বলা
হয়ে থাকে, আগামী
দিনের পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কারা নেতৃত্ব দেবেন তা জানতে হলে ফোর্বস ম্যাগাজিনে চোখ রাখাই
যথেষ্ট। ২০১৫ সালের অনূর্ধ ৩০ বছর বয়সী বাছাই ৩০ জনের নাম প্রকাশ করেছে
ফোর্বস। জানুয়ারি ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত এ তালিকায় নিজের জায়গা করে
নিয়েছেন বাংলাদেশি
বংশোদ্ভূত মিনহাজ চৌধুরী। তিনি
ড্রিংকওয়েল (www.drinkwellsystems.com)
নামের
সামাজিক উদ্যোগের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
সম্প্রতি ঢাকা সফরে এেল ‘স্বপ্ন নিয়ে’ তাঁর মুখোমুখি হয়; জানা হয় তাঁর স্বপ্ন আর স্বপ্নপূরনের আদ্যপান্ত। বিশুদ্ধ বাংলায় কথা শুরু করেন মিনহাজ, ‘৯ জানুয়ারি ফোর্বস
ম্যাগাজিনে প্রথম যখন নিজের নাম দেখতে পাই, পানি চলে
আসছিল
চোখে। নিজেকে কখনো উদ্যোক্তা হিসেবে সারা
বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পারব, তা ভাবিনি আমি।’ বিশ্বের
এক হাজার উদ্যোক্তা আর ৬০০ উদ্যোগের মধ্য থেকে মিনহাজ স্থান করে নিয়েছেন বিশ্বসেরাদের কাতারে। এখানেই শেষ নয়।
মিনহাজের
আছে আরো অর্জন। ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টার্টআপ
জ্যাকপট প্রতিযোগিতায়
মিনহাজ ও তার ড্রিংকওয়েল প্রকল্প প্রথম স্থান অধিকার করে।
ওই
বছরই সাউথওয়েস্ট ইকো অ্যাওয়ার্ডসের প্রফিট সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। সিলিকন ভ্যালিতে অবস্থিত দ্য টেক
মিউজিয়াম অব ইনোভেশনের
টেক অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইন্টেল করপোরেশন ড্রিংকওয়েল সিস্টেমসকে
বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে।
২০১২
সাল থেকেই ড্রিংকওয়েলের
কাজ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ছুটে বেড়াচ্ছেন মিনহাজ। তিনি বলেন, আমি চাই বাংলাদেশেও
প্রতিষ্ঠা পাক এই স্বপ্ন।’ হ্যঁ, ড্রিংকওয়েলকে চালু করতেই
মিনহাজ এসেছিলেন বাংলাদেশে। ইউএসএইেডর
সহযোগিতায় এরই মধ্যে মানিকগঞ্জে পরীক্ষামূলক প্রকল্পে বেশ সাফল্য পেয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জ, কুমিল্লা আর যশোরের অর্ধশত গ্রামে ড্রিংকওয়েল
প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের বিশুদ্ধ পানি সমস্যা দূর করতে চান তিনি। ইতিমধ্যে
তাঁর এ প্রকল্প সাফল্য পেয়েছে
ভারত, নেপাল, লাওস ও কম্বোডিয়ায়। পশ্চিমবঙ্গের ১৫০ জায়গায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের কাজ
করছে ড্রিংকওয়েল। এছাড়া
নেপাল, লাওস, কম্বোডিয়ার ২০০ গ্রামে
প্রায় ২০ লাখ মানুষ সরাসরি ড্রিংকওয়েলের কাছ থেকে বিশুদ্ধ পানির সুবিধা পাচ্ছে।
২০১২
সালের এপ্রিল মাসে ব্যবসার মডেল
হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করেন মিনহাজ ও তাঁর দল। মিনহাজের
স্বপ্নের সহযোদ্ধা হিসেবে
আছেন অরুপ সেনগুপ্ত, মাইক
জার্মান ও সঞ্জয় ভার্মা। সরলভাবে ড্রিংকওয়েল সম্পর্কে কি
কোনো ধারণা দেওয়া সম্ভব?
উত্তরে
মিনহাজ বলেন, গ্রামে
গ্রামে পানি বিশুদ্ধকরণ প্রযুক্তি ও গ্রামের মানুষের কাজের সুযোগ তৈরির ব্যবসায়িক ধারণা
দেয় ড্রিংকওয়েল। ড্রিংকওয়েল
সিস্টেম অরুপ সেনগুপ্ত
উদ্ভাবিত পানি শোধনের বিশেষ এক পদ্ধতির নাম। এই
পদ্ধতিতে পানি বিশুদ্ধকরণের
প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর চেয়ে ৬০ গুণ বেশি পানি উৎপাদন
সম্ভব হয়। এ ছাড়া ১৭ গুণ বেশি জ্বালানিসাশ্রয়ী
উপায়ে এই পানি সরবরাহ করে
ড্রিংকওয়েল। প্রধানত, কারিগরি সহায়তা দেয় ড্রিংকওয়েল। গ্রামবাসী যে টাকা দিয়ে পানি কেনে তা
প্লান্ট রক্ষণাবেক্ষণেই ব্যয় হয়।
শেকড়
বাংলাদেশে
বাংলাদেিশ বংশোদ্ভূত মার্কিন এ
নাগরিকের শেকড় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। মিনহাজের
জন্ম যুক্তরাষ্ট্রের
টেক্সাসের ডালাসে। বাবা
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার চৌধুরী
আহমেদ
ও মা নাজনীন আহমেদ দুজনে তরুণ বয়সে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। বাবা যন্ত্রকৌশল বিষয়ে পড়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে।
উদ্যোগের
শুরুটা বাংলাদেশে
মিনহাজ স্কুলের পড়াশোনা শেষে জন
হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে স্নাতকে ভর্তি হন। ২০০৯ সালে
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশে আসেন মিনহাজ ও তাঁর বন্ধু পল ববলিৎজ। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের গোলাইডাঙা
গ্রামের নলকূপের
আর্সেনিকদূষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন মিনহাজ। গ্রামের
মানুষকে বিশুদ্ধ পানি
সরবরাহের জন্য ১০০ সনোফিল্টার স্থাপন করেন সেই গ্রামে। কাজ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তিনি। পরের দুবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা
নিয়েই বেশি
ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ২০১১ সালে
স্নাতক সম্পন্ন করে ফুলব্রাইট বৃত্তির আওতায় তিনি আবার বাংলাদেশে আসেন। এবার তিনি ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। মানিকগঞ্জের সেই গ্রামে গিয়ে দেখেন
মাত্র তিনটা সনোফিল্টার কাজ
করছিল। বিনা পয়সা পাওয়া সনোফিল্টারগুলো
গ্রামের মানুষের অবহেলায় নষ্ট
হয়ে
গিয়েছিল। কীভাবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
করা যায় তার উপায় খুঁজতে
থাকেন মিনহাজ। এবং
ড্রিংকওয়েল ২০১২
সালে ভারতে ফুলব্রাইট স্কলারদের
এক সম্মেলনে মিনহাজ তাঁর ধারণা তুলে ধরেন। গ্রামের
মানুষের পানির জন্য
অর্থ ব্যয় করার উপায় সৃষ্টি করলেই এমন সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে মিনহাজ ধারণাকল্প তৈরি
করেন। সেই সম্মেলনে কলকাতার গবেষক অরুপ
সেনগুপ্তের এক
কর্মসূচির কথা জানতে পারেন মিনহাজ। মিনহাজ
জানান, ‘ভারতের
পশ্চিমবঙ্গেও আর্সেনিক
ভয়ানক এক সমস্যা। গবেষক
সেনগুপ্ত ২০০৪ সাল থেকে ‘উত্তর ২৪
পরগনা’ জেলার
অশোকনগর গ্রামে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ এক কর্মসূচি পরিচালনা করছিলেন। মিনহাজের চিন্তার সঙ্গে সেনগুপ্তের
চিন্তা মিলে যায়। এরপর
মিনহাজ যৌথভাবে ড্রিংকওয়েল প্রতিষ্ঠা করেন অরুপ সেনগুপ্ত, মাইক জার্মান ও সঞ্জয় ভার্মাকে
নিয়ে।
ফোর্বস
ম্যাগাজিনে মিনহাজ
মিনহাজ
চৌধুরী, ২৫ সহ-প্রতিষ্ঠাতা, ড্রিংকওয়েল বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের লক্ষ্য
নিয়ে ড্রিংকওয়েলের যাত্রা শুরু। বাংলাদেশ
ও ভারতে পানিতে
আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড দূষণের শিকার প্রায় ২০ কোটি মানুষদের জন্যই ড্রিংকওয়েলের কাজ। ড্রিংকওয়েলের সরবরাহ করা পানি ৪০ শতাংশ
কম দামে ও ৬০ ভাগ
বেশি পানি সরবরাহ করে। ড্রিংকওয়েল
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পানি বিক্রির সুযোগ দেয়,
যা
লভ্যাংশ স্থানীয় উদ্যোক্তাদেরই থাকে। আট
হাজার মার্কিন ডলার
দামের ড্রিংকওয়েল ফিল্টার প্ল্যান্ট বর্তমানে বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, লাওস ও নেপালের ২০০ জায়গায়
বিশুদ্ধ পানি পরিবহন করছে। —ফোর্বস, জানুয়ারি ২০১৫
সূত্রঃ প্রথম আলো, ০০:৩১, জানুয়ারি ২৫, ২০১৫
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।