পরনে সালোয়ার-কামিজ। চোখে চশমা। মাথায় ঘোমটা টানা। আধপাকা চুলের খানিকটা এসে পড়েছে মুখের ওপর। সেই মুখটা হাসি হাসি। মালেকা জয়নাব তাকিয়ে আছেন বাড়ির বসার ঘরে শোকেসে রাখা ‘বুকের ধনে’র ছবির দিকে। এই ছবিটায় নাকি জাদু আছে। ছবির দিকে তাকালেই তাঁর ক্ষয়ে যাওয়া স্নায়ু সচল হয়। একটু করে হলেও খুলে যায় বন্ধ কথার অর্গল। কথা বলতে চেষ্টা করেন। অস্ফুট কণ্ঠে শুধু দুটি শব্দ শোনা যায়, ‘আমার ছেলে’। যাঁর ছবি নিয়ে মায়ের এমন উচ্ছ্বাস, তিনি ক্রিকেটার মুমিনুল হক। কী, চিনতে পেরেছেন কোন মুমিনুল? আমাদের ‘পকেট ডায়নামো’। যাঁর ঝুলিতে জমা পড়ছে রেকর্ডের পর রেকর্ড। টেস্টে ব্যাটিং গড়ে সারা বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান তাঁর। এখন সামনে শুধু ডন ব্র্যাডম্যান। আদর্শ ব্যাটসম্যানের যত গুণ, এর প্রায় সবটাই মুমিনুলের মধ্যে দেখেন বোদ্ধারা। শান্ত, দৃঢ়চেতা। বাজে শট খেলে আউট নেই বললেই চলে। আর সেই মুমিনুলের সবটা জুড়ে তাঁর মা। তিনি খেলেন মায়ের জন্য। কারণ, মুমিনুল রান করলে মা খুশি হন, হাততালি দেন। এইটুকু চাওয়া এখন মুমিনুলের পরিবারের সবার। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর থেকে মা শয্যাশায়ী ছিলেন প্রায় আড়াই বছর। ছেলে মুমিনুলের খেলাই তাঁকে আবার সচল করছে। তাঁর স্নায়ু কাজ করছে কিছুটা হলেও। কিন্তু এমন কীভাবে হলো মুমিনুলের মা মালেকা জয়নাবের? দুঃসহ স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন বাবা নাজমুল হক।
আচমকা বিপদ
দিনটি ছিল ২০১১ সালের ১০ নভেম্বর। ‘এ’ দলের হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে যাওয়া মুমিনুলের সঙ্গে রাতে কথা বলে খুশি মনেই ঘুমোতে যান মালেকা। ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় নাজমুল হকের। পাশে দেখেন কোনো নড়চড় নেই তাঁর স্ত্রীর। ডাকলেন। কোনো সাড়া নেই। নিথর দেহ। বুঝলেন বিপদ। পাশের ঘর থেকে ডেকে তুললেন বড় ছেলে শাওনকে। দ্রুত পৌঁছালেন পাশের আল নূর হাসপাতালে। চিকিত্সক সব দেখে যা বললেন, তাতে আকাশ ভেঙে পড়ল মাথায়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়েছে। অবস্থা সংকটজনক। চিকিত্সক বললেন, আর দেরি নয়, এখনই রওনা হন ঢাকায়। কী করবেন বাবা-ছেলে! সিদ্ধান্ত হলো ঢাকায় নিয়ে যাবেন তখনই। এরপর সোজা অ্যাপোলো হাসপাতাল। এদিকে মুমিনুল তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। তখনো তাঁকে জানানো হয়নি মা অসুস্থ। কারণ, তাঁর খেলায় প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু চিকিৎসার খরচ মিলবে কীভাবে?
শেষে শাওন ও নাজমুল ঠিক করলেন জায়গা বিক্রি করবেন। এর মধ্যে কেটে গেল ১৪ দিন। মালেকা তখনো হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। মুমিনুল দেশে ফিরলেন। মায়ের অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তখন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড়দের নিলাম চলছে। বরিশাল বার্নার্সে ডাক পড়ল মুমিনুলের। ব্যস, আর জায়গা বিক্রি করতে হলো না। বন্ধ হলো না মায়ের চিকিত্সা। পাক্কা দুই মাস পর মায়ের অবস্থার কিছুটা উন্নতি। তবে তিনি হারিয়ে ফেললেন কথা বলার শক্তি। অবশ হয়ে গেল এক পাশ। বিছানায় পড়লেন। এরপর মুমিনুল ডাক পেলেন জাতীয় দলে। সেই খবর শুনে আশ্চর্য পরিবর্তন হতে থাকল মায়ের। দুই হাত তুলে বিছানা থেকেই দোয়া করলেন। মুমিনুল পেলেন একের পর এক সাফল্য। এদিকে মায়ের অবস্থারও উন্নতি। মুমিনুলের খেলা মাকে আবার জাগিয়ে তুলছে। মা এখন, কথা বলার চেষ্টা করেন। হাঁটাচলাও করছেন কয়েক মাস ধরে।
শখের ব্যাট চুলার আগুনে
ছেলে পড়ালেখা ছেড়ে ক্রিকেটার হবে—মা সেটা ভাবতেই পারতেন না। কিসের ক্রিকেট, কড়া শাসন। কোনো খেলা নয়। আগে পড়া। শিক্ষিকা মায়ের চোখরাঙানিতে মুখে কিছু বলতেন না মুমিনুল। তবে ব্যাট-বল ছাড়েন নি। স্কুল ছুটির পর মাঠে ক্রিকেট। তারপর ঘরে। এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষায় এক বিষয়ে ফল খারাপ হলো। মা গেলেন রেগে। শেষে ব্যাট নিয়ে দিলেন চুলার আগুনে। মা বললেন, ‘আর ব্যাট হাতে যেন না দেখি।’ এবার শুরু হলো লুকিয়ে লুকিয়ে খেলা। ব্যাট-বল আর ঘরে আনা চলে না। ভাই শাওনও ক্রিকেট খেলেন। ফলে দুজন মিলে মাকে ফাঁকি দিয়ে খেলা চালিয়ে যান। মা কোনো কিছুই টের পান না। তবে বাবা ঠিকই জানতেন।
মা যখন টের পেলেন, তখন জল গড়িয়েছে অনেক দূর। এর মধ্যে কক্সবাজারে আসা বিকেএসপির (বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) দলের সঙ্গে মুমিনুল এক মাস অনুশীলন করে বাহবা কুড়িয়েছেন। বিকেএসপির কোচ নাজিম তাঁকে ঢাকায় নিয়ে যেতে ডেকে পাঠালেন মা-বাবাকে। এবার কী করবেন মুমিনুল? আবার এগিয়ে এলেন বাবা ও বড় ভাই। মাকে বোঝালেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে গেলেন ঢাকা বিকেএসপিতে। কিন্তু প্রথমবার ফিরে আসতে হলো কম উচ্চতার জন্য। এ জন্য ঢাকা থেকে আসার পথে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট থেকে দুই হাজার ৬০০ টাকায় বাবা কিনে দিলেন সাইকেল। শুরু হলো উচ্চতা বাড়ানোর সংগ্রাম। পরের বছর আবার বিকেএসপিতে। এবার উতরে গেলেন। বিকেএসপিতে শুরু হলো ক্রিকেটজীবন। সময়টা ২০০৪ সাল।
মুমিনুল মাঠে, বাবার পায়চারি
মুমিনুল যখন মাঠে ব্যাট করেন, তখন বাবা বসে খেলা দেখতে পারেন না। পান খান আর পায়চারি করেন। কারণ, তিনি প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় থাকেন। এই বুঝি ছেলে আউট হয়ে গেলেন। ফিফটি কিংবা সেঞ্চুরি হলে তবেই টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসেন। এর আগে শুধু বাড়ির অন্যদের কাছ থেকে খবর নেন। অবশ্য মা, ভাই আর ছোট বোন মুমু টেলিভিশনের সামনে বসেই দেখেন খেলা।
নাজমুল হক বলেন, ‘ছেলের খেলা থাকলে আমি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করি। যেন আমার ছেলেটা ভালো করতে পারে।’
বৈদ্যেরঘোনার আলো
১৯ নভেম্বর, দুপুর ১২টা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে সোজা বৈদ্যেরঘোনা। আগের রাতেই কথা হয়েছে মুমিনুলের বাবার সঙ্গে। আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। দোতলা বাড়ির নিচের তলায় বসার ঘরে আমাদের বসতে দিলেন। ঘরের পুরোটাই জুড়ে আছেন মুমিনুল। শোকেস ঠাসা মুমিনুলের বিজয়স্মারকে। এর মাঝখানে কৈশোরের সারল্যমাখা মুমিনুলের ছবি।
মুমিনুল মায়ের জন্য খেলেন—এ কথা মনে করিয়ে দিতেই মায়ের চেহারায় যেন দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল। হয়তো অনেক কিছু বলতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
মুমিনুলের বাবা বলেন, ‘প্রতিদিন রাতে সে একবার ফোন করে। প্রথমেই খোঁজ নেয় মায়ের। মা কী করছে। খাওয়াদাওয়া করেছে কি না। এরপর আমাদের খবর। তার কাছে মা-বাবা সবার আগে। বাকি সব পরে। আমি দোয়া করি, আমার ছেলে আরও এগিয়ে যাক।’
বাড়িতে সদ্য একজন নতুন অতিথি এসেছে। বড় ভাই শাওন পুত্রসন্তানের বাবা হয়েছেন। ছেলের নাম রেখেছেন মাহী বীর হক। সেই নামটি মুমিনুলের দেওয়া। এখন বাড়ি এলে খুব একটা বের হন না। নতুন এই অতিথিকে নিয়েই সময় কাটে তাঁর। আর বাড়ি এলে ভাবির হাতের খিচুড়ি, বিরিয়ানি ও পুডিং বেশ প্রিয় মুমিনুলের। এ ছাড়া মা সুস্থ থাকা অবস্থায় ‘খেজুড়ি’ নামের একটি পিঠা না হলে তাঁর চলত না। পাড়ার লোকজনেরও মুমিনুলকে নিয়ে গর্বের শেষ নেই। মুমিনুলের খেলা মানে এখানে উত্সব। তিনি সেঞ্চুরি করলে মিছিল বের হয়। বড় পর্দায় তাঁর খেলা দেখার জন্য প্রায়ই ভাড়া করে আনা হয় প্রজেক্টর। কোনো কাজের জন্য কেউ দেখতে না পরলে অন্যজনের কাছ থেকে খবর নেন, আজ মুমিনুলের স্কোর কত? এভাবেই সবার হৃদয়জুড়ে আছেন তিনি। মুমিনুলের বাড়ি এলাম আর তাঁর সঙ্গে কথা বলব না। তাই কি হয়? কিন্তু মুমিনুলকে যে ফোনে পাওয়াও দায়। তিনি আছেন চট্টগ্রামে। খেলা নিয়ে ব্যস্ত। রাতের বেলা ভাই শাওনের মাধ্যমে কথা হলো মুমিনুলের সঙ্গে। ফোনের ওপাশে মুমিনুল বলছিলেন, ‘আম্মা আমার হৃদয়জুড়ে আছেন। আমি ভালো খেললে আম্মা খুব খুশি হন। যেটা ভালো খেলে স্কোর করার মতোই আমাকে আনন্দ দেয়। আর কক্সবাজারের মানুষের ভালোবাসা আমাকে প্রেরণা জোগায়। তাই সব সময় চিন্তা থাকে রান করতেই হবে। আমিও ব্যাট চালাই। খেলি দেশ, পরিবার, কক্সবাজারের মানুষ—সবার জন্য।
সহযোগিতায় আব্দুল কুদ্দুস,নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।