পাখির
বিশ্রাম আর আশ্রয়ের জন্য গাছে গাছে বাঁধা মাটির কলস। রাস্তার দুই ধারে সবুজ গাছের সারি।
পথচারীদের বিশ্রামের জন্য পথের ধারে বেঞ্চ। দেয়ালে দেয়ালে লেখা মনীষীদের উপদেশবাণী। এসবই দেশের আর সব ইউনিয়ন থেকে
ঝিনাইদহের কুমড়াবাড়িয়াকে
আলাদা করেছে। এসব করেছেন দরিদ্র একজন মানুষ, জহির রায়হান। নিজের লাগানো গাছের নিচে নিজেরই হাতে গড়ে দেওয়া বেঞ্চে পথচলতি
ক্লান্ত মানুষকে বিশ্রাম
নিতে দেখে আপ্লুত হন জহির রায়হান। এই জহির রংমিস্ত্রির কাজ করে যা আয় করেন, তার ৫০ শতাংশ খরচ করেন
সমাজের কল্যাণমূলক কাজে। নিজের সংসার কষ্টে চললেও হতদরিদ্র তিন শিক্ষার্থীর পড়ালেখার খরচ দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রতিবন্ধীদের বাড়িতে
নিজ খরচে তৈরি করে দিচ্ছেন ফলদ ও বনজ বাগান।
ঝিনাইদহের কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের
রামনগর গ্রামের দরিদ্র কৃষক মৃত কিয়াম উদ্দিন মোল্লার ছয় সন্তানের মধ্যে ছোট
জহির (৪০)। আর্থিক অনটনে লেখাপড়া করতে পারেননি। মাত্র আট বছর বয়স থেকে তিনি মাঠে ছাগল-গরু চরানোর কাজ শুরু
করেন। এ সময় মাত্র
দু-তিন মাস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। পরে আবার নৈশ বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ালেখা করেন।
একটু বড় হওয়ার পর তাঁকে পরের জমিতে কামলার কাজ করতে হয়েছে। এখন মানুষের বাড়িঘর রং করার কাজটাই তাঁর পেশা। এ থেকে
মাসে গড়ে ১০ হাজার
টাকা আয় করেন। কৃষিজমি নেই। ৫ শতক জমির ওপর তাঁর বাড়ি। স্ত্রী শাহনাজ বাড়িতে সেলাইয়ের
কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকার মতো আয় করেন। ছেলে তপু (১৫) দশম শ্রেণীতে ও মেয়ে সুমাইয়া (৭) শিশু শ্রেণীতে পড়ে।
যেভাবে
শুরু:
১৯৯০ সালের শুরুর দিকে এক
দিন
গ্রামের জিল্লুর, এনামুল, সৌরভসহ কয়েকজনের সঙ্গে বসে
গল্প করছিলেন জহির।
সেখানে দেশের মানুষের জন্য তাঁরা কী করছেন বা করতে পারছেন, তা নিয়ে কথা হচ্ছিল। জহিরের মনে
হলো আসলেও তো কিছুই করা হয়নি। ওই আড্ডার মাস দুয়েক পর জহির শুরু করেন দেয়াল লিখন ও বৃক্ষরোপণ। সারা দিন অন্যের
বাড়িতে কাজ করে বিকেলে
যেটুকু সময় পেতেন, রং-তুলি
নিয়ে ছুটে যেতেন দেয়াল লেখার কাজে।
দেয়ালের
মালিকের অনুমতি নিয়ে বিভিন্ন মনীষীর বাণী লিখতেন।
জহির
জানালেন, দু-তিন
মাস এভাবে গাছ লাগানো আর দেয়াল লেখার পর পড়ে যান আর্থিক সংকটে। গাছের চারা আর রং কেনা কষ্টকর হয়ে
পড়ে। কিন্তু কাজ
থামাতে রাজি নন তিনি। এ সময়ই স্ত্রী শাহনাজের সঙ্গে পরামর্শ করেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ঠিক
করেন, বাকি
জীবনে যে টাকা আয় করবেন, তার
অর্ধেক সমাজের
কল্যাণে খরচ করবেন। জহির দুঃখ করে বলেন, শুরুতে একবার ছন্দপতন ঘটেছিল তাঁর কাজে। পয়সা খরচ করে দেয়াল
লিখতেন, কিন্তু
মানুষ সেগুলো মলমূত্র দিয়ে ঢেকে
দিত।
মানুষ বলাবলি করত, জহির
নিজেই পড়ালেখা জানে না, তাঁর
লেখা আমাদের পড়তে হবে? এভাবে প্রায়ই লেখাগুলো
মুছে দেওয়া হতো। তাঁর লাগানো গাছগুলো উপড়ে ফেলা হতো। এসব কারণে মনে কষ্ট নিয়ে সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু বেশি দিন
বসে থাকতে পারেননি। ২০০২ সালের পর আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে আর থামেননি।
তাঁর
যত কাজ:
জহিরের ১৯৯০ সালের দিকে রোপণ করা গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে। নগরবাথান বাজার থেকে শুরু করে কুমড়াবাড়িয়া, রামনগর, ডেফলবাড়িয়াসহ পার্শ্ববর্তী
গ্রামগুলোর রাস্তা দিয়ে হাঁটলেই
গাছগুলো চোখে পড়ে। বকুল, মেহগনী, নিম, অর্জুন, জলপাই, আমড়া, আম, জাম, কাঁঠালসহ বিভিন্ন প্রজাতির
গাছ লাগিয়েছেন তিনি। পথচারী শরিফুল ইসলাম বলেন,
কুমড়াবাড়িয়া
ইউনিয়নের রাস্তাগুলো আজ সবুজের ছায়ায় ঘেরা। জহির বলেন, একসময় চিন্তা হয় গাছ
লাগিয়ে পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি
অসহায় মানুষের কাজে কীভাবে তা লাগানো যায়। সেই চিন্তা থেকে রামনগর গ্রামের প্রতিবন্ধী সুমন
মিয়া, একই
গ্রামের ময়না খাতুন, ধোপাবিলা
গ্রামের বাদশা
মণ্ডল, কনোজপুর
গ্রামের এনামুল ইসলামসহ আট প্রতিবন্ধীর বাড়িতে ৪০-৫০টি করে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগিয়ে দিয়েছেন।
জহির এ
পর্যন্ত ৬০০ দেয়ালে মনীষীদের বাণী লিখেছেন। প্রথম দিকে অনেকগুলো মুছে দিলেও বর্তমানে যেগুলো লিখছেন তা দেয়ালে
দেয়ালে শোভা পাচ্ছে।
কুমড়াবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাহাজ উদ্দিন বলেন, ‘জহিরের এই লেখা বাণীগুলো
অনেকেই পড়ছেন। শিক্ষণীয় এসব কথা
মানুষের
মন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে।’
স্বামী-স্ত্রীর
আয়ের অর্ধেক ব্যয় করেন সমাজের কাজে। বাকি টাকায় কষ্ট করে সংসার চালান জহির। এ অবস্থার মধ্যে তিনটি
মেধাবী শিক্ষার্থীর
পড়ালেখার খরচ চালান তিনি। তারা হলো কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের আরিফ হোসেন, ধোপাবিলা গ্রামের সোহাগ
হোসেন ও কনেজপুরের জেসমিন আক্তার। এদের তিনজনকে এইচএসসি পর্যন্ত পড়ার খরচ দেবেন তিনি। এখন মাসে এই
তিনজনের জন্য তাঁর
এক হাজার ৫০০
টাকা খরচ হয়। জেসমিনের মা মর্জিনা বেগম জানান, স্বামী
হায়দার
আলী তাঁদের মা-মেয়েকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এরপর আশ্রয় মিলেছে বাবার বাড়িতে। তিনি
গৃহপরিচারিকার কাজ করে খরচ চালান। এ অবস্থায় মেয়েকে পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না।
জহির
জানান, প্রচণ্ড
রোদের মধ্যে একদিন নগরবাথান থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন মনে হয়েছিল একটু ছায়া পেলে বিশ্রাম নিতে পারতেন।
কিন্তু ধু ধু
চরাচর। বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা নেই। তাই নগরবাথান-কুমড়াবাড়িয়া সড়কের ইটভাটার কাছে ২০০২ সালে
নির্মাণ করেন বিশ্রামাগার। সেখানে গাছ লাগিয়ে বসার চেয়ার তৈরি করে দেন। একইভাবে তিনি রামনগর ও ডেফলবাড়িয়া গ্রামে
আরও দুটি বিশ্রামাগার
তৈরি করে দিয়েছেন। নগরবাথান
বাজার পার হয়ে কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে ঘুরলে চোখে পড়বে বড় বড় গাছের ডালে মাটির কলস। জহির এই কলস
বেঁধে তৈরি করে দিয়েছেন
পাখির বাসা। নগরবাথান বাজারের পাশে একটি বটগাছে বাঁধা আছে ছয়টি মাটির কলস। যার একটির
মধ্যে পাখি বাসা বেঁধেছে।
তাঁকে
নিয়ে অন্যরা:
কুমড়াবাড়িয়া ইউনিয়ন
পরিষদের
(ইউপি) চেয়ারম্যান হায়দার আলী অকপটে জহিরের এসব কাজের প্রশংসা করলেন। ‘সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও
নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন জহির। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক সব এলাকায়
থাকলে সমাজের অনেক
উন্নয়ন হতো।’ জহিরের
স্ত্রী শাহনাজ বলেন, স্বামীর
জন্য গর্ববোধ করেন তিনি। সংসারে
কষ্ট
রয়েছে, কিন্তু
সেটা মানিয়ে নিয়েছেন। ছেলে তপু বলেন, সমাজের জন্য বাবা কিছু করছেন ভেবে ভালো লাগে। যে কারণে এমন কোনো আবদার করেন না, যা বাবা দিতে পারবেন না।
সূত্রঃ প্রথম আলো, নভেম্বর
২৩, ২০১৩
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।