‘ছিলাম পাড়াগাঁয়ের অ্যানালগ মেয়ে, এখন আমি ডিজিটাল। বিশ্ব এখন আমার হাতের মুঠোয়। ইন্টারনেটে
প্রতিদিন বিশ্ব ভ্রমণ করি।’ এমন কথা বলতেই পারেন রেবেকা খাতুন। মেহেরপুর সদর উপজেলার
কুতুবপুর ইউনিয়নের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ২৫ বছর বয়সী এই নারী। কম্পিউটার,
ইন্টারনেট, ডিজিটাল ক্যামেরা ইত্যাদি ব্যবহার
করে গ্রামের মানুষকে দেন তথ্যপ্রযুক্তির নানা রকম সেবা।
সারা
দেশে সাড়ে চার হাজারের বেশি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে। সেগুলোর প্রতিটিতে
আছেন দুজন করে উদ্যোক্তা—একজন নারী ও একজন পুরুষ। গত মাসে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড আয়োজনে
দেশের সাত বিভাগের সাতটি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার পায় ‘আইসিটি পুরস্কার’। এর মধ্যে একটি কুতুবপুরের
এই কেন্দ্র। আর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে ঢাকায় বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের
‘ইন্সপায়ারিং গ্রাসরুট
এন্টারপ্রেনার’ পুরস্কার গ্রহণ করলেন রেবেকা খাতুন। এর একদিন পর ৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশনের (এটুআই) শ্রেষ্ঠ নারী উদে্যাক্তার পুরস্কার
পেলেন রেবেকা। জানালেন এই দুই পুরস্কার তাঁর জন্য বড় স্বীকৃতি হিসেবে কাজ করবে।
গল্পটার
শুরু ১০ টাকা দিয়ে
ডিজিটাল
সেন্টারগুলোর নাম প্রথমে ছিল ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র। ২০১১ সালের নভেম্বরে
এগুলো চালু হয়। ‘শুরুর দিকে দিনে ১০ টাকা আয় করে বাড়ি ফিরতে হয়েছে। এখন
মাসে ১৩ থেকে ১৫ হাজার টাকা আয় করি।’ বললেন রেবেকা খাতুন। এই আয় হয় অনলাইনে জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি
করে, পরীক্ষার ফলাফল, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি
ও নানা কিছুর তথ্য দিয়ে।
বড় হয়ে
চাকরি করার ইচ্ছা ছিল রেবেকার। তবে বাবা মহিউদ্দিন আহমেদের ইচ্ছা ছিল মেয়েকে
কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ানোর। তাই তাঁকে লেখাপড়ার পাশাপাশি কম্পিউটার শেখার তাগাদা
দিতেন। এসএসসি পরীক্ষার আগে বাবা কম্পিউটার কিনে দেন রেবেকাকে। ‘কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়ার
ইচ্ছা তখন উঁকি দিচ্ছিল। এসএসসিতে ফলও করি ভালো।’ কিন্তু এ সময় হঠাৎ করেই মারা যান রেবেকার
বাবা। সংসারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে রেবেকার কাঁধে।
ঘুরে দাঁড়ালেন রেবেকা
মেহেরপুর
সরকারি কলেজে এইচএসসি পড়ার সময় ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ড)
তৈরির কাজ শুরু হয়। সেনাবহিনীর সহায়তায় তখন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর হিসেবে সেই
প্রকল্পে যোগ দেন। ওই কাজ করে তাঁর ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। এর মধ্য দিয়েই নতুন মোড়
নেয় রেবেকার জীবন। সিদ্ধান্ত নেন কম্পিউটার বিজ্ঞানী না হলেও ইন্টারনেট হবে তাঁর
স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম। কেননা, এ কাজে কোনো
আদেশ–নির্দেশ নেই। সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং যত মেধা, যত শ্রম, তত আয়।
ডিজিটাল
হয়ে ওঠা
প্রথমে
ঘরে বসে ইন্টারনেটে বিভিন্ন কাজ করে কিছু কিছু আয় হতে থাকে রেবেকার, যা দিয়ে লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চালাতে হতো। ২০১১ সালে
মেহেরপুর সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। গ্রামে চালু হয় ইউনিয়ন ডিজিটাল
সেন্টার।
নারী
উদ্যোক্তা হিসেবে রেবেকা যোগ দেন সেখানে। শুরুর দিকে দিনে মাত্র ১০ থেকে ২০ টাকা
হতো। কিন্তু হাল ছাড়েননি। কিছুদিনের মধ্যে গ্রামবাসীকে ইন্টারনেটমুখী করতে
পারলেন। লোকজন বিদেশে কথা বলা শুরু করল তাঁদের কেন্দ্র থেকে। চাকরি ও ব্যবসার
আবেদনপত্র, ই-মেইল করা চলতে থাকল।
জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুসনদসহ বিভিন্ন কাজে ডিজিটাল সেন্টারে
মানুষের আসা–যাওয়া বাড়তে থাকল। আর উদ্যোক্তা হিসেবে রেবেকা ভালোই আয়
করতে থাকলেন। জানালেন, এখন প্রতিদিনই
বাড়ছে তাঁর আয়।
রেবেকার
মা জান্নাতুল নেছা বললেন, ‘পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে রেবেকা ছোট। বাকিদের
আলাদা আলাদা সংসার হওয়ায় রেবেকাই আমাদের অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।’ রেবেকা যে শুধু
নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন কিংবা ভালো আয় করছেন তা নয়, রেবেকার
কাজে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা। সাধারণ মানুষের কাছে জরুরি তথ্য
পাওয়াটাও হয়েছে সহজ। কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ইদ্রিস আলী বলেন,
রেবেকা ই-সেবা দিয়ে ইউনিয়নবাসীকে যেমন ইন্টারনেটমুখী করেছেন,
তেমনি তাঁর সুবাদে ইউনিয়ন পরিষদ দেশের সেরা ই-সেবাকেন্দ্রের সুনাম
অর্জন করেছে।
স্বপ্ন
এখন সবাইকে নিয়ে
ইন্টারনেটে
কাজ করে রেবেকা ২০১৩ সালে মেহেরপুর জেলায় শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তার পুরস্কার পান। ২০১৪
সালে জাতীয় পর্যায়ে সেরা নারী উদ্যোক্তার পুরস্কারও পেয়েছেন। ডিজিটাল কেন্দ্রে
উদ্যোক্তার পাশাপাশি তিনি মুক্ত পেশাজীবী (ফ্রিল্যান্সার) হিসেবে ইন্টারনেটে
আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন সেই কুতুবপুরে বসেই। রেবেকা খাতুন জানান, নিজে যেমন করছেন, তেমনি আউটসোর্সিংয়ের
কাজ শেখাচ্ছেন স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের। আর তা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমেই।
এখন রেবেকার স্বপ্ন—‘নিজে এলাকাটাকে আমি ডিজিটাল পল্লি হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।’
সূত্রঃ প্রথম আলো
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।