সম্ভাবনার অপার দিগন্ত
জিঞ্জিরার হালকা
প্রকৌশল শিল্পের মাধ্যমেই পূরণ হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আকাশছোঁয়া স্বপ্ন।
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আর দেশীয় কারিগরদের দক্ষতাসহ আন্তরিক উদ্যম মিলিয়ে জিঞ্জিরা হয়ে
উঠতে পারে বাংলাদেশের চীন-জাপান। বর্তমানে জিঞ্জিরাকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কারখানাগুলো থেকে
বছরে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এখানে উৎপাদিত অনেক পণ্যই দেশের
চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা
দূরে থাক উল্টো 'নকলবাজ' নামের দুর্নামের সিলমোহর মারা এই 'ইঞ্জিনিয়ারদের' কপালে। অথচ
সহযোগিতা দেওয়া গেলে এই জিঞ্জিরা হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের চীন-জাপান।
রাজধানীঘেঁষা
কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা এলাকায় ছোট-বড় দুই হাজার কারখানা থাকলেও দেশজুড়ে একই আদলের শিল্প-কারখানা
গড়ে উঠেছে ৪০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি (বাইশিমাস) সূত্রে
জানা যায়, দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের হালকা প্রকৌশল শিল্পে বছরে টার্নওভার প্রায়
৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় আড়াইশ কোটি টাকারও বেশি। এর সঙ্গে
প্রত্যক্ষভাবে ৬ লাখ কর্মীসহ পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৬০ লাখ লোকের ভাগ্য। জিঞ্জিরার আগানগর,
বাঁশপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার বাসাবাড়িতে গোপনে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট কারখানা, যেখানে
ফ্লাঙ্, ওয়াটার হিটার, শ্যাম্পু, সাবান, আফটার শেভ লোশন, ত্বকে ব্যবহারের ক্রিমসহ বিদেশি
জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের নকল পণ্য তৈরি হয়। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কিছুদিন আগেও চীন, জাপান,
কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের যন্ত্রাংশের একচেটিয়া দখল ছিল বাংলাদেশের বাজার। অল্প দিনের
মধ্যেই জিঞ্জিরায় তৈরি যন্ত্রাংশ সেই স্থান পূরণ করে চলছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি
অনুমোদন না পাওয়ার কারণে নিজেদের তৈরি মূল্যবান সব যন্ত্র-সরঞ্জামাদির গায়েও মেড ইন
চীন, জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নামে সিলমোহর মেরে তা বাজারজাতে বাধ্য হন তারা।
জিঞ্জিরা শিল্প নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক) পরিচালক
ড. ইহসানুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, জাপান, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত
সব দেশই শুরুতে হালকা প্রকৌশল খাতে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রতিবেশী
ভারত ও পাকিস্তানে টাইম বাউন্ড ভিশন ডকুমেন্ট পর্যন্ত প্রণয়ন করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে
সমন্বিত উদ্যোগ না নেওয়ায় 'নকলবাজ' দুর্নামের সিলমোহরেই আটকে আছে জিঞ্জিরা শিল্পের
আকাশছোঁয়া সম্ভাবনা। ড. ইহসানুল করিম বলেন, হালকা প্রকৌশল শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকার
প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই ৫০ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি
হবে।
কী হয় না জিঞ্জিরায়?
জিঞ্জিরায় তিনটি
পৃথক এলাকায় তৈরি করা পণ্যের নামানুসারে তিনটি স্থান আছে। যেখানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন
কারখানা। তাওয়াপট্টিতে আছে ছোট-বড় প্রায় ৭০০ হালকা শিল্প-কারখানা আর এখানে মূলত তৈরি
হয় গ্রিল, তালা, ছাতার জালা, কব্জা, পাওয়ার প্রেস, কেলাম, শিট, প্লেঞ্জার, কয়েল, ওয়াশার,
নাট-বল্টু, স্ক্রু, তারকাঁটা, তোপকাঁটা, বালতি, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, কড়াই
ইত্যাদি। টিনপট্টিতে তৈরি হয় টিন, শিট, কয়েল। এখানে ১৫-২০টি কারখানা আছে। তবে এর বাইরেও
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সেকেন্ডারি শিট মজুদ এবং গোপনে ঢেউটিন তৈরির
কাজ করে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো করোগেশন মেশিনে দিন-রাত আমদানিকৃত জিপি শিট কেটে ঢেউটিন
তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে।
বিদেশি ব্র্যান্ডের
মধ্যে পেনটিন প্রো-ভি, হেড অ্যান্ড শোল্ডারস, গার্নিয়ার, রিজয়েস, ডাভ, সানসিল্ক, অলক্লিয়ার
শ্যাম্পু, ডাভ সাবান, জনসন বেবি লোশন, সাবান, ইম্পেরিয়াল লেদার, নিভিয়া ইত্যাদিও তৈরি
হচ্ছে বলে জানা গেছে। জিঞ্জিরায় ফ্লাক্স থেকে মোবাইল পর্যন্ত সবকিছুই তৈরি হচ্ছে নিয়মিত।
জিঞ্জিরার ইঞ্জিনিয়ারদের মূল্যায়ন করলে বাংলাদেশও বিশ্বের অনন্য শিল্পোন্নত দেশে পরিণত
ও পরিচালিত হতে পারে। মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে আইফোন, ম্যাক্সিমাস কোম্পানির নাম অঙ্কিত
ফোনগুলোই বেশি হচ্ছে। মোবাইল ফোনের ক্যাসিং, ব্যাটারি, চার্জারসহ নানা পার্টস তৈরি
করে তারা। শুধু তাই নয়, এখানকার ইঞ্জিনিয়াররা ফটাফট তৈরি করছে নকল মোবাইল ফোন সেট।
আর বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে চীনের নামি-দামি কোম্পানির সিলমোহর।
জিঞ্জিরার ইঞ্জিনিয়ারদের
উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে অলৌকিক ক্ষমতা বলেও মনে করেন অনেকে। এখানে একটা ফ্লাক্সে বডি বানাতে
১০ থেকে ১২ টাকা খরচ পড়ে। আর রিফিল বাইরে থেকে আনতে খরচ পড়ে ৭০ টাকার মতো। সব মিলিয়ে
৯০ টাকার ভিতরেই একটা ফ্লাক্স প্রস্তুত হয়ে যায়। বাংলাদেশ ফাউন্ড্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের
সভাপতি আইনুল হক সোহেল বলেন, কৃষি বিপ্লবের অংশীদার বগুড়ার ফাউন্ড্রি ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংকে
গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অর্থের অভাবে প্রযুক্তির উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। মান্ধাতা আমলের
প্রযুক্তি দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ শিল্প আধুনিকায়ন করা গেলে
প্রচুর রপ্তানি আয় সম্ভব। তিনি বলেন, ফাউন্ড্রি
শিল্পের কাঁচামাল কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পিক আয়রন, হার্ডকোক ও ভাঙা লোহার সংকট রয়েছে।
এসব পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক বেড়েছে। কৃষি যন্ত্রপাতির আমদানিকারকরা কোনো ট্যাক্স দেন
না। অথচ দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স বসানো হচ্ছে।কাঁচামাল আমদানিতে
কর দিতে হচ্ছে।
হালকা প্রকৌশল শিল্পের
বিভিন্ন মেশিনারি দেশে সফলভাবে তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে-কৃষি প্রযুক্তির যন্ত্র-যন্ত্রাংশ,
চা প্লান্টের উপকরণ, রুটি-বিস্কুটসহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র,
স্টিলের আসবাবপত্র, মন্ড ও ডাইস, গ্যাসের সংযোগ ও বিতরণের উপাদান, কিচেন ওয়্যার, বাথরুম
ফিটিংস, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, আগুন নির্বাপক যন্ত্রসহ আরও অনেক কিছু। বাংলাদেশের উপকূলে
অন্তত ১ লাখ ফিশিং ট্রলার মাছ আহরণে ব্যবহার হয়। এসব নৌযানের সবকিছুই দেশে উৎপাদিত।
২০০১-০২ সালে এসব উপকরণ জাপান ও তাইওয়ান থেকে আমদানি করতে হতো। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও
কুটিরশিল্প সংস্থার (বিসিক) কর্মকর্তারা জানান, জেলায় ৯৭৮টি কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা
আছে। এর মধ্যে ৪০টি ঢালাই কারখানা।শ্যালো মেশিনের পাম্প তৈরির কারখানা আছে ৩০টি। পাওয়ার
টিলারের চাকা ও ধান মাড়াই মেশিন তৈরির ওয়ার্কশপের সংখ্যা ২০। জমি নিড়ানি, বীজ
বপনের জন্য সেখানে তৈরি হচ্ছে আধুনিক যন্ত্র 'ড্রাম সিডার'। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই এসব কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন শ্রমিক শ্রেণির কারিগররা।
ফেলনা থাকছে না কিছুই
জিঞ্জিরার কারিগরদের
কাছে ভাঙা হাঁড়ি, কাচ, ছেঁড়া জুতা, বিনষ্ট করা বোতল-প্যাকেট কোনো কিছুই এখন আর ফেলনা
থাকছে না। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র, হোটেল-রেস্তোরাঁর ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট
হাড়-হাড্ডি এমনকি নারিকেলের ছোবরাকেও তারা নিপুণভাবে শিল্প উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে,
তৈরি করছে তাক লাগানো সব জিনিসপত্র। চারপাশে অহরহ পাওয়া পরিত্যক্ত 'কাঁচামাল' দিয়েই
জিঞ্জিরার কারখানাগুলোয় ১০০ ভাগ দেশীয় পণ্য প্রস্তুত করে তা বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। গত কয়েকদিন অনুসন্ধানকালে
জিঞ্জিরা শিল্পকেন্দ্রিক কারিগরদের পরিকল্পনা ও দক্ষতার অজস্র নমুনা দেখা গেছে। তাওয়াপট্টি,
ফেরিঘাট ও আগানগর এলাকায় উচ্ছিষ্ট-পরিত্যক্ত উপকরণ নির্ভর বেশ কয়টা ক্ষুদে কারখানা
গড়ে উঠেছে। রাস্তাঘাট, বাজার, দোকানপাট, বাসাবাড়ির আঙিনা, ড্রেন-ডাস্টবিন থেকে সংগৃহীত
প্লাস্টিক বোতল, জুতা-স্যান্ডেল, পাইপ , ভাঙা জগ, বালতি, গামলা কাটিং মেশিনে কেটে কুচি
কুচি করা হয়। এরপর তা ক্র্যাসিং মেশিনে উচ্চ তাপমাত্রায় গলিয়ে রং ও রাসায়নিক পদার্থ
মিশিয়ে তৈরি হয় 'দানা'। এরপর প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী তৈরির কাঁচামাল হিসেবে সরবরাহ করা
হয়। প্লাস্টিক দানা তৈরি কারখানার মালিক হানিফ আলী জানান, দানাগুলো পিইটি, মার্লেক্স
ও এসডিপি নামে তিন ভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে পিইটি দানা চীন, নেপাল ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি
করা হচ্ছে। আধুনিক মেশিনের সাহায্যে লোহা, স্টিলসহ অন্যান্য ধাতবখণ্ড গলিয়ে বানানো
হচ্ছে দা, বঁটি, ছুরি হাঁড়ি-পাতিল, কড়াইসহ নানা পণ্য। তামা থেকে বানানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক
তার। ছেঁড়া-ফাটা পোশাকের অংশগুলো থেকে ক্র্যাসিং করে ঝুট তুলা তৈরি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে
হারিকেন চিমনি, বৈয়ম, হরেক রকমের বোতল আর নজরকাড়া রেশমি কাচের চুরি। এখানে দেড়-দুইশ
মডেলের চুড়ি, চুমকি, পুঁতি তৈরি হয়। সাম্প্রতিক সময়ে বলিউডের বিখ্যাত সিনেমার নামানুসারে
চাকদে ইন্ডিয়া, ম্যাহুনা, মাসাক্কালি, দেবদাস, তুমসে আচ্ছা ইত্যাদি নামে চুরি-চুমকি
নামকরণ করা হয়েছে। বাংলাদেশি সিনেমার নামকরণে তৈরি হচ্ছে আম্মাজান, জরিনা সুন্দরী চুরি-চুমকি,
পুঁতি। নারিকেলের খোল-ছোবরা দিয়ে বিভিন্ন আকারের শোপিস, ফুলদানি, একতারা, সিগারেটের
অ্যাস্ট্রে, শিশুর খেলনাসহ তৈরি হচ্ছে নানা রকম পণ্য।
উচ্ছিষ্ট আর পরিত্যক্ত
জিনিসপত্র দিয়ে রকমারি পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে আছেন নূরে আলম। তিনি বৈদ্যুতিক
খুঁটি, বাসাবাড়ির ভেন্টিলেটরে বানানো পাখির বাসা থেকে তারখণ্ড সংগ্রহের মাধ্যমে নানা
শোপিস তৈরি করতেন। একই আদলে টেবিল ও ওয়াল ফ্যানের স্টিল নেট বানাতে বানাতে এখন নূরে
আলম গাড়ির এয়ার ক্লিনারের আবিষ্কারক। জ্বালানি ফিল্টার আর এয়ার ক্লিনারের চাহিদা পূরণও
করা যাচ্ছে দেশীয় প্রযুক্তির উৎপাদনে। নূরে আলম জানান, এখন জ্বালানি ফিল্টার ও এয়ার
ক্লিনার আমদানি করতে হচ্ছে না। সরকারি সহায়তা পেলে বিপুল পরিমাণ ফিল্টার-ক্লিনার বিদেশে
রপ্তানি সম্ভব। আরেক কারিগর আবদুল মজিদ আবিষ্কার করেছেন ওয়াশার। এ ওয়াশার ৬০০ টাকা
দরে আমদানি করতে হতো, তা প্লেনসিট কেটে তৈরি করছেন মাত্র ৩২ টাকায়। নিত্যনতুন পণ্যের
আবিষ্কারক কারিগররা জানান, মেধা খাটিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সব ধরনের পণ্য-যন্ত্রাংশ
প্রস্তুত করি-অথচ তা দেশীয় উদ্যোক্তারা অজ্ঞাত কারণে ব্যবহার করতে চান না।
বাধা ডিঙ্গিয়ে তবু এগিয়ে
এতকিছুর পরও জিঞ্জিরার
বিপ্লব থেমে নেই। এই নীরব বিপ্লবের নায়কদের পুঁথিগত বিদ্যার অভাব থাকলেও কারিগরি জ্ঞানের
অভাব নেই। তারা তাদের সে জ্ঞান দিয়ে উৎপাদন করছেন নানা ধরনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ। কোটি
কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে এসব কারিগরের কৃতিত্বে। তাদের সাফল্যে এখন
চীন ও ভারতের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশি যন্ত্রপাতি বিদেশে
রপ্তানি হচ্ছে। জিঞ্জিরার সম্ভাবনাময়
ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানা আর অবাক দক্ষতার দেশীয় কারিগরদের ভাগ্যে আজও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা
জোটেনি। তবু এগিয়ে চলছে জিঞ্জিরা। বেসরকারি পর্যায়েও নূ্যনতম সহায়তা করতে এগিয়ে যায়নি
কেউ।বরং সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক অবহেলার শিকার 'জিঞ্জিরা শিল্প'-কে
নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা চলছে নানাভাবে। একশ্রেণির ব্যবসায়ী
বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের একচ্ছত্র বাজার নিশ্চিত করতে প্রথমেই আঘাত হানছে
জিঞ্জিরায়। তারা টাকা ছিটিয়ে প্রভাব খাটিয়ে প্রশাসন দিয়ে জিঞ্জিরার ক্ষুদ্র কারখানাগুলোয়
বার বার অভিযান চালাচ্ছে। যখন-তখন নকলবাজির অভিযোগ তুলে এসব কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া
হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি সহায়তা না
থাকাসহ সীমাহীন বৈরী পরিবেশের মুখেও জিঞ্জিরার ক্ষুদ্র কারখানার কারিগররা হাত গুটিয়ে
বসে থাকছেন না। চুপিসারে নিত্যনতুন জিনিসপত্র তৈরি করে রীতিমতো তাক লাগিয়ে দিচ্ছেন।
সীমিত পুঁজির ক্ষুদ্র কারখানার মালিক আর অভাবনীয় মেধার দক্ষ কারিগররা জিঞ্জিরা শিল্পকে
পরিণত করছেন দেশের সম্ভাবনাময় আলোকবর্তিকায়।
জিঞ্জিরার ইঞ্জিনিয়াররা
কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা
ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ৬-৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প।
তাওয়াপট্টি, টিনপট্টি, আগানগর, বাঁশপট্টি, কাঠপট্টি, থানাঘাট, ফেরিঘাট এলাকার বাসাবাড়ি
ভাড়া নিয়ে বিস্তৃতি ঘটেছে প্রায় দুই হাজার ক্ষুদ্র ও হালকা শিল্প। ফ্লাক্স থেকে মোবাইল-
সবকিছুই তৈরি হচ্ছে নিয়মিত। বিখ্যাত সব কোম্পানির মালামাল তৈরি করছেন লেখাপড়া না জানা
কারিগররা। এদের স্থানীয়ভাবে 'ইঞ্জিনিয়ার' নামেই ডাকা হয়। সবক্ষেত্রেই তাদের অভাবীয়
সাফল্য। কথিত আছে, পৃথিবীর যে কোনো পণ্য-যন্ত্রাংশ একবার দেখলেই তা জিঞ্জিরার ইঞ্জিনিয়াররা
হুবহু বানিয়ে দিতে পারেন। ভারত ও চীনের তুলনায় জিঞ্জিরার উৎপাদিত বেশির ভাগ পণ্যের
দাম কম এবং মানও ভালো বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। শুধু পণ্য তৈরি করেই
ক্ষান্ত নন তারা, অল্প সময়ের মধ্যে ওই পণ্য উৎপাদনকারী মেশিনারিজ প্রস্তুত করেও তাক
লাগিয়ে দেন। এমনই একজন কারিগর ১৩ বছর বয়সের কিশোর তোফায়েল হোসেন। সে বিশ্বখ্যাত 'আই
ফোন' ফিটিংসকারী হিসেবে কাজ করে। তোফায়েল জানায়, জিঞ্জিরার কারখানাগুলো পারে না এমন
কোনো কাজ নেই। সুই, ব্লেড, আলপিন থেকে শুরু করে হেলিকপ্টারও তৈরি করার ক্ষমতা তাদের
আছে।তোফায়েলের কথায় সায়ও দিলেন আইফোন ফিটিংস কারখানার মালিক শহিদউল্লাহ। তিনি জানালেন, ১৯৭৭
সালে তার বড় ভাই নাসিরউদ্দিন সরদার লেনের বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন ওরফে কাটাখোর সাহাবুদ্দিন
একটি হেলিকপ্টার মেরামত করে তা আকাশে উড়িয়েছিলেন।
কিন্তু পরবর্তীতে
ক্যান্টনমেন্ট থেকে কড়া নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় আর তিনি এ কাজে হাত লাগাতে সাহসী হননি। বিষয়টি
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসের কোনো একদিন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের
উন্মুক্ত একটি দরপত্রে অংশ নেন ভাই সাহাবুদ্দিন। ওই দরপত্রে পরিত্যক্ত লোহা-লক্কড়ের
সঙ্গে দীর্ঘদিনের অকেজো সেনা হেলিকপ্টারের ভাঙাচোরা সরঞ্জামাদিও কিনে আনেন তিনি। দীর্ঘ
দুই বছর চেষ্টার পর প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ প্রস্তুত ও সেটিংস করে হেলিকপ্টারটি সচল করতে
সক্ষম হন তিনি। আপ্লুত শহিদউল্লাহ
জানান, ১৯৭৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে এক বিকালে ওই হেলিকপ্টার চালু করে সাহাবুদ্দিন উড়তে
থাকেন আকাশে। এ নিয়ে ব্যাপক সাড়া পড়ে। এরপরই সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসে।
সাহাবুদ্দিনের ছেলে শাহীন মিয়াও এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, হেলিকপ্টার বানানোর
স্বপ্ন-সাধ অপূর্ণ রেখেই তার বাবা সাত বছর আগে মারা গেছেন। পুরান ঢাকায় সাহাবুদ্দিন
পার্টস মার্কেট পরিচালনাকারী শাহীন আফসোস করে বলেন, 'কারও কোনো সহায়তার প্রয়োজন ছিল
না, শুধু সরকারি অনুমতি পাওয়া গেলেই আমার বাবা নিরক্ষর হিসেবে হেলিকপ্টার তৈরির বিশ্বরেকর্ড
করতে পারতেন।' দেশে চা-প্লান্টের
নানা উপকরণ প্রস্তুতকারী রেজোয়ান বিশ্বাস জানান, অসম্ভবকে সম্ভব করার মতো অসংখ্য প্রতিভাধর
দক্ষ কারিগর জিঞ্জিরার খুপরি কারখানার ঝুপড়ি ঘরে অবহেলায় পড়ে আছেন। কেউই তাদের পাশে
দাঁড়ায় না। বরং 'নকলবাজ' বলে গালি দেয়। অথচ এই কারিগরদের সহায়তা দিলে বাংলাদেশে 'শিল্প
বিপ্লব' সৃষ্টি করা ওয়ান-টু ব্যাপার।'
তাদের জন্য কিছুই হয় না
শিল্প সেক্টরের অভিজ্ঞজনরা
জানিয়েছেন, জাপান, চীন, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো শিল্পোন্নত সব দেশই শুরুতে হালকা
প্রকৌশল খাতে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। অথচ বাংলাদেশে সরকারিভাবে কোনোরকম সমন্বিত উদ্যোগ
নেওয়া হয়নি।আর এতে জিঞ্জিরা শিল্পের আকাশছোঁয়া সম্ভাবনাও মাটিচাপা পড়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়
সূত্রে জানা যায়, হালকা ও ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে জিঞ্জিরা প্রকল্প
গ্রহণ করে সরকার। ওই প্রকল্পের আওতায়
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে জামানতবিহীন ৫ কোটি টাকার ঋণ সহায়তা ঘোষণা করা হয়। বিসিকের
আওতায় কারখানা প্রতি সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার বিধান রাখা হয়। উদ্যোগটির ইতিবাচক
সুফল পাওয়া গেলেও তা অজ্ঞাত কারণে চলমান রাখা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং
শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি ও এফবিসিসিআইর পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, অবহেলা-অবজ্ঞার
কাছেই গণ্ডিবদ্ধ হয়ে আছে হালকা প্রকৌশল শিল্প খাত। ঢাকা-দাউদকান্দি সড়কে মেঘনা ব্রিজের
পাশে বাউশিয়া মৌজায় শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য সরকারকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। এ ব্যাপারে
শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দিলেও এর তেমন অগ্রগতি নেই।
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।