সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: গেইল–বিস্ফোরণ!

গেইল–বিস্ফোরণ!


জীবন তাঁর কাছে উপভোগের আরেক নাম। ক্রিকেটও তা-ই। তবে দুঃস্বপ্নের মতোই মাঝে মাঝে হানা দেয় কঠিন বাস্তবতা। ক্রিকেট তখন অস্তিত্বের লড়াই! দুঃসময়ের থাবায় ক্রিস গেইলের মুখ থেকেও উবে গিয়েছিল হাসি। ডাবল সেঞ্চুরির উদ্যাপন তাই হলো না বাঁধনহারা। হাঁটু মুড়ে বসে ব্যাট-হেলমেট উঁচিয়ে ধরলেন বটে। কিন্তু এত বড় কীর্তির উচ্ছ্বাস তাতে ফুটে উঠল কোথায়!


এমনিতে মাঠের ভেতরে-বাইরে তিনি অফুরান প্রাণশক্তির উৎস। কিন্তু ব্যাটে রানখরা, সমালোচনার কেন্দ্রে থাকা, সেই স্রোতে বোর্ডপ্রধানের শামিল হওয়া—সব মিলিয়ে সময় ছিল প্রতিকূলে। দুঃসময়কে পাল্টা জবাব দিয়ে যখন ফিরলেন, গেইলের কণ্ঠে সেই তৃপ্তি, ‘রান ছিল না ব্যাটে। এত চাপ জীবনে কখনো অনুভব করিনি। জীবনে প্রথমবার সম্ভবত এত এত লোক চাইছিল আমি রান করি। টুইটারে, ফোনে পেয়েছি অনেক অনেক মানুষের শুভকামনা, শুভেচ্ছাবার্তা। মনে হচ্ছিল আমার শত্রুরাও যেন চাইছিল ভালো করি! ভালো লাগছে যে আমি কিছু একটা করতে পেরেছি।’ ভাগ্যটাকে পাশে না পেলে অবশ্য চাপমুক্তির বদলে আরও বাড়তে পারত বোঝা। ম্যাচের দ্বিতীয় বলেই ব্যাট-প্যাডের ফাঁক গলে বোল্ড ডোয়াইন স্মিথ। নিজের খেলা প্রথম বলেই এলবিডব্লুর জোরালো আবেদনে বেঁচে যান গেইলও। তৃতীয় আম্পায়ার যখন রিভিউ করছিলেন, গেইলের আত্মা হাতের মুঠোয়, ‘মনে মনে বলছিলাম, প্রথম বলে নিশ্চয়ই আউট হতে পারি না! আউট হতে চাই না...ঈশ্বরকে ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য।’ এক বল পরই আবার দিয়েছিলেন ক্যাচমতো। শুরুর বেশ অনেকটা সময়জুড়েই ব্যাটে ছিল অস্বস্তি। তবে সময়ের সঙ্গে খুঁজে পেয়েছেন ছন্দ। প্রথম এক শ রানে ছিল যেন রানে ফেরার প্রাণান্ত চেষ্টার প্রমাণ। খেলেছেন অনেক সাবধানে, সতর্কতায়। চাপটা সরে যাওয়ার পর ফিরেছেন চেনা বিধ্বংসী চেহারায়। প্রথম সেঞ্চুরি ১০৫ বলে, পরের সেঞ্চুরি ৩৩ বলে! সম্ভাব্য ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে তাঁর ছবিটা অনেক আগে থেকেই এঁকে রেখেছেন অনেেকই। অবশেষে সেটি বাস্তবে রূপ পাওয়ায় স্বস্তি পাচ্ছেন নিজেও, ‘আগে বলেছিলাম, সেঞ্চুরি করতে পারলে অবশ্যই আমি চেষ্টা করব আরও বড় করার। রোহিত শর্মা দুটি ডাবল করার পর ভক্তদের অনেকেই আমাকে বলেছে ডাবল করতে। সবারই প্রত্যাশা ছিল। ভালো লাগছে যে সুযোগটা পেয়ে কাজে লাগিয়েছি।’ ব্যাটিংয়ের মতো অনুভূতি প্রকাশেও তিনি ভয়ডরহীন। 
মনের কথা মুখে আনেন অকপটে। বোর্ড সভাপতির টুইট বিতর্ক নিয়েও যেমন কাল রাখঢাক রাখলেন না, ‘অমন একটি জায়গা থেকে এমন কিছু হতে দেখা খুব হতাশার। বিশ্বকাপের মতো আসরে চাই সবার সমর্থন, নেতিবাচক কিছু কখনোই কাম্য নয়। এখনো আমি চোট নিয়ে খেলছি। ফর্মও ভালো ছিল না। তার মধ্যে এত কথা। সব মিলিয়ে সত্যি বলতে আমি খুব স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। মানসিক শক্তি আছে বলেই চালিয়ে যেতে পারছি।’  ও হ্যাঁ, ম্যাচে কিন্তু মারলন স্যামুয়েলসও ছিলেন! গেইল-কীর্তির বিশালতায় আড়ালে পড়েও কিন্তু ক্যারিয়ারসেরা অপরাজিত ১৩৩ রানের ইনিংস খেলেছেন স্যামুয়েলস। দুই জ্যামাইকান মিলে গড়েছেন ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জুটি। দলের রানও ঠিক জুটির সমান, ৩৭২। ম্যাচ নিয়ে এরপর আগ্রহের আর বেশি কিছু ছিল না। ফর্মে থাকা দুই বাঁহাতি শন উইলিয়ামস ও ক্রেইগ আরভিনের ব্যাটে তবু জবাবটা ভালোই দিয়েছে জিম্বাবুয়ে। একেবারেই একতরফা হয়নি ক্যারিবিয়ানদের জয়। তবে ম্যাচটি শুধুই গেইলের। বল হাতেও নিয়েছেন ২ উইকেট। সেটা নিয়েও পরে তাঁর সহজাত কৌতুক, ‘বোলিং নিয়ে আমার ভাবনার কিছু নেই, একটু বেশিই ভালো আমি!’ আসলেই তাই। নিজের দিনের গেইল একটু বেশিই ভালো! স্টার স্পোর্টস, ক্রিকইনফো।


ইতিহাসের নাম গেইল


সাফল্য আর ব্যর্থতার ব্যবধান কতটুকু? খেলাধুলায় ব্যবধানটা প্রায়ই খুব সূক্ষ্ম। কালকেরটা নির্দিষ্ট করেই বলা যায়। ব্যর্থতা আর সাফল্যের ব্যবধান ছিল কাল মাত্র আধ ইঞ্চি! নিজের প্রথম বলেই আউট হতে পারতেন ক্রিস গেইল। তিনাশে পানিয়াঙ্গারার এলবিডব্লু আবেদনে আম্পায়ার স্টিভ ডেভিস ছাড়া সায় ছিল বুঝি সবারই। রিভিউয়ে দেখা গেল বল ছুঁয়ে যাচ্ছে বেল, ‘আম্পায়ার্স কল!’ আর আধ ইঞ্চি নিচে থাকলেই আউট। হাঁটুর নিচে থাকা বল কীভাবে এত ওপরে ওঠে! ‘হক-আই’ নিয়ে সংশয়। ধারাভাষ্যে শেন ওয়ার্ন তো বলেই দিলেন, ‘জিম্বাবুয়ের উইকেট ডাকাতি হয়ে গেল।’ সেই গেইল আউট হলেন ৫০ ওভারের শেষ বলে। মাঝের সময়টাতে যা হলো, সেটিকে অনেক বিশেষণেই সাজানো যায়। ঝড়, টর্নেডো, সাইক্লোন বা তাণ্ডব—গেইলের ইনিংস বর্ণনায় এসব শব্দ ক্লিশে হয়ে গেছে। নতুন নতুন বিশেষণ খুঁজতে হয়েছে কতবার! কাল সেই শব্দ হাতড়ানোর বালাই নেই। সবার আগে যেটি বলতে হয়, সেটি হলো ‘ইতিহাস’। বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি!

ঠিক পাঁচ বছর আগে, এই তারিখটিতেই এক দিনের ক্রিকেটকে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছিলেন ৩৬ বছরের ‘তরুণ’ শচীন টেন্ডুলকার। আরেক ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই বিশ্বকাপ পেল প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি, এবারও মধ্য তিরিশ পেরোনো এক চিরতরুণের ব্যাটে। পাঁচ বছরে এটি পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরি, মুড়ি মুড়কি না হলেও বিরল নয় মোটেও। তবে সবচেয়ে প্রত্যাশিত বুঝি এটিই! ওয়ানডের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের সম্ভাবনায় সব সময়ই প্রথম দিকে থেকেছে তাঁর নাম। পরে টেন্ডুলকার-রোহিত-শেবাগদের সম্ভাব্য সঙ্গী হিসেবেও সবচেয়ে বেশিবার উচ্চারিত হয়েছে ‘গেইল’ নামটিই। কাল সেই অবধারিত দৃশ্যটিই মঞ্চায়িত হলো জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ক্যানবেরায়। আর গেইল যখন মাইলফলক ছুঁয়েছেন, বাকিদের থেকে তো একটু আলাদা হতেই হয়! ওয়ানডের পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরি হলেও দ্রুততম গেইলই, ১৩৮ বলে! টেস্টে ট্রিপল সেঞ্চুরি, ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি, টি-টোয়েন্টিতে সেঞ্চুরি—অসাধারণ এই কীর্তি লিখেছে শুধুই গেইলের ব্যাট!

ঘন কালো মেঘে ঢাকা আকাশের নিচে বৃষ্টির শঙ্কা মাথায় নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন গেইল। কে জানত, বৃষ্টি ঝরবে তাঁর ব্যাটেই, চার-ছক্কার বৃষ্টি! শুরুতে যদিও ব্যাট ক্যানবেরার আকাশের মতোই গুমোট। ওই এলবিডব্লু আবেদনের এক বল পরই ক্যাচমতো দিয়েছিলেন মিড উইকেটে। বল অল্পের জন্য ব্যাটের কানা নিল না কতবার! অবশেষে নিজেকে খুঁজে পেলেন। ৫১ বলে ফিফটি, ১০৫ বলে ২২তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি। ওই দমকা হাওয়া আচমকাই রূপ নিল টর্নেডোর। এক শ থেকে দুই শ ছুঁলেন মাত্র ৩৪ বলে, শেষ পঞ্চাশ ১২ বলে! ১৬ ছক্কায় ছুঁয়েছেন রোহিত শর্মা ও এবি ডি ভিলিয়ার্সকে। ইনিংসের শেষ বলে ১৭ নম্বর ছক্কাটি মারার চেষ্টায় আউট, নামের পাশে ১৪৭ বলে ২১৫। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিপক্ষে গ্যারি কারস্টেনের ১৮৮ রানের ইনিংস তখন অতীত। ম্যাচের দ্বিতীয় বলে ডোয়াইন স্মিথ আউট হওয়ার পর উইকেটে জুটি বেঁধেছিলেন যিনি, সেই মারলন স্যামুয়েলস অপরাজিত ১৫৬ বলে ১৩৩ রানে। এক দিনের ক্রিকেট দেখে ফেলেছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জুটি, ৩৭২! ইনিংসটির পথে ৯ হাজার ওয়ানডে রান ছুঁয়েছেন গেইল, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পেরিয়েছেন চার শ ছক্কা। তবে এত মণি-মাণিক্যের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল অবশ্যই ডাবল সেঞ্চুরি। বিশ্বকাপের প্রথম বলে কথা!

গেইলের ব্যাটে ডাবল সেঞ্চুরি অভাবনীয় নয় মোটেও, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় খানিকটা অপ্রত্যাশিত তো বটেই! ওয়ানডেতে সবশেষ তিন অঙ্ক ছুঁয়েছিলেন ১৯ মাস আগে। চোখের তীক্ষ্ণতা আর রিফ্লেক্স কমে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলছিল গত কিছুদিনের পারফরম্যান্সে। পোলার্ড-ব্রাভোদের বাদ দেওয়ার খোলামেলা সমালোচনা করেও জন্ম দিয়েছেন আলোচনার। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের কাছে হারল দল, পরের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারালেও গেইলের ব্যাট নীরব দুই ম্যাচেই। সমালোচনার ঝড় চলছিল। গেইলকে খোঁচা দিয়ে এক দর্শকের টুইট রি-টুইট করে আরও বড় ঝড় তুললেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ডেভ ক্যামেরন। সব মিলিয়ে দুই কাঁধে পাহাড় নিয়ে নেমেছিলেন কাল মানুকা ওভালে। ইনিংসটি খেলে ড্রেসিংরুমে ফেরার সময় নিজেই বললেন, ‘এত চাপে কখনো ছিলাম না।’ ভালো আর খুব ভালোদের সঙ্গে গ্রেটদের পার্থক্য বুঝি এখানেই। বেশি চাপ তাঁদের কাছে অনুপ্রেরণা। তাড়না দারুণ কিছু করার। গেইল যেমন দেখালেন!


সূত্রঃ প্রথম আলো০১:৪৫, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০১৫,  

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।