সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: পা নেই, তবুও চলছে রিকশার চাকা, চলছে সংসার!!!

পা নেই, তবুও চলছে রিকশার চাকা, চলছে সংসার!!!


তাঁদের জীবনের গল্প বিভীষিকাময়। সুস্থসবলভাবে পৃথিবীর আলো দেখলেও জীবনের একটি পর্যায়ে এসে পঙ্গু হয়ে যান তাঁরা। তবে ভাগ্যাহত এই তিন মানুষ দমে যাননি। অদম্য ইচ্ছার জোরে রিকশা চালিয়ে এখন এই তিন ব্যক্তি জীবনের চাকা ঘোরানোর চেষ্টা করে চলেছেন। ভাগ্যাহত এই তিনজন হলেন কোরবান আলী ওরফে শাহীন (৪২), আবুল হাশেম (৩৮) ও আমির হোসেন (৪০)। প্রথমজন ছোটবেলায় টাইফয়েডে ডান পায়ের চলৎশক্তি হারান। অপর দুজন সড়ক দুর্ঘটনায় একটি করে পা হারান।

কোরবান আলী নগরের বায়েজিদ এলাকার বাসিন্দা। আবুল হাশেম বালুছড়ায় এবং আমির হোসেন মুরাদপুর এলাকায় থাকেন। ব্যাটারি রিকশা তাঁদের আশাবাদী করে তোলে। রিকশার আয় থেকে তিনজনই স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে মোটামুটিভাবে সচ্ছলতা সঙ্গে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা এখন স্বপ্ন দেখেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার। ছোটবেলায় টাইফয়েডে ডান পায়ের চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল কোরবান আলী। বাবা-মা আর তিন ভাইবোনের টানাটানির সংসারে ক্রমেই বোঝা হয়ে উঠছিলেন তিনি। মুখের অন্ন জোগাতে বেছে নেওয়া ভিক্ষাবৃত্তির পেশাও ভালো লাগছিল না। বাকি গল্পটা শোনা যাক কোরবান আলীর মুখে। কোরবান বলেন, কী করব। ভাত জুটত না। তাই একেবারে ছোটবেলা থেকেই নগরের জিইসিসহ বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করতাম। ছেলেমেয়ে দুটি স্কুলে পড়ে। বাবা ভিক্ষা করে এটা বন্ধুবান্ধবদের বলতেও অস্বস্তি হয় তাদের। তাই কিছু টাকা জমিয়ে এবং ধার-দেনা করে বছর খানেক আগে একটি ব্যাটারি রিকশা কিনি।’ কোরবান আলীর আদি বাড়ি কুমিল্লায়। জন্ম চট্টগ্রামে। ১৪ বছর আগে বিয়েও করেছেন। স্ত্রী একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। তাঁদের ঘরে এখন দুই ছেলেমেয়ে। রিকশা কিনতে তাঁর খরচ পড়েছে ৪০ হাজার টাকা। তিনি বলেন, রিকশা কেনার পর নিজেও শিখে নিলাম চালানো। আট মাস ধরে নিজেই চালাচ্ছি। এতে দিনে গড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হয়। তা দিয়ে সংসার চলছে ভালোই। শরীরের এই অবস্থা নিয়ে কোরবান কী করে রিকশা চালান? সম্প্রতি নগরের কাজির দেউড়ি এলাকায় যাত্রী নিয়ে আসেন তিনি। এ সময় কথা হয় তাঁর রিকশার যাত্রী তানজিলার সঙ্গে। তানজিলা জানান,রিকশায় চড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। তিনি ভালোভাবেই রিকশা চালিয়েছেন। একবারের জন্যও মনে হয়নি আমি অনিরাপদ। কোরবানের বড় মেয়ে শাহীনুর পঞ্চম শ্রেণিতে এবং ছেলে মনির হোসেন প্রথম শ্রেণিতে পড়ে। তাদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার স্বপ্ন দেখেন প্রতিবন্ধী এই রিকশাচালক। তিনি বলেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে শিক্ষিত করতে চাই। জানি না কতটা পারব?

একই স্বপ্ন বোনেন আরেক প্রতিবন্ধী আবুল হাশেম। তিনিও ব্যাটারি রিকশা চালিয়ে এখন জীবিকা নির্বাহ করেন। লোহাগাড়ার আমিরাবাদের হাশেম একসময় ট্রাক চালাতেন। অনেক টাকা আয় করতেন। কিন্তু দুই বছর আগের একটি দুর্ঘটনা বদলে দিল সবকিছু। বাড়ির কাছাকাছি সাতকানিয়ার কেরানিহাট এলাকায় একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন তিনি। হাশেম বলেন, দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার বাম পায়ের হাঁটুর ওপরের অংশ থেকে কেটে ফেলা হয়। ডান পায়েও বড় ধরনের অস্ত্রোপচার হয়। লোহার রড দেওয়া ডান পায়েও জোর কম। অনেক ধারকর্জ হয়ে যায় চিকিৎসায়। ভিক্ষা তো করতে পারব না। তাই কিছুদিন বেকার থাকার পর গত মাসে একটি ব্যাটারি রিকশা কিনলাম ২৭ হাজার টাকায়। এখন ওই রিকশাই চালাই। হাশেমের স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। তাঁরা গ্রামের বাড়িতে থাকে। বড় ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, মেজো ছেলে চতুর্থ শ্রেণি এবং এক মেয়ে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। হাশেম বলেন,যখন ট্রাক চালাতাম অনেক টাকাপয়সা আয় করতাম। এখন কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের লেখা পড়া করাচ্ছি। রিকশা থেকে দিনে গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়।


ব্যাটারি রিকশায় ভর দিয়ে প্রতিবন্ধিতার বাধা দূর করেছেন আমির হোসেনও। পাথর ভাঙতেন তিনি। আট বছর আগে নগরের আমিন জুট মিল এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত আমির। পরে তাঁর ডান পা কেটে ফেলতে হয়। আমির হোসেন বলেন, সুস্থ হয়ে আবারও পাথর ভেঙেছি কিছুদিন। কিন্তু কষ্ট হয়। ঠিকমতো বসতে পারি না। তাই দুই বছর আগে ভাড়ায় ব্যাটারি রিকশা চালানো শুরু করি। এখন সংসারটা কোনো রকমে চলছে। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিনে ৩০০ টাকার মতো আয় হয়। আমিরের তিন ছেলে তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ে সপ্তম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। আর বড় ছেলে পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খেতে হয় আমিরকে। তিনি বলেন, ইচ্ছা আছে লেখাপড়া করানোর। জানি না কত দিন চালিয়ে যেতে পারব?’ তবে ব্যাটারি রিকশা চালাতে গিয়েও মাঝেমধ্যে পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয় প্রতিবন্ধী এই তিন ব্যক্তিকে। কারণ, চট্টগ্রামে বর্তমানে ব্যাটারি রিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আবার অনেক পুলিশ তাঁদের রিকশা চালানোকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেন বলে তাঁরা জানালেন। কোরবান বলেন, পুলিশ মাঝেমধ্যে আটকায়। যখন দেখেন পঙ্গু, তখন ছেড়েও দেয় তারা। ভিক্ষা না করে নিজে কিছু করে খাচ্ছি এটাই হয়তো সবার ভালো লাগে। এখন আমরা দান চাই না। আমাদের যদি স্থায়ীভাবে রিকশা চালানোর একটি অনুমতিপত্র দেওয়া হয় তাহলে ভালো হয়।


সূত্রঃ প্রথম আলো, আপডেট: , জুন ১২, ২০১৬

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।