শুক্রবারের সন্ধ্যারাত। গুলশান
লেকপাড়ের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁ। দেশি-বিদেশি অতিথিদের সৌম্য
উপস্থিতি। ফটকে হঠাৎ গুলির শব্দ। তলোয়ার-আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল সাত জঙ্গি।
তৎক্ষণাৎ ছুটে আসে পুলিশ-র্যাব। জঙ্গিদের অতর্কিত বোমা হামলা। শুরুতেই নিহত
পুলিশের দুই কর্মকর্তা। দেশে-বিদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। রাতভর জিম্মি উদ্ধারের
প্রস্তুতি। সকালে যৌথ বাহিনীর কমান্ডো অভিযান। ছয় জঙ্গির মৃত্যু। নিয়ন্ত্রণে
পুরো রেস্তোরাঁ। কিন্তু এরপরের দৃশ্য ভয়ংকর। একে একে মিলল ২০ জিম্মির লাশ।
হতভম্ব অপেক্ষারত স্বজন। স্তম্ভিত বাংলাদেশ।
শনিবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে ১২ ঘণ্টার
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা শেষে সাঁজোয়া যান নিয়ে দেয়াল গুঁড়িয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে
পড়েন সেনা কমান্ডোরা। শুরু হয় ‘অপারেশন
থান্ডারবোল্ট’।
প্রচণ্ড গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গুলশান এলাকা। ১৩ মিনিটের মধ্যে সাত
সন্ত্রাসীকে কাবু করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন কমান্ডোরা। জীবিত উদ্ধার
করেন ১৩ জিম্মিকে। ৫০ মিনিট পর অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। সরকারি ভাষ্যমতে,রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি
আর্টিজান বেকারি নামের রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা শুক্রবার রাতের বিভিন্ন সময় তিন বাংলাদেশিসহ
২০ জন জিম্মিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৭ জন বিদেশি
নাগরিক। এর মধ্যে জাপান সরকার তাদের সাত নাগরিকের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছে।
ইতালির নাগরিক নিহত হয়েছেন নয়জন। একজন ভারতীয় নাগরিক। শুক্রবার রাতে অভিযান চালাতে
গিয়ে মারা গেছেন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। আর গতকাল শনিবার সকালে অভিযানে মারা গেছে
ছয় সন্ত্রাসী। গ্রেপ্তার হয়েছে একজন। অভিযানে একজন জাপানি, দুজন শ্রীলঙ্কানসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে
উদ্ধার করা হয় সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পিস্তল, পয়েন্ট ২২
রাইফেল, হাতে তৈরি গ্রেনেড (আইইডি),ওয়াকিটকি সেট ও ধারালো অনেক দেশীয় অস্ত্র। অপারেশন থান্ডারবোল্ট
অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কেউ হতাহত হননি।
শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে আইএসের
কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স
গ্রুপ এক টুইট বার্তায় জানায়, আইএস দাবি করেছে,তারা ঢাকার রেস্তোরাঁয় আক্রমণ
করে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে রেখেছে। এরপর আমাক নিউজ ওই রেস্তোরাঁর ভেতর
থেকে রক্তাক্ত আট-নয়জনের ছবিও প্রকাশ করে এবং আইএস দাবি করে, তাদের এই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছে। আমাকের দেওয়া এসব ছবি শনিবার ভোর
চারটার দিকে টুইটারে প্রকাশ করে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ। উদ্ধার অভিযানের পর
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বলেছেন,‘অপারেশন
সফল হয়েছে, কমান্ডো
অপারেশনে ১৩ জনকে বাঁচাতে পেরেছি। কয়জনকে বাঁচাতে পারিনি, তবে সন্ত্রাসীদের ছয়জনই মারা যায়, একজন ধরা
পড়েছে।’ তিনি
বলেন,‘জঙ্গি দমন
করতে গিয়ে আমাদের দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তবে তাঁদের পদক্ষেপের কারণে
কোনো জঙ্গি পালিয়ে যেতে পারেনি।’ নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন
প্রধানমন্ত্রী। হামলা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গণমাধ্যমকে
বলেন, সারা দেশে চলমান হামলার অংশ হিসেবেই গুলশানের এই
ঘটনা। জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে। শুক্রবার রাত পৌনে নয়টার দিকে
নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়
অতর্কিতে ঢুকে পড়ে বন্দুকধারীরা। তারা দেশি ও বিদেশি নাগরিকদের জিম্মি করে। রাত
সাড়ে ১০টার দিকে পুলিশের একটি দল অভিযান চালাতে গেলে রেস্তোরাঁ থেকে হাতে তৈরি
গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন নিহত এবং ৪০ জনের মতো আহত হন। ঘটনা
সম্পর্কে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিটারি অপারেশনস পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল
নাঈম আশফাক চৌধুরী গতকাল দুপুরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, দুষ্কৃতকারীরা শুক্রবার রাতে
গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাতে ওই রেস্তোরাঁর ভেতরে প্রবেশ করে। এরপর সবাইকে জিম্মি করে।
রাতে সেখানে অভিযানকালে দুজন পুলিশ কর্মকর্তা শাহাদতবরণ করেন এবং ২০ জনের বেশি
পুলিশ সদস্য আহত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে সরকারপ্রধান কর্তৃক
আদেশ প্রদান করা হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়।
শুক্রবার রাতে জঙ্গি হামলার পরপরই র্যাব-পুলিশ-সোয়াটসহ
বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলেন। গুলশানের সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া
হয়। গণমাধ্যমে এ খবর প্রচারের পর উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। দেশের যেসব
নাগরিক জিম্মি হয়েছেন, তাঁদের স্বজনেরা ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। ওই রেস্তোরাঁর কাছেই গুলশানের ৭৮
নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে বিভিন্ন
বাহিনীর সদস্যরা রাত থেকে বৈঠক করতে থাকেন। রাত তিনটার পরপরই বিভিন্ন অভিযান
পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হয়। ভোরে সেনাবাহিনীর আটটি সাঁজোয়া যান ঘটনাস্থলে আসে।
এরপর সেনাসদস্যরা পুরো এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেন। অভিযানে আরও ছিল পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, নৌবাহিনীর
কমান্ডো এবং পুলিশের বিশেষ বাহিনী সোয়াট। তারা ৭৫, ৭৬,
৭৭, ৭৮, ৭৯ ও
৮০ নম্বর সড়কসহ ওই রেস্তোরাঁর চারপাশে অবস্থান নেয়। ওই রেস্তোরাঁর আশপাশেই ইতালি,
কাতার, ইরান ও রাশিয়ার দূতাবাস। পরের
রাস্তায় নরডিক ক্লাব। অভিযানকে কেন্দ্র করে পুরো গুলশান এলাকার রাস্তাঘাট বন্ধ করে
কড়া নিরাপত্তা বসানো হয়।
প্রথম আলোর নয়জন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী জিম্মি
ঘটনার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন। এ সময় তাঁরা দেখতে পান, সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে অভিযানের
শুরুতে দুটি জলপাইরঙা সাঁজোয়া যান ওই রেস্তোরাঁর সীমানাদেয়াল ভেঙে ভেতরে ঢুকে
পড়ে। রাস্তায় আরও কয়েকটি সাঁজোয়া যান ছিল। আগেই আশপাশের ভবনের ছাদে স্বয়ংক্রিয়
রাইফেল আর টেলিস্কোপ লাগানো স্নাইপার রাইফেল নিয়ে অবস্থান নেন কমান্ডোরা। সকাল
সোয়া আটটা থেকে দেখা যায়, উদ্ধার করে লোকজনকে বের করে
আনা হচ্ছে। তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে করে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওই
রেস্তোরাঁর কাছাকাছি একটি ভবন থেকে গতকাল সকালে একজন বিদেশি কিছু ভিডিও করে
ফেসবুকে দেন। একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, ভোরবেলায় চারজন
নারী, তিনজন পুরুষ ও একটি শিশু রেস্তোরাঁর সামনের চত্বর
দিয়ে হেঁটে বের হয়ে যাচ্ছেন। এঁদের ছেড়ে দেওয়ার পর ছাই রঙের গেঞ্জি পরিহিত পিস্তল হাতে
একজনকে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখা যায়। ভেতরে একটি টেবিলের পাশে দুজন বসে আছেন।
দুটি ক্লিপে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সমন্বিত অভিযানের কিছু দৃশ্য আছে। তাতে দেখা
যায়, সেনাবাহিনীর দুটি সাঁজোয়া যান সজোরে রেস্তোরাঁর নিচতলার
দেয়ালে আঘাত করে তা গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। আরেক ক্লিপে পাঁচজন সেনাসদস্য ভবনের ভেতরে
বোমাজাতীয় কিছু একটা ছুড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সারিবদ্ধ অবস্থানে থেকে
অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢোকেন। এ সময় অনেক গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছিল। ভেতরে আটকা পড়া লোকদের মধ্যে ছিলেন
প্রকৌশলী হাসনাত করিম। ১৩ বছর বয়সী সন্তানের জন্মদিন উদ্যাপন করতে রেস্তোরাঁয়
গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী শারমিন পারভিন এবং ৮ বছর বয়সী অন্য
সন্তান। কমান্ডো অভিযানে হাসনাতের পরিবার উদ্ধার পায়। সন্তান,পুত্রবধূ ও নাতনিদের জন্য
স্বামী এম আর করিমকে সঙ্গে নিয়ে সারা রাত গুলশানে ছিলেন হাসনাতের মা। ছেলেকে
পাওয়ার পর তিনি প্রথম আলোকেবলেন,
জিম্মিকারীরা বাংলাদেশি মুসলমানদের সুরা পড়তে বলে। সুরা পড়তে
পারার পর তাদের রাতে খেতেও দেওয়া হয়। তবে বিদেশিদের জবাই করে ও খুঁচিয়ে হত্যা করে
সন্ত্রাসীরা। ভারতীয় এক দম্পতি তাঁদের সন্তানের খোঁজে সারা রাতই ওই এলাকায়
ছোটাছুটি করেন। সকালে অভিযান শেষে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক চলে যাওয়ার সময় তাঁর
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যান ভারতীয় ওই নারী। তিনি জানতে চান, তাঁর সন্তান বেঁচে আছে কি না?
রেস্তোরাঁর বাইরে জিম্মি স্বজনদের
জন্য উদ্বিগ্ন আরও অনেক অভিভাবক রাতভর ওই এলাকায় অপেক্ষায় থাকলেও আইনশৃঙ্খলা
রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে তাঁদের কোনো খবর না পেয়ে সকালের দিকে বিক্ষোভ শুরু
করেন। যৌথ বাহিনীর এই অভিযান সম্পর্কে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী পরে
সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সেনাবাহিনী রাত থেকেই ঘটনাস্থলে অবস্থানরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী
ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাছ থেকে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে
নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বিজিবি,
পুলিশ, র্যাব, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সম্মিলিতভাবে অপারেশন থান্ডারবোল্ট
পরিচালনা করে। নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, শুক্রবার রাতেই ২০
জন জিম্মিকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এঁদের মধ্যে কয়েকজন নারীও ছিলেন। অভিযান শেষে তল্লাশিকালে
২০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বেলা দেড়টার দিকে সেনাবাহিনীর আটটি সাঁজোয়া যান
ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। চলে যান অপারেশন থান্ডারবোল্টে অংশ নেওয়া সেনা কমান্ডোরা।
এরপর রাস্তার এক পাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে সেখানে আসেন
সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাঁরা ঘটনাস্থলে যান এবং সেখান থেকে আলামত সংগ্রহ
করেন। এরপর ১৪টি অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু শেষ হয় না
জিম্মিদের স্বজনদের অপেক্ষা। গত রাত পর্যন্ত মরদেহ হস্তান্তর করা হয়নি পরিবারের
কাছে। এখনো মেলেনি সন্ত্রাসীদের পুরো পরিচয়। মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি
নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ। জনমনে জেগে উঠেছে অনেক প্রশ্ন।
রাতেই ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা
ভারতীয় ১ জন
বাংলাদেশি ৩ জন (একজন
বাংলাদেশি আমেরিকান)
জাপানি ৭ জন
ইতালীয় ৯ জন
১৩ মিনিটের অপারেশন থান্ডারবোল্ট
- ৬ জঙ্গি নিহত
- ১ সন্দেহভাজন আটক
- ১৩ জিম্মি উদ্ধার
অপারেশন থান্ডারবোল্ট সফল হয়েছে: সেনা সদর দপ্তর
জিম্মি উদ্ধারে পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’কে সফল অভিযান হিসেবে উল্লেখ করে
সেনা সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,
এই অভিযানে গুলশানের রেস্তোরাঁ থেকে ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
এর মধ্যে কমপক্ষে দুজন বাংলাদেশের নাগরিক, একজন বাংলাদেশি
বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। বাকি ১৭ জনই বিদেশি। দুপুরে এক দফা সংবাদ
ব্রিফিং এবং রাতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পক্ষ থেকে এ তথ্য
জানানো হয়। আইএসপিআর জানায়, ১৭ বিদেশি নাগরিকের মধ্যে
নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয়। সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ
সম্মেলনে গতকাল বেলা একটার দিকে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’
নামের ওই অভিযানের বর্ণনা তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর
মিলিটারি অপারেশনসের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাঈম আশফাক চৌধুরী এ সময় লিখিত
বক্তব্য পড়ে শোনান। তিনি বলেন, ‘মাননীয় সরকারপ্রধানের সময়োচিত, দৃঢ়, সাহসী সিদ্ধান্ত ও সঠিক দিকনির্দেশনার জন্য এই অভিযান সফল হয়।’
সংবাদ সম্মেলনে নিহত
ব্যক্তিদের সবাইকে বিদেশি বলা হলেও পরে সন্ধ্যায় আইএসপিআরের পক্ষ থেকে সংশোধনী
দেওয়া হয়। আইএসপিআরের পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্যের
ভিত্তিতে সবাইকে বিদেশি বলা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে যে ২০ জনের
লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের সবার জাতীয়তা নিশ্চিত হওয়া
যায়নি। লাশ শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
এর আগে সংবাদ সম্মেলনে নিহত
ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত করতে কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর
প্রভোস্ট মার্শালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়। তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর
০১৭৬৯০১২৫২৪। এ সময় বলা হয়, তদন্ত সাপেক্ষে এ ঘটনার অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে
পরে জানানো হবে। নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, অভিযানে সাতজন সন্ত্রাসীর
মধ্যে ছয়জন নিহত হয় এবং এক সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিহত ২০ জনের
অধিকাংশকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তিনি আরও জানান, অভিযানের মাধ্যমে তিনজন বিদেশিসহ ১৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। বিদেশিদের
একজন জাপানি ও দুজন শ্রীলঙ্কান। সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে নাঈম আশফাক বলেন,
‘গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর
সড়কের হলি আর্টিজান বেকারি নামের একটি রেস্তোরাঁয় দুষ্কৃতকারীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে
ভেতরে প্রবেশ করে রেস্তোরাঁর সবাইকে জিম্মি করে। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ
ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে পুলিশ কর্ডন করে
সন্ত্রাসীদের যথেচ্ছ কর্মকাণ্ড থেকে নিবৃত্ত করে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যে সাহসিকতা,
আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করেছে, তা অনন্য।’ সংবাদ সম্মেলনে এই সেনা কর্মকর্তা
বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে
সেনাবাহিনীকে সরকার প্রধান আদেশ প্রদান করেন। সেই মোতাবেক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই
সেনা কর্মকর্তা আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর
নেতৃত্বে কমান্ডো অভিযান সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে শুরু হয়। ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই
সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তী সময়ে
অপারেশনের অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে সকাল আটটায় অপারেশনের সব কাজ শেষ করা
হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রাথমিকভাবে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পিস্তল, ফোল্ডেড বাঁট একে ২২ রাইফেল, বিস্ফোরিত
আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস), ওয়াকিটকি সেট
ও অনেক ধারালো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারের কথা জানিয়ে ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, অভিযানে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের কেউ হতাহত হননি। সংবাদ সম্মেলনে
সেনাবাহিনীর ৪৬ পদাতিক ডিভিশনের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুজিবুর রহমান,
প্যারা কমান্ডার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো.
এম এম ইমরুল হাসান, র্যাব, পুলিশ,
বিজিবিসহ সমন্বিত অভিযানে অংশ নেওয়া বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত
ছিলেন।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।