অতিরিক্ত ওজন শরীরের জন্য ভালো নয়। এর কারণে দেখা দেয় নানা রকমের সমস্যা। আজকাল অনেকেই ওজন কমানোর জন্য
অস্ত্রোপচার করিয়ে থাকেন। কিন্তু
বিষয়টি পুরোপুরি না বুঝে বা অস্ত্রোপচার করানোর পর সচেতন না থাকার কারণে বিপত্তিও
কম ঘটে না। এই যেমন: বাংলাদেশের
শফিউদ্দিন মাহমুদ নামের এক আবাসন ব্যবসায়ী কলকাতায় গিয়েছিলেন ওজন কমানোর
অস্ত্রোপচার করাতে। কলকাতার এক
নার্সিং হোমে ২০ কেজি ওজন কমানোর পর হোটেলে ফিরে তিনি মারা যান (সূত্র: প্রথম আলো, ১১ এপ্রিল)। আবার পপ তারকা আদনান সামির কথা মনে করুন। বিশালদেহী জনপ্রিয় এই সংগীতশিল্পী অস্ত্রোপচার করিয়ে ১৩০ কেজির
মতো ওজন কমিয়ে দিব্যি সুস্থ আছেন। (সূত্র:
আস্ক ডটকম) তবে
অস্ত্রোপচার করে যদি ওজন কমাতেই হয়, তাহলে জেনে নিতে হবে এর আগে ও পরে কী করতে হবে। অতিরিক্ত ওজন হলেই অস্ত্রোপচার করবেন
কি না, ঠিক কখন
অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন পড়বে, কোন
শারীরিক অবস্থায় এটি নিরাপদ আবার অস্ত্রোপচারের পর কী নিয়ম মানতে হবে, খাদ্যাভাস কী হবে—সবকিছু সম্পর্কে জেনে-শুনে তবেই ওজন
কমাতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
কখন বুঝবেন ওজন বেশি?
শরীরের ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম বা বেশি কি না, তা জানার জন্য বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) জানতে
হবে। আপনার ওজন যত কিলোগ্রাম, সেই সংখ্যাকে মিটার এককে আপনার উচ্চতার
বর্গ দিয়ে ভাগ করলেই হিসাব বের করতে পারবেন। বিএমআই ১৮ দশমিক ৫-এর নিচে থাকলে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম ধরা হয়। ১৮ দশমিক ৫ থেকে ২৩ দশমিক ৫-এর মধ্যে থাকলে সেটি স্বাভাবিক। বিএমআই ২৩ দশমিক ৫-এর চেয়ে বেশি, কিন্তু ২৮ দশমিক ৫-এর কম হলে বুঝতে হবে
ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। এর চেয়েও বেশি হলে
তাকে বলা হয় স্থূলতা। বিএমআই কমবেশির হিসাবের ওপর নির্ভর করে
স্থূলতাকেও বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়। মনে রাখতে হবে, ওজন বেশি থাকলেই কিন্তু অস্ত্রোপচার করা
জরুরি নয়।
ওজন কেন বাড়ে?
অতিরিক্ত খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করার কারণেই মূলত
ওজন বেড়ে যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজানা কারণে এবং
বিশেষ কোনো ওষুধের প্রভাবেও বাড়তে পারে ওজন। অস্ত্রোপচার করার আগে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার।
স্থূলতার জটিলতা
স্থূল ব্যক্তিদের গড় আয়ু সমবয়সী অন্যদের চেয়ে ১৫ বছর কম হয়ে
থাকে। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতেও অসুবিধা হয়। রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। তাঁদের ক্যানসারের ঝুঁকিও বেশি থাকে। লিভারেও চর্বি জমে যেতে পারে এবং সেখান থেকে সমস্যা হতে পারে।
নিয়ন্ত্রণে থাক ওজন
ওজন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মূলত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও
শারীরিক পরিশ্রম করা উচিত। জীবনযাপনের পদ্ধতি
বদলিয়ে ওজন কমানো সম্ভব। এ পর্যন্ত কোনো ওষুধ সঠিকভাবে ওজন কমাতে
পারেনি। তবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ওজন কমানো যায়। এর নাম ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি। তবে আজকাল একে মেটাবলিক সার্জারি বলা হয়। নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য এ অস্ত্রোপচার করা হয় বলে এই
নামকরণ।
কাদের জন্য প্রযোজ্য
যাঁদের বিএমআই ৩৩ দশমিক ৫-এর বেশি, তাঁদের যদি স্থূলতার পাশাপাশি অন্য কোনো
সমস্যা থাকে, যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, দুই হাঁটুতে গেঁটে বাতের জন্য ব্যথা বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস
নিতে অসুবিধা থাকে, তখন এই অস্ত্রোপচার করতে হবে। আর কারও যদি
বিএমআই ৩৮ দশমিক ৫-এর বেশি হয়, তাহলে তাঁর স্থূলতা ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা না থাকলেও এটি প্রয়োজন। সাধারণত ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত এ অস্ত্রোপচার করা হয়। তবে বয়স এর চেয়ে কম বা বেশি হলেও অনেক সময় এটি করা যেতে
পারে।
কেন করা হয় এই অস্ত্রোপচার
অস্ত্রোপচার করানোর তিন বছরের মধ্যে ৮৬ শতাংশ রোগীর
ক্ষেত্রে তাঁদের আগের ওজনের ৮০ শতাংশকমে যায়। রোগীর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট থাকলে এই সময়ের মধ্যে সেগুলোও
নিয়ন্ত্রণে আসবে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে সন্তান ধারণে
সমস্যা হলে সেই সমস্যা দূর হয়ে যায়।
কী করা হয় অস্ত্রোপচারে?
ল্যাপরোস্কোপিক স্লিভ গ্যাস্ট্রেকটমি অস্ত্রোপচারে
পাকস্থলীর কিছু অংশ ফেলে দেওয়া হয়। আর ল্যাপরোস্কোপিক
গ্যাস্ট্রিক বাইপাস অপারেশনে পাকস্থলী থেকে অন্ত্রের যে অংশ বেশ খানিকটা দূরে
অবস্থিত, সেই অংশের সঙ্গে পাকস্থলীকে জুড়ে দেওয়া হয়।
কোনো জটিলতা হতে পারে কি?
যেকোনো অস্ত্রোপচারেই কিছু সমস্যা হতে পারে। ব্যারিয়াট্রিক সার্জারিও তার ব্যতিক্রম নয়। পাকস্থলী বা অন্ত্রের যেখানে সেলাই দেওয়া হয়, সেখানকার সেলাইয়ের কোনো অংশ খুলে যেতে
পারে। এ ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময়ে
নিতে হয় বিশেষ যত্ন। রোগীকে এ সময় এই বিশেষ যত্নের জন্য
হাসপাতালের হাই ডিপেনডেনসি ইউনিটে রাখতে হয়। এ রোগীরা তাঁদের শারীরিক অবস্থার কারণে বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন, তাই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেওয়া
উচিত। সার্জন, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, অন্তক্ষরাগ্রন্থি বিশেষজ্ঞ আর ডায়েটেশিয়ান তো থাকবেনই।
আবার ল্যাপরোস্কোপিক গ্যাস্ট্রিক বাইপাস অপারেশনের পরে কখনো কখনো ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব হতে পারে।
আবার ল্যাপরোস্কোপিক গ্যাস্ট্রিক বাইপাস অপারেশনের পরে কখনো কখনো ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব হতে পারে।
অস্ত্রোপচারের পর
স্লিভ গ্যাস্ট্রেকটমি করার পর রোগী চাইলেও বেশি তেল-মসলাযুক্ত
ভারী খাবার বেশি খেতে পারবেন না। তবে আইসক্রিম বা
কোমল পানীয় বেশি পরিমাণে খাওয়ার প্রবণতা থাকলে এসব খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে
হবে। তা না হলে অস্ত্রোপচার করেও ওজন কমবে না। রোগী সাধারণত অস্ত্রোপচারের ২৪ ঘণ্টা পর থেকে মুখে খাবার
খেতে পারেন। তখন তিনি অবশ্যই আগের চেয়ে পরিমাণে কম
খাবেন। তবে খাবার খেতে হবে তিন-চার ঘণ্টা পর পর। রাতে অবশ্য একটানা ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা যেতে পারে। অস্ত্রোপচারের পর প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৪০০ ক্যালরি গ্রহণ
করতে হবে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ গ্রহণ করতে হবে শর্করা থেকে, আমিষজাতীয় খাবার থেকে ২০ শতাংশ এবং স্নেহজাতীয় খাবার থেকে
বাকি ২০ শতাংশ গ্রহণ করতে হবে। এক গ্রাম শর্করা
থেকে চার ক্যালরি, এক গ্রাম আমিষ থেকে চার ক্যালরি ও এক গ্রাম স্নেহজাতীয় খাবার থেকে নয় ক্যালরি
শক্তি পাওয়া যায়। এই হিসাব অনুযায়ী খাবার তালিকা তৈরি করতে
হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে এবং
ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। অস্ত্রোপচারের
পর চিকিৎসক ও ফিজিওথেরাপিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু ব্যায়াম করা যেতে পারে। কারণ, শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রত্যেক রোগীর জন্য ব্যায়ামের ধরন হবে আলাদা। অস্ত্রোপচারের পর অন্য কোনো অসুবিধা না থাকলে রোগীকে সাঁতার
কাটা ও সাইকেল চালানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
যাঁদের জন্য অস্ত্রোপচার প্রযোজ্য নয়
হূদেরাগী বা যাঁদের ঘুমের মধ্যে শ্বাস নিতে খুব বেশি সমস্যা
হয় আর যাঁদের কোনো শারীরিক সমস্যার জন্য সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার করা
যাবে না, তাঁদের জন্য নয় এসব অস্ত্রোপচার। লাইপোসাকশন
আর ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি এক নয় লাইপোসাকশন হলো শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অংশ থেকে মেদ সরিয়ে ফেলা। এটি একটি কসমেটিক সার্জারি, এটি ব্যারিয়াট্রিক সার্জারির কোনো অংশ নয়।
শেখ মোহাম্মদ আবু জাফর
ব্যারিয়াট্রিক সার্জন
অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগ
বারডেম জেনারেল হাসপাতাল
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।