দক্ষিণ আফ্রিকার
কিংবদন্তিপ্রতিম বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।
ফুসফুসে সংক্রমণজনিত কারণে ৮ জুন থেকে প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হার্ট হাসপাতালে
চিকিৎসাধীন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ম্যান্ডেলার পরিবারের
সদস্যদের ডেকে পাঠিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে শ্রদ্ধাভাজন এই রাষ্ট্রনায়ককে
নিয়ে লিখেছেন মার্কিন টেলিভিশন
চ্যানেল সিএনএনের সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত নাদিয়া বিলশিক। প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত লেখা। কয়েকবার নেলসন
ম্যান্ডেলার মুখোমুখি হয়েছেন মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএনের সম্পাদকীয় বিভাগে
কর্মরত নাদিয়া বিলশিক। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসন ও ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে
শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী এই শ্বেতাঙ্গ নারী।
প্রথম স্ত্রী ইভলিন মেজের সঙ্গে, বিয়ের দিন |
আমার জন্ম দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৯৬৪ সালে।
ওই বছর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন, যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক অধিকার আইন পাস
হয় এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় নেলসন ম্যান্ডেলার। জোহানেসবার্গের এক শহরতলিতে তুলনামূলক নির্ঝঞ্ঝাট ও
সমৃদ্ধ পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছি আমি। দক্ষিণ আফ্রিকার অন্য অনেক শ্বেতাঙ্গ নাগরিকের
মতো আমার চারপাশে ছড়ানো ছিল সুযোগ-সুবিধা। আমাদের সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত ছিল
দুজন পরিচারিকা, একজন
মালি ও একজন গাড়িচালক। রোজিনা ও ফিনা নামের ওই কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারিকারা সন্তান-সন্ততি
নিয়ে আমাদের সঙ্গেই থাকত। তবে তাদের পুরো নাম জানারও গরজ বোধ করিনি আমরা। তবে মারাত্মক কোনো একটা ভুলের অস্তিত্ব আমি কৈশোরেই
টের পাই। একদিন আমি ও পরিচারিকা ফিনা শ্বেতাঙ্গ-অধ্যুষিত একটি এলাকায় হাঁটছিলাম।
হঠাৎ পুলিশের একটি ভ্যান সেখানে থামল। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ আশপাশের সব কৃষ্ণাঙ্গ
মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। তারা অনেককে টেনেহিঁচড়ে ভ্যানে তুলে নিল। আমি ভয়
পেয়ে যাই এবং ফিনাকে জিজ্ঞেস করি, ‘এসব কী হচ্ছে।’ সে বলে, পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
জোহানেসবার্গে শ্বেতাঙ্গদের এলাকায় সরকারি অনুমতিপত্র ছাড়া কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের
চলাফেরার অধিকার নেই। সেদিনই
উপলব্ধি করি, বর্ণবাদের কলুষ
থেকে আমিও আর মুক্ত নই। ধীরে ধীরে আমি প্রথমবারের মতো নেলসন ম্যান্ডেলা ও আফ্রিকান
ন্যাশনাল কংগ্রেস সম্পর্কে জানতে পারি। এক সময় ‘ফ্রি নেলসন ম্যান্ডেলা’-এর মতো
গান আমাদের চেতনার অংশে পরিণত হয়।
ম্যান্ডেলাকে
রোবেন দ্বীপের কারাগারে ১৮ বছর রাখা হয়
|
সোয়েটো দাঙ্গা সংঘটিত হয় ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন। সেদিন
ছাত্রছাত্রীদের সমাবেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। স্থানীয় ভাষায় পড়ানো যাবে না—এ মর্মে সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে
তারা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিল। সেদিন শত শত মানুষ নিহত হয়। সরকারি বাহিনীর
নৃশংসতার প্রতিক্রিয়ায় আশপাশের অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেটাই ছিল দক্ষিণ
আফ্রিকায় বর্ণবাদী ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের শুরু। বর্ণবাদের অপরাধ যে কতটা ক্ষমার অযোগ্য, সে সম্পর্কে সত্যিকার উপলব্ধি কিছুটা
হয় ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে। আমার বয়স তখন ২০-এর কোঠার শেষ দিকে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম
গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের সম্মিলিত সারিতে ঘণ্টার পর
ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার পাশে ছিলেন ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ। জীবনে প্রথমবার কোনো
নির্বাচনে ভোট দিতে এসেছিলেন তিনি। তাঁকে দুবার বাসে চড়ে এবং ১০ মাইল হেঁটে
ভোটকেন্দ্রে পৌঁছাতে হয়। আমার পাশে ছিলেন সালামিনাও। এ নারী আমাকে সন্তান লালনে
সহায়তা করতেন এবং ক্রমে আমাদের পরিবারেরই অংশ হয়ে ওঠেন। কিন্তু ৫৫ বছর বয়সে এসে
তিনি নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন।
১৯৯০ সালে ম্যান্ডেলার কারামুক্তির ঘটনাটি ছিল একই
সঙ্গে অত্যন্ত প্রত্যাশিত এবং আতঙ্কজনক ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ
সংখ্যালঘুদের অনেকে উচ্ছেদ, শাস্তি
বা সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা করছিলেন। যেকোনো বিপ্লবের পর এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে।
কিন্তু উল্টো ম্যান্ডেলা যখন সমঝোতা ও সব জাতি মিলিয়ে ‘রংধনু দেশ’ (রেইনবো
নেশন) গঠনের কথা বললেন, তখন
শ্বেতাঙ্গরা কতটুকু স্বস্তি পেয়েছিল, তা
সহজেই অনুমান করা যায়। তখন থেকেই শান্তিবাদী, রাজনীতিক
ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে ম্যান্ডেলার উত্থানের শুরু। জীবনে এত অর্জনের পরও ম্যান্ডেলার সমালোচনা যে
একেবারেই হয়নি, তা নয়। অনেকে মনে
করেন, তিনি খুব বেশি
সমঝোতাকামী ছিলেন। তা ছাড়া দেশের অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার কাজ খুব কমই করেছেন। ৯৪ বছর পেরিয়ে ম্যান্ডেলা অন্য যেকোনো মরণশীল
সত্ত্বার মতোই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। হাসপাতালে তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানানো
হয়েছে। ম্যান্ডেলা সব সময়ই শ্রদ্ধার প্রতিমূর্তি হিসেবে রয়ে যাবেন। কারণ, তিনি একটি দুঃস্বপ্নকে একটি দর্শনে, একটি দর্শনকে একটি স্বপ্নে এবং একটি
স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তর করেছিলেন।
সূত্র: সিএনএন।
১৪ টি তথ্য
১. জন্মের পর
ম্যান্ডেলার নাম রাখা হয় রোলিহ্লাহ্লা। আঞ্চলিক ভাষায় নামটির অর্থ ‘গাছের ডাল টানা’। আর কথ্য ভাষায় এই নামের মানে
দাঁড়ায় ‘সমস্যা
সৃষ্টিকারী’। তাঁর
বর্তমান নাম ‘নেলসন’ রেখেছিলেন
মিশনারি বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।
২. ছাত্রবিক্ষোভে যোগ দেওয়ার অভিযোগে ম্যান্ডেলাকে ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে তিনি পড়াশোনা শেষ করে আইনের ওপর ডিগ্রি নিয়েছেন উইটস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
৩. টেম্বু গোষ্ঠীর নেতা জোংগিনতাবা দালিন্দেবো তরুণ ম্যান্ডেলার বিয়ের আয়োজনের চেষ্টা করেছিলেন। এতে ম্যান্ডেলা ইস্টার্ন কেপ ছেড়ে পালিয়ে জোহানেসবার্গে চলে যান। সেখানে তিনি একটি খনিতে নৈশপ্রহরীর চাকরি নেন।
৪. ম্যান্ডেলা একসময় আলেক্সান্দ্রা শহরতলিতে থাকতেন। তবে পরে সোয়েটোর অর্লান্ডোতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়াল্টার সিসুলু ও তাঁর মায়ের সঙ্গে বাসায় ওঠেন।
৫. ম্যান্ডেলার প্রথম স্ত্রী ইভলিন মেজ ছিলেন একজন নার্স ও সিসুলুর আত্মীয়। এই দম্পতির চারটি সন্তান হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়।
৬. আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এএনসি) সশস্ত্র শাখার প্রধান ছিলেন ম্যান্ডেলা। এ ছাড়া তিনি বন্ধু অলিভার ট্যাম্বোর সঙ্গে মিলে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
৭. সশস্ত্র সংগ্রামে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ম্যান্ডেলা ১৯৬২ সালে দেশ ছাড়েন। মরক্কো ও ইথিওপিয়ায় গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন তিনি।
৮. ম্যান্ডেলাকে শত শত পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কানাডার সম্মানজনক নাগরিকত্ব, ব্রিটিশ লেবার পার্টি ও সে দেশের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাবের সম্মানজনক সদস্য। এ ছাড়া একটি পারমাণবিক কণার নাম রাখা হয়েছে ম্যান্ডেলা পার্টিকল। একটি প্রাগৈতিহাসিক কাঠঠোকরা ও একটি অর্কিডের নামকরণও হয়েছে ম্যান্ডেলার নামে।
৯. বর্ণবাদী সরকার ম্যান্ডেলাকে ছয়বার মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি রাজি হননি। একবার তিনি বিবৃতি দেন, ‘জনগণের সংগঠন (এএনসি) যদি নিষিদ্ধ থাকে, তাহলে আমাকে কোন ধরনের মুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে?’
১০. ম্যান্ডেলা ১৯৭০-এর দশকে একটি স্মৃতিকথা লেখেন। সেটির পাণ্ডুলিপি পলিথিনে মুড়িয়ে কারাগারের বাগানে পুঁতে রাখা হয়। কর্তৃপক্ষ বাগানে একটি দেয়াল তুলতে গেলে ব্যাপারটি ধরা পড়ে যায়। শাস্তি হিসেবে ম্যান্ডেলার পড়াশোনার সব সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১১. দ্বিতীয় স্ত্রী উইনি মাদিকিজেলা-ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তিনি আমিনা কাশালিয়া নামের এক বান্ধবীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হন। ৮০তম জন্মদিনে ম্যান্ডেলা বিয়ে করেন গ্রাসা ম্যাশেলকে।
১২. বর্ণবাদী সরকার এএনসিকে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যও এএনসিকে সন্ত্রাসীর তকমা দেয়। মাত্র ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র ম্যান্ডেলা ও তাঁর সংগঠনকে সন্ত্রাসীর তালিকা থেকে বাদ দেয়।
১৩. ম্যান্ডেলার জন্মদিন ১৮ জুলাইকে নেলসন ম্যান্ডেলা ইন্টারন্যাশনাল ডে হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। বিশ্ব সংস্থা এই প্রথমবারের মতো কোনো ব্যক্তির জন্য একটি দিন উৎসর্গ করে।
১৪. কারাগারে ম্যান্ডেলাকে মাত্র দুই মিটার চওড়া ও আড়াই মিটার লম্বা একটি প্রকোষ্ঠে রাখা হয়। শোয়ার ব্যবস্থা ছিল মেঝেতে। আর শুধু ছিল মলমূত্র ত্যাগের জন্য একটি বালতি। প্রথম দিকে প্রতি ছয় মাসে একজনমাত্র দর্শনার্থীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও একটি চিঠি লিখতে পারতেন ম্যান্ডেলা।
সূত্র: মেইল
অ্যান্ড গার্ডিয়ান
সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৮-০৬-২০১৩
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।