বাংলাদেশে রেলের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই
প্রথম। ট্রেন চালু
করে নেমে গিয়েছিলেন চালক। এরপর চালক
ছাড়াই চলল যাত্রীবাহী ট্রেন। তা–ও গেল পেছন দিকে, ২৬ কিলোমিটার। গতকাল রোববার সকালে রাজবাড়ীতে ঘটেছে এ
ঘটনা। এ ঘটনায়
ট্রেনের চালক মোহাম্মদ আলীসহ পাঁচজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া রেলের পাকশী বিভাগীয় প্রকৌশলী (ডিএন-১)
আবু জাফর মিয়াকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান
করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পরে গতকাল দুপুরে রাজবাড়ীতে রেলওয়ের রেস্টহাউসে
রেলের তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হন চালক মোহাম্মদ আলী। তবে তিনি ঘটনার কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন জানা যায়নি। রাজবাড়ী রেলস্টেশন মাস্টার কামরুজ্জামান জানান, ফরিদপুর
এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি ফরিদপুরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাজবাড়ী রেলস্টেশনে অপেক্ষারত
ছিল। ট্রেনটি সকাল
৮টা ১০ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু
সাতটা ৫৭ মিনিটে উল্টো দিকে (কুষ্টিয়ার দিকে) চলতে শুরু করে। চারটি রেলস্টেশন পার হয়ে ২৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর ৯টা ৫ মিনিটে
পাংশা উপজেলার বাবুপাড়া রেলসেতুর কাছে যাওয়ার পর ট্রেনটি থামানো হয়। ছয়টি বগিযুক্ত ট্রেনে এ সময় প্রায় ৩৫ জন
যাত্রী ছিলেন।
ফরিদপুর এক্সপ্রেসে কর্মরত ট্রেনের টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি ট্রেনের ভেতরে ছিলেন। প্রথমে ভেবেছিলেন ইঞ্জিনের পানি আনার জন্য ট্রেনটি পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু পানি নেওয়ার জায়গাটি পার হওয়ার পরও যখন ট্রেন পেছন দিকে চলতে থাকে তখন তাঁর মনে হয়, বুঝি কোনো সমস্যা হয়েছে। সূর্যনগর রেলস্টেশন পার হওয়ার পর থেকে তিনি শিকল টেনে ট্রেনটি থামানোর চেষ্টা শুরু করেন। ক্রসিংগুলো পার হওয়ার সময় সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টাও করে যাচ্ছিলেন। এ সময় ট্রেনের যাত্রীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চেঁচামেচি শুরু করেন। কোনো কিছুতে কাজ না হওয়ায় তিনি ট্রেনের ভ্যাকুয়াম বক্স খুলে বাতাস বের করে দেন। এরপর এক ঘণ্টা পরে ট্রেনটি থামানো সম্ভব হয়। পরে সকাল সাড়ে নয়টায় ট্রেনটি আবার রাজবাড়ীর উদ্দেশে ছেড়ে এসে ১০টা ৩৫ মিনিটে রাজবাড়ী রেলস্টেশনে পৌঁছায়।
এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে চালক মোহাম্মদ আলীসহ মোট পাঁচজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। অন্যরা হলেন সহকারী চালক ফয়সাল আহমেদ, পরিচালক সুভাষ চন্দ্র শর্মা এবং অ্যাটেনডেন্ট মোয়াজ্জেম হোসেন ও আনিসুর রহমান। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেন ছাড়ার ৪৫ মিনিট আগে চালক ও সহকারী চালককে ইঞ্জিনে অবস্থান নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। আর গার্ডের (পরিচালক) অবস্থান নেওয়ার কথা ৩০ মিনিট আগে। কিন্তু গতকাল ট্রেনটি উল্টো পথে চলার সময় চালক, সহকারী চালক ও পরিচালক কেউ ট্রেনে ছিলেন না। সূত্র আরও জানায়, চালক ও সহকারী চালক ইঞ্জিনটি চালু করে যে বগি নিয়ে চলার কথা, তাতে ইঞ্জিন জুড়ে দিয়ে জায়গা ট্রেন রাখাও হয়। রেলের আইন হচ্ছে চালু করে যাত্রার জন্য লাইনে দাঁড় করানোর পর আর ইঞ্জিন বন্ধ করা হয় না। এ সময় চালক ও সহকারী চালক সার্বক্ষণিক ইঞ্জিনে অবস্থান করবেন। পরবর্তী সময়ে অন্য চালক ও সহকারী চালককে বুঝিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁদের তত্ত্বাবধানে থাকবে। কিন্তু গতকাল চালক ও সহকারী চালক একসঙ্গে নেমে যান। পরে তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন যে চা খেতে নেমেছিলেন। এ সুযোগে কেউ একজন ইঞ্জিন কক্ষে ঢুকে পেছন দিকে চলার সুইচ টিপে দেয়।
ওই সূত্র জানায়, জরুরি ভিত্তিতে থামানোর জন্য পরিচালকের কক্ষেও ‘ব্রেক’ আছে। এটি দিয়ে ট্রেনটির পেছন দিকে চলা থামানো সম্ভব ছিল। কিন্তু পরিচালক কক্ষে না থাকায় সেটাও সম্ভব হয়নি। পরিচালক স্টেশনেই ছিলেন। তাঁর প্রয়োজনীয় মালামালসহ বাক্সও ট্রেনে তোলা হয়েছিল। কিন্তু পরিচালক দায়িত্ব মেনে ট্রেনে অবস্থান করেননি। রেলের কর্মকর্তারা জানান, চালক ছাড়াই ট্রেন উল্টো পথে চলার তথ্য দ্রুত নিয়ন্ত্রণকক্ষে পৌঁছে দেয় স্টেশন কর্তৃপক্ষ। তখন একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে ট্রেনের কয়েকটি বগি লাইনচ্যুত করে থামানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু এর মধ্যেই টিটি ট্রেন থামাতে সক্ষম হন। ফলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যায় ট্রেনটি। রেলওয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এ ঘটনাকে তাঁরা এখনই নাশকতার চেষ্টা মনে করছেন না। এটি দায়িত্বে অবহেলা বলেই তাঁদের ধারণা। রাজবাড়ী লোকো কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ উপসহকারী প্রকৌশলী বিজয় কুমার ঘোষ জানান, ট্রেনের চালক মোহাম্মদ আলী রেলওয়েতে যোগ দেন ১৯৮৩ সালে। ৩ এপ্রিল তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বদলি হয়ে রাজবাড়ীতে আসেন। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক রফিকুল ইসলাম খান জানান, ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আসাদুজ্জামান কবীরকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।