিন
নিজেকে পৃথিবীর তাবৎ পশু ও সমুদ্রের মৎস্যকুলের
অধিশ্বর বলে দাবি করতেন। দাবি করতেন, তিনিই আধুনিক যুগের প্রেসিডেন্ট। বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে এমন হামবড়া ও বাচাল শাসকের আবির্ভাব ঘটেছিল
আফ্রিকান দেশ উগান্ডায়। যার কথা বলছি তিনি আর কেউ নন_ ইদি আমিন। বলা হয়, তিনি ছিলেন একজন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ও ফিল্ড মার্শাল। প্রাইমারি
স্কুল না ডিঙানো এই শাসক নিজেকে ডক্টরেট ডিগ্রিধারী হিসেবেও দাবি করতেন। ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি
সামরিক অভ্যুত্থানের
মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইদি আমিন। কেনিয়ায় ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহ দমনে ভূমিকা রাখেন
তিনি। এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে বার্মায় যুদ্ধও করেন। ১৯৭১ সালের
২৫ জানুয়ারি
অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উগান্ডার ক্ষমতায় বসেন ইদি আমিন। কেউ কউ বলেন, দেশের শীর্ষ সোনা এবং কফি চোরাচালান ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত
ছিলেন এই জেনারেল। ক্ষমতায়
এসে ইদি আমিন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর স্বদেশীদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এর
আগে উগান্ডার ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল মূলত ভারতীয় ও ব্রিটিশদের অধীনে। ইদি আমিন রাতারাতি তার
দেশ থেকে তাদের বের করে দেন।
ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা উগান্ডাবাসীর ওপর যে অপমানজনক ব্যবহার করেছে, ইদি আমিন নানাভাবে
তার বদলা নেন। তিনি একবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে তার জন্য জুতা সরবরাহের অনুরোধ করেন।
পালকিতে করে তিনি শ্বেতাঙ্গদের
ঘাড়ে চড়েও সুখ মেটাতেন। তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক ডজন। এক সুন্দরীকে ইদি আমিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পদে বসান। তার প্রতি প্রেসিডেন্টের কুনজর পড়লে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন। সৌদি আরবের বন্দরনগরী জেদ্দায় ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট
শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন উগান্ডার এই স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল।
মুসোলিনি
বেনিতো মুসোলিনি। ইতালির অন্যতম একচ্ছত্র
ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই শাসক। ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত শক্ত হাতে ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন তিনি।
দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা
ইতালি। তবে তাকে বলা হয় ফ্যাসিবাদের জনক। পুরো নাম বেনিতো এমিলকেয়ার আন্দ্রে মুসোলিনি। তিনি
ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ইতালির সর্বাধিনায়ক। তার নেতৃত্বেই ইতালির
সেনাবাহিনী এই যুদ্ধে ভূমিকা রাখে। মুসোলিনির জন্ম ইতালির ফোরলি শহরের একটি কামার পরিবারে। জীবনের শুরুর দিকে সৈনিক, সোশ্যালিস্ট এমনকি
স্থানীয় পত্রিকা সম্পাদনার কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। ছোট বেলা থেকেই চঞ্চল ও
ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। কিন্তু তার
প্রথম পছন্দ ছিল রাজনীতি। ইচ্ছা ছিল একটাই_ দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। আর এই স্বপ্ন খুব সহজেই ধরা
দেয় তার কাছে। যদিও অনেক চড়াই-উৎরাই
পেরিয়ে উচ্চাভিলাষী মুসোলিনি ১৯২২ সালে ন্যাশনাল ফ্যাসিস্ট পার্টি থেকে নির্বাচন করে
ইতালির ৪০তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তার বিশাল প্রশাসনিক ভবনের ওপর তিনি স্থাপন
করেছিলেন নিজের অতিকায় মুখাকৃতি।
এক কথায় তার দাপটে তটস্থ থাকতেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এর মধ্যেই দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। হিটলারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন তিনি। মুসোলিনি ১৯৪০ সালে অক্ষশক্তির পক্ষে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
যোগদান করেন। ১৯৪৩ সালে সিসিলিতে ক্ষমতাচ্যুত হলে তাকে বন্দী করা হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে জার্মান
সেনাদের কারসাজিতে মুক্তি পান মুসোলিনি। কিন্তু ১৯৪৫ সালের ২৭ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডে
পালানোর সময় ইতালির একটি ছোট্ট গ্রামে কমিউনিস্ট প্রতিরোধ বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন তিনি। এর পর দিন ১৫ সহযোগীসহ তাকে গুলি করে হত্যা করা
হয়। এরই সঙ্গে পতন ঘটে ইতালির এই একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারীর।
কিং অব লিবিয়া
মোহাম্মদ ইদ্রিস বিন মোহাম্মদ আল মাহাদি। যাকে গোটা বিশ্ব চিনে কিং অফ
লিবিয়া নামে। ক্ষমতার সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও একটা সময় নক্ষত্রের পতনের মতো
তলিয়ে যান লিবিয়ার এই রাজা।
ইদ্রিসের জন্ম ১৮৮৯ সালের ১২ মার্চ আল জাগবাব, অটোমান সাইরেনাইকাতে। ১৯৫১ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা
লিবিয়ার প্রথম এবং একমাত্র রাজা
তিনি। ইতিহাসের পরতে পরতে আজো তার কাহিনী ছড়িয়ে আছে। ছড়িয়ে আছে তার নানা বিলাসী জীবনের
বর্ণনা। এ ছাড়া লিবীয় মুসলমানদের ধর্মীয় গোষ্ঠী সেনাসসিরও প্রধান ছিলেন। সেনাসসি আন্দোলনের
প্রাণকেন্দ্র আল জাগবাব নামক
স্থানে জন্মগ্রহণকারী এ লিবীয় রাজার পিতার নাম সাঈদ মুহাম্মাদ আল মাহাদি বিন সাঈদ মুহাম্মাদ
আল সেনাসসি এবং মায়ের নাম আয়েশা বিনতে আহমেদ আল সার্থি। তার দাদা উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের
বিখ্যাত মুসলিম গোষ্ঠী সেনাসসি
মুসলিম সুফির প্রতিষ্ঠাতা। ব্রিটিশদের খুব কাছের মানুষ হিসেবে তাদের দেওয়া উপাধি আমির হিসেবে
গোটা বিশ্বে তিনি পরিচিতি পান। ১৯২২ সালের ২৮ জুলাই তাকে আমির অব ত্রিপোলিটানিয়া উপাধি দেওয়া
হয়। এই রাজা তার জীবনের প্রথম
সময়টা কাটিয়েছেন মাতৃভূমি সাইরেনাইকার স্বাধীনতার জন্য।
১৯২২ সালে ইতালিয়ান আর্মিদের লিবিয়া
অভিযানকে কেন্দ্র করে তিনি বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যুক্তরাজ্যের
পক্ষ অবলম্বন করেন। কারণ ইদ্রিস
লিবিয়ার ক্ষমতা দখলে মরিয়া ছিলেন। তিনি এবং তার সহযোগীরা মিলে জার্মানি এবং ইতালিয়ান
সৈন্যদের বিরুদ্ধে জোট গঠন করেন। এ জোটের সহযোগিতায় ব্রিটিশ অষ্টম পদাতিক সৈন্য দল উত্তর
আফ্রিকায় জার্মানি এবং ইতালিয়ান বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। আরউইন রোমেলের নেতৃত্বে এই জোট জার্মান এবং
ইতালিয়ান বাহিনীকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়। এর পর থেকেই তার উত্থান শুরু। অবশেষে বেনগাজিতে পৌঁছে
দাফতরিক সরকার গঠন করেন ইদ্রিস। ১৯৪৬
সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্যের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাজ্য তাকে অর্ডার
অব গ্রান্ড ক্রস পুরস্কারে ভূষিত করে। পরবর্তীতে তিনি পশ্চিমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে
পরিচিতি পান। ১৯৪৯ সালে ইদ্রিস
লিবিয়ার সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ১৯৫১ সালে অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। ন্যাশনাল কংগ্রেস তাকে কিং অব লিবিয়া বলে
ঘোষণা দেয়। ১৯৫১ সালের ২৪ অক্টোবর
তার নেতৃত্বে লিবিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবিভর্ূত হয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর তার
সুযোগ্য উত্তরসূরি না থাকায় ১৯৬৯ সালে তার ভাইয়ের ছেলে হাসানকে প্রিন্স হিসেবে নিযুক্ত
করেন। তবে তার জীবনের শেষভাগটা
ছিল নিদারুণ কষ্টের। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর ইদ্রিস যখন তুরস্কের হাসপাতালে চিকিৎসারত তখন একদল
সেনা অফিসার নিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন কর্নেল
গাদ্দাফি। ফলে তার রাজত্বের অবসান
ঘটে এবং রিপাবলিক অব লিবিয়ার জন্ম হয়। এ অভ্যুত্থানের খবর পেয়ে রানীকে নিয়ে গ্রিসে পালিয়ে যান
ইদ্রিস। কিন্তু বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারেননি তিনি। সেখান থেকে পাড়ি জমান মিসরে।
পরবর্তীতে মিসর থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। এর পর তোলা হয় লিবিয়ার পাবলিক আদালতে। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ইদ্রিসের ফাঁসির রায় ঘোষণা
করেন আদালত। আর এর মাধ্যমে পতন ঘটে লিবিয়ার এই রাজার।
মোহাম্মদ জহির শাহ ছিলেন আফগানিস্তানের ইতিহাসে
শেষ রাজা। পাশতুন সম্প্রদায়ের এ ক্ষমতাধর নেতার জন্ম ১৯১৪ সালের ১৫ অক্টোবর আফগানিস্তানের
রাজধানী কাবুলে। তার বাবা মোহাম্মদ
নাদির শাহ ছিলেন বারাকজাই রাজপরিবারের সদস্য এবং তৎকালীন রাজা আমানুল্লাহ খানের প্রধান সেনাপতি।
বাবার ইচ্ছামতে পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিতে ফ্রান্সে পাঠানো হয় তাকে।
দেশে ফিরে তিনি তার বাবা এবং
চাচাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনায় সাহায্য করতেন। ১৯৩৩ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি রাজা শাহ হিসেবে
সিংহাসনে বসেন। দীর্ঘ ৩০ বছর রাজ্য পরিচালনায় বলার মতো কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেননি
তিনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের
মিত্র হিসেবে ১৯৩৪ সালে তার নেতৃত্বে আফগানিস্তান লিগ অব নেশনসের সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে
তিনি চোখের চিকিৎসা করতে ইতালি যান। আর এ সুযোগে তার চাচাতো ভাই (যিনি আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন)
মোহাম্মদ দাউদ খান ক্ষমতা দখল
করে গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ১৯৮৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে
তিনি পুনরায় ক্ষমতা দখলের নীলনকশা আঁকেন। কিন্তু ইসলামিক সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা
না হওয়ায় তার পরিকল্পনা
বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০২ সালের এপ্রিলে আফগানিস্তান যখন তালেবানদের শাসনে চলে যায়, তখন পার্লামেন্ট
লয়াজিরগা চালু করতে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে মার্কিন বাহিনীর হাতে তালেবানদের
পতন হলে দেশের প্রধান হিসেবে
শাসন ব্যবস্থায় ফিরে আসতে তিনি ঘোষণা করেন_ আমি আর রাজত্ব চাই না এবং লয়াজিরগার আদর্শে দেশ পরিচালনা করব। দেশের
মানুষ আমাকে বাবা বলে ডাকে, এটাই আমার বড় পাওয়া।
তবে মার্কিনিদের প্রিয় হামিদ কারজাই ক্ষমতা গ্রহণ করলে তার স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। মোহাম্মদ
জহির শাহ ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই
পরলোকগমন করেন।
শামছুল হক রাসেল
সূত্রঃ বাংলাদেম প্রতিদিন, ১৩-০৮-২০১৩
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।