ছেলের জন্য মায়ের নির্ঘুম রাত কাটানোর খবর এটি নয়। ছেলের জন্য রাত জেগে অপেক্ষায় থাকা কোনো মায়ের গল্পও নয়। এই মা রাত জাগেন ছেলের পড়া তৈরি করে দিতে। তবে তা অন্য মায়েদের মতো নয়। তিনি প্রতি রাতে ক্লান্তিহীনভাবে সশব্দে ছেলের পাঠ্যবইয়ের প্রতিটি বাক্য পড়ে যান। আর তা রেকর্ড হয় মুঠোফোনে। দৃষ্টিশক্তিহারা ছেলের পড়া রেকর্ড হয় মায়ের স্বরে-সুরে। মুঠোফোনের ওই রেকর্ড মন দিয়ে শোনেন ছেলে। এটাই তাঁর পড়ার একমাত্র উপায়। মা-ছেলের অনবদ্য এই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান আবদুল্লাহ আল শাইম। আর সাধারণ এক নারী চায়না খাতুন হয়ে ওঠেন অদম্য মা।
মায়ের তৈরি করা পড়ার রেকর্ড শুনেই এবার কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার পিপলস ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছেন আবদুল্লাহ। তিনি পরীক্ষা দিয়েছেন শ্রুতিলেখকের সহায়তায়। আবদুল্লাহ জন্মান্ধ ছিলেন না। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম তিনি বুঝতে পারেন তাঁর দুই চোখেই সমস্যা হচ্ছে। কোনো কিছুই ভালো করে দেখতে পেতেন না। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ভাত-বস্ত্রের সংস্থানই ঠিকমতো হয় না তাঁদের। কিন্তু চোখের সমস্যা দিনে দিনে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আবদুল্লাহ চিকিৎসকের কাছে গিয়েছেন ঠিকই, তত দিনে তাঁর দুচোখ প্রায় দৃষ্টিশূন্য হয়ে গেছে।
আবদুল্লাহর বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার গোবরগাড়া গ্রামে। তাঁর বাবা মনিরুল ইসলাম কৃষিকাজ করে সংসারের খরচ মেটান। মা চায়না খাতুন গৃহিণী। একমাত্র বোন স্থানীয় ডিজিএম হাইস্কুলে পড়ে। সংসার খরচ চালানোর জন্য তাঁদের সহায়-সম্বল বলতে আছে আড়াই বিঘা জমি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় আবদুল্লাহকে চক্ষুচিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে ওই যাওয়া পর্যন্তই! অর্থকষ্টের কারণে তাঁর যথাযথ চিকিৎসা আর হয়ে ওঠেনি। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, আবদুল্লাহর দুচোখ ‘রেটিনাইটস পিগসোনটোসা’ রোগে আক্রান্ত। ঢাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক বর্তমানে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা (মেডিকেল অফিসার) আবদুল্লাহ হেল আজম বলেন, এটি জেনেটিক (বংশগত) রোগ। এর কারণে দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। রোগী রাতের বেলা একদমই দেখতে পায় না। এই রোগের ভালো চিকিৎসাও নেই। এই রোগের কারণে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাওয়া ব্যক্তির চলাফেরাসহ স্বাভাবিক জীবন যাপনের জন্য লো ভিশন এইড (অতি ক্ষীণ দৃষ্টির অধিকারী ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক বিভিন্ন উপকরণ) নিতে পারে। প্রায় অন্ধ অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা দিতে হয় আবদুল্লাহকে। পরীক্ষার হলে টেবিলের দুপাশে দুটি টেবিলল্যাম্প জ্বেলে কোনো রকমে পরীক্ষা শেষ করেন তিনি। প্রশ্নই ঠিকমতো পড়তে পারতেন না তিনি। মন ভেঙে দেওয়া সেই পরীক্ষার কথা আজও ভুলতে পারেননি আবদুল্লাহ। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৪ পেয়ে পাস করেন তিনি। ফল ঘোষণার পর আবদুল্লাহর পরিবার শেষ চেষ্টা হিসেবে কুষ্টিয়া থেকে তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরও দু-তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেন তাঁরা। শেষমেশ আবদুল্লাহকে নেওয়া হয় ফার্মগেট এলাকার ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতাল ও ইস্পাহানী ইনস্টিটিউট অব থালমোলোজিতে। তত দিনে তিনি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন।
ঢাকা থেকে ফেরার পর আবদুল্লাহর পরিবার কুষ্টিয়া শহরের একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে যোগাযোগ করে। সেখানে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া হয়। তবে সেখান থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে হলে তাঁকে শহরে থাকতে হতো। সেই খরচ তাঁর পরিবারের পক্ষে মেটানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি আবদুল্লাহর আগ্রহ দেখে ওই স্কুলের কর্মকর্তা এনামুল হক (বর্তমানে প্রয়াত) তাঁকে ক্যাসেটে পড়া রেকর্ড করে তা শোনার পরামর্শ দেন। এই পদ্ধতি তাঁর ভালো লাগলে শ্রুতিলেখক দিয়ে তিনি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারবেন বলে তিনি জানান। পরে বাড়িতে ফিরে তাঁর মায়ের পরামর্শে মুঠোফোনেই পড়া রেকর্ড করে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন আবদুল্লাহ। লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ ছিল আবদুল্লাহর মা চায়না খাতুনেরও। তবে হাজার প্রতিকূলতা পেরিয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ে গেছেন তিনি। নিজের অপূর্ণতা পূরণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন দুই ছেলেমেয়েকে। মায়ের আশা পূরণে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন আবদুল্লাহও। ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হননি তিনি।
পিপলস ডিগ্রি কলেজের উপাধাক্ষ্য আবু সাঈদ মো. আজমল হোসেন জানান, এবার তাঁর কলেজ থেকে ২৭৮ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে শুধু আবদুল্লাহই জিপিএ-৫ পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হলেও নিয়মিত ক্লাস করার পাশাপাশি ক্লাসে মনোযোগী থাকত সে। এ ছাড়া কলেজের নির্বাচনী পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম হয় সে। এ কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ তার বেতন মাফ করে দেয়। তার পরীক্ষার আবেদনপত্র জমা দেওয়ার (ফরম ফিলাপ) টাকাও দেয় কলেজ।’ মা চায়না খাতুন বলেন, ‘দৃষ্টি হারানোর পরও আবদুল্লাহ কখনো মনোবল হারায়নি। সারা দিন সংসারের কাজ শেষ করে রাতের বেলায় মুঠোফোনে পড়া রেকর্ড করে দিতাম। পরে সেটা শুনে আবদুল্লাহ আয়ত্ত করত। ওর স্মৃতিশক্তি খুব ভালো। দু-একবার শুনলেই পড়া আয়ত্ত করে নিতে পারত। পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে সে।’ ছেলের সাফল্য চায়না খাতুনের গর্বে বুক ভরে যায় সত্যি। তবে এর আড়ালে বিষাদও আছে। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে পড়ার খরচ আর সংসার খরচ চলবে কীভাবে? বাড়িতে দুটি গরু ছিল। একটা গরু ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ওই টাকা দিয়ে ছেলেকে কোচিং করাচ্ছেন। কিছু টাকা রেখে দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফরম কেনার জন্য। প্রতিদিন মায়ের সঙ্গেই কোচিংয়ে যান আবদুল্লাহ। কোথায় উচ্চশিক্ষা নিতে চান জানতে চাইলে আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়া। আর মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষকতা করতে চাই।’
সূত্রঃ প্রথম আলো, ১৮:৩০, আগস্ট ২০, ২০১৪
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।