সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: মুমিনদের জন্য মাহে রমজানের হাদিয়া (১ম অংশ)

মুমিনদের জন্য মাহে রমজানের হাদিয়া (১ম অংশ)

ভূমিকা:
الحمد لله الذي شرع لعباده صيام شهر رمضان وجعله أحد أركان الإسلام، والصلاة والسلام على نبينا محمد أفضل من صلى وصام وعلى آله وأصحابه البررة الكرام، وبعد:
‍‌‌পবিত্র মাহে রমজান মুসলিম জাতির প্রতি মহান আল্লাহর সীমাহীন অনুকম্পা ও অনুদানের অন্যতম। রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসকে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌শাহরুন মুবারাকুন- বরকতময় মাস বলে অভিহিত করেছেন। এ মাসের রয়েছে বিশাল মর্যাদা ও ফজিলত। রয়েছে বিশেষ বিশেষ আমল। এ মাসকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ প্রতিটি ঈমানদারের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি ও কল্যাণ সাধনের সুযোগ অবারিত করে দিয়েছেন। সে দিকে লক্ষ্য করে আমরা কয়েকটি পাঠে বিভক্ত করে এ নিবন্ধটি সাজিয়েছি। প্রতিটি মুসলমান যাতে এ মাসের মহা মূল্যবান প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে প্রতিশ্রুত প্রতিদান অর্জনে উদ্যোগী হয়, চেষ্টা-শ্রমের সবটুকু নিংড়ে দেয়, সেভাবে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। অনুপ্রেরণা বৃদ্ধি পাবে সে আশায় রমজানের ফজিলত ও মর্যাদার আলোচনাও যুক্ত করে দিয়েছি। প্রাসঙ্গিক ভাবনায় সিয়াম ও তারাবীহ সংক্রান্ত কিছু ফেকহি মাসলা-মাসায়েলও উল্লেখ করেছি। সব কিছুর মূলে রয়েছে আমার নিজেকে এবং অপরাপর সকল মুসলিম ভাইকে সচেতন করা। মহান আল্লাহ ও আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া।
হে আল্লাহ লেখক, পাঠক, শ্রোতাসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে তুমি এর দ্বারা উপকৃত কর। যাবতীয় ভুল-ত্রুটি মার্জনা করে দাও। এবং সব দিক থেকে কবুল করে নাও।
وصلى الله وسلم على نبينا محمد وآله وصحبه.

প্রথম পাঠ: রমজান মাসের রোজা ফরজ  হয় কখন ?
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون}[البقرة 183].
হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।
(সূরা বাকারা:১৮৩)
উল্লেখিত আয়াতসহ পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা রোজা প্রসংগে বলছেন যে, রোজা এ উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছে। তবে ফরজের এ ধারা নতুন কোনো বিষয় নয়, পূর্ব হতেই এটি চলে আসছে। পূর্ববর্তী উম্মতের ওপরও রোজা ফরজ করা হয়েছিল। সুতরাং রোজা আমরা ও পূর্ববর্তী উম্মত উভয়ের ওপরই ফরজ।
আয়াতের তাফসিরে কতিপয় আলেম মন্তব্য করেছেন, রোজা নামের মহান ইবাদতটি আদম আ. থেকে নিয়ে সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী ও উম্মতের ওপরই ফরজ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বিষয়টি পবিত্র কোরআনে আলোচনা করেছেন। এর তাৎপর্য হচ্ছে, কঠিন একটি বিষয় যদি ব্যাপকতা লাভ করে তাহলে তার বাস্তবায়ন সহজ হয়ে যায়। সকলে সহজভাবে গ্রহণ করে। এবং মানসিক প্রশান্তিও লাভ হয় অধিক।
সুতরাং রোজা সকল উম্মতের বিধান। সকলের ওপরই তা ফরজ করা হয়েছে। যদিও সময় ও ধরনে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে।
সাঈদ বিন জোবায়ের রহ. বলেন, পূর্ববর্তী যুগে রোজার নির্ধারিত সময় ছিল ইসলামের শুরু যুগের ন্যায় আতামাহ (আঁধার) থেকে নিয়ে পরবর্তী রাত পর্যন্ত।
ইমাম হাসান রহ. বলেন, রমজানের রোজা ইহুদীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা তা অমান্য করেছে। এবং বছরে কেবল এক দিনের রোজা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বিশ্বাস হচ্ছে, এ দিনটিতে ফেরাউনের সলিল সমাধি ঘটেছে। তবে তারা এ ব্যাপারে মিথ্যা বলেছে। কারণ সে দিনটি ছিল, আশুরার দিন।
রোজা খ্রীষ্টানদের ওপরও ফরজ ছিল। দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত তারা তা নিয়মিত পালনও করে। কিন্তু কিছুকাল পর রোজার নির্ধারিত সময়টি প্রচন্ড গরমের মৌসুমে এসে পড়ে। তীব্র গরম তাই রোজা পালন তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিভিন্ন দিকে সফর ও রোজগার কঠিন হয়ে যায়। এ নিয়ে তারা পরামর্শ সভার আয়োজন করে। ধর্মযাজক ও নেতৃবর্গের সম্মতিতে শীত ও গরমের মাঝামাঝি মৌসুম-বসন্তকালে রোজা পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আরো সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে রোজার এ সময়টি অপরিবর্তিত থাকবে। আর কখনো পরিবর্তন করা হবে না। শরিয়ত প্রবর্তিত সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনার কাফফারা স্বরূপ, নির্ধারিত ত্রিশ দিনের রোজার সাথে আরো দশ দিন বাড়িয়ে চল্লিশ দিন করা হয়।
{لعلكم تتقون} অর্থাৎ, রোজার মাধ্যমে যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। দেখা যাচ্ছে, রোজার মাঝে নিজেকে দমন ও কামরিপুর অপ অভিলাষকে চূর্ণ করার বিষয়টি বিদ্যমান। তাই রোজা তাকওয়া সৃষ্টিতে ফলদায়ক ভূমিকা রাখে।
আল্লাহ তাআলার বাণী,
{فمن كان منكم مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين}
অর্থাৎ,তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবেআর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা
কেউ কেউ বলেছেন, এগুলো রমজানের বাইরের দিন। আর তা ছিল তিন দিন। আবার অন্যরা বলেছেন, রমজানের দিন। যুক্তি হিসাবে তারা বলেছেন, আল্লাহ তাআলা এগুলোর উল্লেখ এমন এক আয়াতে করেছেন যার পরই বর্ণিত হয়েছে। {شهر رمضان}
শরিয়ত বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইসলামের শুরুতে মুসলমানদেরকে ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌রোজা ও ফিদিয়া এর যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে তারা স্বাধীন ছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
{وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين فمن تطوع خيرا فهو خير له وأن تصوموا خير لكم} [البقرة 184]
অর্থাৎ, আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করাঅতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবেআর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর। {সূরা বাকারা:১৮৪}
অত:পর- فمن شهد منكم الشهر فليصمه} -সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে।}(সূরা বাকারা:১৮৫)-
আয়াত নাযিল করে রোজা সকলের জন্য আবশ্যিক করে প্রদত্ত স্বাধীনতাকে রহিত করা হয়েছে। এর হিকমত হচ্ছে, বিধান প্রবর্তণে উম্মতের প্রতি সহজীকরণ ও ক্রমান্বয়িক নীতি পরিগ্রহণ। কারণ সিয়াম একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত । মুসলমানরা আগে থেকে এ ব্যাপারে খুব একটা অভ্যস্ত ছিলেন না। যদি সূচনাতেই এটি তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হত তাহলে ব্যাপারটি তাদের জন্য কঠিন হয়ে যেত। তাই প্রথমে রোজা ও ফিদিয়ার মাঝে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। অত:পর আস্তে আস্তে তাদের একীন মজবুত হয়েছে, মানসিক অবস্থা স্থিরতা লাভ করেছে এবং ধীরে ধীরে রোজার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। তখন স্বাধীনতা উঠিয়ে নিয়ে কেবল রোজাকে আবশ্যিক করা হয়েছে। কঠিন ও কষ্টসাধ্য বিধি-বিধানের ব্যাপারে ইসলামে এর বহু নজির বিদ্যমান। একে পরিভাষায় ক্রমান্বয়ে প্রবর্তণ বলা হয়।
তবে বিশুদ্ধ অভিমত হচ্ছে, সিয়াম পালনে সক্ষম ব্যক্তির পক্ষে এ আয়াত রহিত। আর বার্ধক্য কিংবা আরোগ্য লাভের সম্ভাবনাহীন অসুস্থতার কারণে অক্ষম লোকের পক্ষে রহিত হয়নি। তারা প্রতি দিনের রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাবার দানের বিনময়ে রোজা পালন হতে অব্যহতি লাভ করার অধিকার সংরক্ষণ করে। এ জন্য তাদের কাজাও করতে হবে না।
তবে সুস্থ হবার আশা আছে এমন অসুস্থ ব্যক্তি কিংবা সফর জনিত অসুবিধার কারণে রোজা পালনে সাময়িক অক্ষম ব্যক্তিরা এ ছাড়ের আওতাভূক্ত হবে না। রোজার আবশ্যিকতা তাদের উপর বলবৎ থাকবে। সাময়িক অসুবিধার কারণে সময়মত রোজা পালন করতে না পারলেও পরে কাজা করতে হবে।
আল্লাহ বলেন,
{فمن شهد منكم الشهر فليصمه ومن كان مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر} [البقرة 185]
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। (সূরা বাকারা:১৮৫)
রমজান মাসের রোজা হিজরি দ্বিতীয় সালে ফরজ করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বমোট নয়টি রমজানের ফরজ রোজা পালন করেছেন। রমজান মাসের রোজা অবশ্য পালনীয় ও ইসলামের একটি রোকন। এর আবশ্যকীয়তাকে অস্বীকারকারী শরিয়তে কাফের হিসেবে গণ্য । ফরজ বলে স্বীকার করে বিনা ওজরে পালন না করলে গুরুতর পাপী হিসাবে বিবেচিত হবে। এসব লোকদের শাস্তি বিধান ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। আর তাদের করণীয় হচ্ছে তাওবা করা এবং ছেড়ে দেওয়া রোজাগুলোর কাজা করে নেওয়া।
দ্বিতীয় পাঠ: রমজান মাস নিশ্চিতকারী বিষয়
মহান আল্লাহ বলেন,
{فمن شهد منكم الشهر فليصمه} [البقرة 185]
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। (সূরা বাকারা:১৮৫)
এ আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা রমজানের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত, এক কথায় পূর্ণ মাসের রোজাকে আবশ্যিক করেছেন।
রমজান মাসের সূচনা সম্পর্কে দুবিষয়ের যে কোনো একটির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
প্রথম বিষয়:
চাঁদ দেখতে পাওয়া । ইমাম বোখারি, মুসলিম ও অন্যন্য হাদিস বিশারদরা বর্ণনা করেছেন,
أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "إذا رأيتم الهلال فصوموا وإذا رأيتموه فأفطروا فإن غم عليكم فاقدروا له" [أخرجه البخاري رقم 1900، ومسلم رقم 1080/8].
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা চাঁদ দেখতে পেলে রোজা রাখবে আবার চাঁদ দেখতে পেলে রোজা ভঙ্গ করবে। আর আকাশ (মেঘাচ্ছন্ন হয়ে) ঢেকে থাকলে গণনা করবে। (বোখারি ১৯০০ ও মুসলিম ৮/১০৮০)
ইমাম আহমাদ ও ইমাম নাসায়ি রহ. আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
"لا تصوموا حتى تروا الهلال ولا تفطروا حتى تروه"
চাঁদ না দেখে তোমরা রোজা রাখবে না আবার চাঁদ না দেখে ইফতার (ভঙ্গ) করবে না।
ইমাম তাবারানী রহ. তালক্ব বিন আলী রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন,
"أن الله جعل هذه الأهلة مواقيت فإذا رأيتموه فصوموا وإذا رأيتموه فأفطروا" [أخرجه الطبراني في معجمه الكبير 8/397 رقم 8237].
আল্লাহ তাআলা এ চাঁদসমূহকে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারক হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং তোমরা তা দেখতে পেলে রোজা পালন করবে আবার দেখতে পেলে ভঙ্গ (ইফতার) করবে। (আল মুজাম আল কাবির)
وروى الحاكم عن ابن عمر رضي الله عنهما: "جعل الله الأهلة مواقيت للناس فصوموا لرؤيته وأفطروا لرؤيته" [أخرجه الحاكم في المستدرك 1/423 وأحمد في المسند 4/ 23 والدارقطني في سننه 2/163 وقال الحاكم: صحيح على شرط الشيخين ووافقه الذهبي].
ইমাম হাকেম রহ. ইবনে ওমর রা. হতে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা চাঁদসমূহকে নির্দিষ্ট সময় নির্ধারক বানিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তা দেখে রোজা রাখবে আবার তা দেখেই রোজা ভঙ্গ করবে। [হাকেম/আল মুস্তাদরাক:১/৪২৩, আহমাদ/আল-মুসনাদ:৪/২৩, দারাকুতনী/সুনান:২/১৬৩, ইমাম হাকেম একে ইমাম বোখারি ও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন। ইমাম যাহাবী এর সমর্থন করেছেন।]
উদ্ধৃত হাদিসসমূহে রমজানের রোজার আবাশ্যকীয়তাকে চাঁদ দেখার সাথে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে। চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখতে বলা হয়েছে। আর না দেখে রোজা রাখতে বারণ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ চাঁদসমূহকে মানব জাতির জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারক সাব্যস্ত করেছেন। চাঁদের মাধ্যমে তারা নিজেদের ইবাদত-বন্দেগী ও লেন-দেনের সময় সম্বন্ধে অবহিত হবে।
যেমন আল্লাহ বলেন,
{يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس والحج} [البقرة 189]
তারা তোমাকে নতুন চাঁদসমূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করে। বল, তা মানুষের ও হজের জন্য সময় নির্ধারক। (সূরা বাকারা:১৮৯)
এটি বান্দাদের প্রতি মহা করুণাময় আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং তাদের তরে সহজীকরণ। তিনি সিয়ামের আবশ্যকীয়তাকে এমন সুস্পষ্ট বিষয় ও বাহ্য নিদর্শনের সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন, যে কেউ তা অনুধাবন করতে পারবে আপাত দৃষ্টিতে নিতান্ত অনায়াসে। চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যক্তিকেই নিজ চোখে দেখতে হবে এমন কোনো শর্ত নেই। কিছু লোক বরং ক্ষেত্র বিশেষে একজন দেখলেই সকলের তরে সিয়াম পালন আবশ্যিক হয়ে যাবে।
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জনৈক বেদুঈন এসে বলল, আমি চাঁদ দেখেছি- অর্থাৎ রমজানের চাঁদ। নবীজী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সাক্ষ্য দাও যে, ‌আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই? লোকটি বলল, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ বললেন, বেলাল- আগামী কাল রোজা পালন করতে হবে, এ মর্মে লোকদের ঘোষণা দিয়ে দাও। (আবু দাউদ)
ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, লোকেরা চাঁদ দেখাদেখি করল। আমি চাঁদ দেখেছি মর্মে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সংবাদ দিলাম। তিনি নিজে রোজা রাখলেন এবং লোকদের রোজা রাখতে নির্দেশ দিলেন। (আবু দাউদ:২৩৪২)
দ্বিতীয় বিষয়:
চাঁদ দেখা না গেলে রমজান মাস সাব্যস্ত হবার দ্বিতীয় পদ্ধতি হচ্ছে পূর্ববর্তী শাবান মাসকে ত্রিশ দিনে পূর্ণ করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
"فإن غم عليكم فاقدروا له"
যদি (আকাশ) ঢেকে থাকে তাহলে তোমরা গণনা কর। (বোখারি ও মুসলিম)
"غم عليكم" এর অর্থ, শাবান মাসের ত্রিশতম রাত্রিতে কোনো বস্তু আকাশকে ঢেকে রাখার কারণে যদি চাঁদ দেখা না যায় তাহলে তোমরা শাবান মাসকে ত্রিশ দিনে পূর্ণ করে গণনা কর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ মর্মে বর্ণিত একটি হাদিস বিষয়টিকে খোলাসা করছে,
"فإن غم عليكم فأكملوا العدة ثلاثين"
যদি (আকাশ কিছুতে) ঢেকে থাকে তাহলে তোমরা মাসের গণনাকে ত্রিশ দিনে পূর্ণ কর। (বোখারি মুসলিম)
এর অর্থ হচ্ছে, ইয়াওমুশ শক্ক তথা সন্দেহের দিনে রোজা রাখা হারাম। বিশিষ্ট সাহাবি আম্মার বিন ইয়াসির রা. বলেন,
"من صام اليوم الذي يشك فيه فقد عصى أبا القاسم صلى الله عليه وسلم" [أخرجه أبو داود رقم 2334 والترمذي 686 والنسائي 2190 وابن ماجه 1645 وقال أبو عيسى الترمذي: حسن صحيح].
সন্দেহের দিনে যে ব্যক্তি রোজা পালন করল সে প্রকারান্তরে আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমান্য করল। (তাঁর বিরোধিতা করল।) ( আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসায়ী, ইবনু মাজা। ইমাম তিরমিজি একে হাসান-সহিহ বলে মন্তব্য করেছেন।)
সুতরাং রোজাসহ যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রে প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূল থেকে আগত বিষয়াদির উপর পরিপূর্ণ নির্ভর করা। তাঁদের দেওয়া নীতি-বিধান মেনে চলা। উপরোক্ত আলোচনায় আমরা স্পষ্টরূপে দেখতে পেয়েছি, আল্লাহ তাআলা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের আগমন নিশ্চিত কারী দুটো নিদর্শন নির্দিষ্টি করে দিয়েছেন। যা সাধারণ-বিশিষ্ট সকল শ্রেণীর মানুষই অনুধাবন করতে সক্ষম। চাঁদ দেখা কিংবা শাবান মাসকে ত্রিশ দিন পূর্ণ করে গণনা করা। এখন কেউ যদি আল্লাহ বা তাঁর রাসূল নির্ধারিত পন্থা ব্যতীত রমজান নির্ধারণী নতুন কোনো পন্থা উদ্ভাবন করে রোজা পালন শুরু করে। তাহলে তাকে আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতাকারী, আল্লাহ ও রাসূল প্রদত্ত বিধি-বিধানে পরিবর্ধন সাধনকারী এবং দ্বীনের ভেতর নতুন বেদআতের সংযোজনকারী হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আর সকলেরই জানা, সর্ব প্রকার বেদআত গোমরাহী।
যেমন, কেউ প্রস্তাব পেশ করল যে, রমজান মাসের সূচনা সংক্রান্ত বিষয়ে চাঁদ দেখা বা মাসের গণনা বহু পুরাতন পন্থা। এখন থেকে এগুলো বাদ দিয়ে বিজ্ঞান সম্মতভাবে সৌর-হিসাব অনুযায়ী নির্ধারণ করে আমল করতে হবে। এসব কথায় গুরুত্ব দেয়া যাবে না। কারণ রমজানের রোজা একটি ইবাদত, তার নিয়ম-নীতি শরিয়তের পক্ষ হতে নির্ধারিত। ফলে এ ক্ষেত্রে শরিয়ত নির্ধারিত পদ্ধতিই অনুসরণ করতে হবে। অন্যথা হলে শরিয়ত অপরিবর্তিত থাকবে না। তাছাড়া এটি একটি সুক্ষ্ম ও জটিল বিষয় সর্ব সাধারণের পক্ষে বুঝা খুব কঠিন। আর সৌর-গণনায় ভুল হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া রহ. বলেন :আমি কিছু লোক সম্বন্ধে জানি তারা নিজেদের রোজা ও অন্যান্য মাসের ক্ষেত্রে গণনাকারী যন্ত্র ও এ জাতীয় যন্ত্রবিদদের অজ্ঞতাপ্রসূত কথা ‌‌‌‌‌‌‌‘চাঁদ দেখা যাক বা না যাক-এর উপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এমন কি কতিপয় বিচারক সম্পর্কেও আমার নিকট খবর পৌঁছেছে,  তারা নাকি অজ্ঞ-অবাস্তব-ভুলে ভরপুর গণকযন্ত্র ‘চাঁদ দেখা যাক বা না যাক জাতীয় ম্যাসেজের উপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদেলের কথা রদ করে দিয়েছে। ব্যাপারটি যদি সত্যি হয় তাহলে তাদের এ কাজটি ঠিক সে ব্যক্তির মতই হল যে, হক আসার পর তাকে মিথ্যপ্রতিপন্ন করল।
তিনি আরো বলেন :দ্বীন-ইসলামের অলঙ্ঘনীয় বিধান সম্বন্ধে আমরা যতটুকু জানি; রোজা, হজ্জ, ইদ্দত, ঈলা সহ যে সব আমল চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত সে সব আমল চাঁদ না দেখে গনকযন্ত্র জাতীয় যন্ত্রের ম্যাসেজ ‘চাঁদ দেখা যাক বা না যাক-এর উপর নির্ভর করা বৈধ নয়। এ সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি বিদ্যমান। এ ব্যাপারে মুসলমানদের ইজমাও হয়েছে। পূর্ববর্তী বা পরবর্তী কারো কোনো দ্বিমত পাওয়া যায়নি। (ফতোয়া শায়খিল ইসলাম:২৫/১৩১-১৩২)। তাছাড়া যন্ত্রের ওপর নির্ভর করার মধ্যে উম্মতের কষ্ট ও অসুবিধা বিদ্যমান। আর আল্লাহ তাআলা বলছেন,
{وما جعل عليكم في الدين من حرج} [الحج 78]
দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। (হজ্জ: ৭৮)
সুতরাং রোজা, চাঁদ দেখা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের দায়িত্ব হচ্ছে, শরিয়তের অন্যান্য বিষয়ের মত আল্লাহ ও রাসূল কর্তৃক মনোনীত নিয়ম-নীতির উপর নির্ভর করা। সে পর্যন্ত সীমিত থাকা।
তৃতীয় পাঠ: মাহে রমজানের ফজিলত
মহান আল্লাহ রমজান মাসকে বহুবিধ ফজিলতের জন্য নির্বাচিত করেছেন। অনেক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে তিনি রমজানকে বিশেষ স্বাতন্ত্র দান করেছেন। যে কারণে রমজান মাস অন্যান্য মাসের মাঝে অনন্য। বিবিধ বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{شهر رمضان الذي أنزل فيه القرآن هدى للناس وبينات من الهدى والفرقان فمن شهد منكم الشهر فليصمه ومن كان مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر} [البقرة 185].
রমজান মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থ্যক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। (সূরা বাকারা: ১৮৫)
সামান্য চিন্তা করলেই আমরা দেখতে পাব যে মহা মহিম আল্লাহ এ আয়াতে রমজান মাসের দুটি মহান বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।
প্রথম বৈশিষ্ট্য:
মহান আল্লাহ মানব জাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে হেদায়াতের জন্য নাযিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এ মহান কিতাবের মাধ্যমে মানবজাতিকে হক ও বাতিল পরিদৃষ্ট করানো হয়েছে। তাতে রয়েছে মানবজাতির সার্বিক উপকারিতা ও কল্যাণ। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নির্ভুল সফলতার সঠিক দিক নির্দেশনা। আর এ বিশেষ নিয়ামত দানের জন্য তিনি নির্বাচন করেছেন রমজান মাসকে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য:
উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার ওপর বহু ফজিলতপূর্ণ রোজার মত মহা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত আবশ্যিক করা হয়েছে এ মাসেই। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে নির্দেশ জারি করে বলেন,
{فمن شهد منكم الشهر فليصمه} [البقرة 185].
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালনকরে।
{সূরা বাকারা : ১৮৫}
রমজানের রোজা ইসলামের অন্যতম একটি রোকন। আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরজ-বিধান। এ বিধান কেউ অস্বীকার করলে কাফের বলে বিবেচিত হবে। সুস্থ ও মুকিম তথা নিজ বাড়িতে অবস্থানকারী ব্যক্তির ওপর এ মাসের রোজা পালন করা আবশ্যিক। আল্লাহ বলেন,
{فمن شهد منكم الشهر فليصمه ومن كان مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر } [البقرة 185].
সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নিবে। (সূরা বাকারা: ১৮৫)
আয়াতের মাধ্যমে পরিস্কার হল যে, রমজানের রোজা থেকে কারো পরিত্রাণ নেই। হয়তো আদায় করতে হবে নয়তো কাজা। তবে একান্ত বৃদ্ধ ও সুস্থতার আশা নেই এমন অসুস্থ ব্যক্তি -যারা কাজা বা আদায় উভয়েই অক্ষম- তারা এর ব্যতিক্রম। তাদের বিধান সম্বন্ধে খানিক পর আলোচনা হবে ইনশাল্লাহ।
এ মাসের মর্যাদা সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইমাম বোখারী ও ইমাম মুসলিম নিজ নিজ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,
عن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "إذا جاء رمضان فُتحت أبواب الجنة وغُلّقت أبواب النار وصُفدت الشياطين" [أخرجه البخاري 1898، 1899، ومسلم 1079].
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রমজান আসলে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানদের বন্দি করে নেওয়া হয়। (বোখারী ১৮৯৮ ও মুসলিম ১০৭৯)
হাদিসটি বরকতময় এ মহান মাসের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করছে,
এক.
এ মাসে জান্নাতের সবগুলো দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কারণ, নেক আমল যা জান্নাতে প্রবেশের উপলক্ষ্য হিসাবে বিবেচিত, এ মাসেই তা অধিক পরিমাণে সম্পাদন করা হয়। । যেমন আল্লাহ বলেন,
 {ادخلوا الجنة بما كنتم تعملون} [النحل 32].
তোমরা যে আমল করতে তার বিনিময়ে জান্নাতে প্রবেশ কর। (নাহল:৩২)
দুই.
এ মাসে জাহান্নামের সবগুলো দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, জাহান্নামে প্রবেশের কারণ গুনাহ ও অবাধ্যতার কাজ এ মাসে হ্রাস পায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
: {فأما من طغى * وآثر الحياة الدنيا * فإن الجحيم هي المأوى} [النازعات 37 ـ 39 ]
সুতরাং যে সীমালঙ্ঘন করে, আর দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দেয়, নিশ্চয় জাহান্নাম হবে তার আবাসস্থল। (নাযিআত:৩৭-৩৯)
অন্যত্র বলেন,
{ومن يعص الله ورسوله فإن له نار جهنم خالدين فيها أبدا} [الجن: 23].
আর যে আল্লাহ ও তার রাসূলকে অমান্য করে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। তাতে তারা চিরস্থায়ী হবে। (সূরা জিন: ২৩)
তিন.
এ মাসে শয়তানদের বন্দি করে নেওয়া হয়। ফলে অন্যান্য মাসের ন্যায় রমজানে তারা মুসলমানদের ধোঁকা দিয়ে প্রতারিত করতে পারে না। নেক কাজ থেকে সরিয়ে অন্যায় ও পাপ কাজে লিপ্ত করতে পারে না। এ মুবারক মাসে তাদেরকে বন্দি করে মূলত: মুসলমানদের উপর দয়া করা হয়, আল্লাহর করুণার দ্বার অবারিত করে দেওয়া হয়। যাতে তারা অধিক পরিমাণে নেক কাজ করতে পারে। এবং পূর্বে কৃত মন্দকাজের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।
এ মাসের আরো একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এ মাসে সম্পাদিত নফল অন্য মাসের ফরজের সমান। আর একটি ফরজ অন্য মাসের সত্তরটি ফরজের সমান। এ মাসে রোজাদারকে ইফতার করালে, গুনাহ মাফ ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এবং রোজাদারের সাওয়াব একটুও হ্রাস না করে সমপরিমাণ সাওয়াব তাকে প্রদান করা হয়।
এগুলো সবই কল্যাণ, বরকত ও সুযোগ, যা এ মাসের আগমনের সাথে সাথে মুসলমানদের দ্বারে এসে উপস্থিত হয়। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত একে একান্ত আনন্দচিত্তে গ্রহণ করা। আমলের ব্যাপারে পারস্পরিক ঈর্ষা ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করা। এ সুযোগ প্রাপ্তির জন্য মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। তাঁর প্রশংসা করা। অধিক পরিমাণে নেক কাজ সম্পাদন করে লাভবান হবার তাওফিক চাওয়া। তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করা। নিশ্চয় এটি একটি মহান মাস। মর্যাদাপূর্ণ মৌসুম। মহান আল্লাহর পক্ষ হতে উম্মতে ইসলামিয়ার জন্য বহু বরকত ও কল্যাণময় দান।
হে আল্লাহ আমাদেরকে এর বরকত পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করার তাওফিক দান কর। তা থেকে লাভবান হতে সাহায্য কর। তুমিইতো শ্রোতা ও জবাব দাতা। সকল প্রশংসা তোমারই, হে বিশ্ব জগতের মহান প্রতিপালক।
চতুর্থ পাঠ: রমজানের মূল্যবান মুহূর্তগুলো কি কি কাজে ব্যয় করা উচিৎ
পূর্বেই আলোচনা হয়েছে, এ মাসের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যার জন্য মহান আল্লাহ এ মাসকে নির্ধারণ করেছেন। এ মাস কল্যাণ ও বরকতের মৌসুম। নেক আমল সম্পাদনের মৌসুম।
হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান পাবার জন্য আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন। রজব মাস আসলে তিনি এ বলে দোয়া করতেন।
: "اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان"
[ أخرجه البيهقي في شعب الايمان 7/398 رقم 3534، والبزار في مسنده 1/294ـ295 رقم 616 ـ كشف الأستار، وأبو نعيم في الحلية 6/269، وابن عساكر كما في كنز العمال رقم 18049 وضعفه الألباني في ضعيف الجامع رقم 4395 وكذا ضعفه محقق الشعب].
অর্থাৎ, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌হে আল্লাহ রজব ও শাবানকে আমাদের জন্য বরকতময় কর এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।,
(বাইহাকি/শুআবুল ঈমান, হাদিস নং ৩৫৩৪, বাযযার/মুসনাদ ৬১৬, প্রমূখ। আল্লামা আলবানি রহ. এ হাদিসকে জয়ীফ বলে মন্তব্য করেছেন, জয়ীফ আল-জামে হাদিস নং ৩৯৫ )
নবীজী নিজ সাহাবাদেরকে এ মাসের আগমনে সুসংবাদ প্রদান করতেন এবং তাদেরকে এর বৈশিষ্ট্যাবলি বর্ণনা করে শুনাতেন। বলতেন,
"أيها الناس قد أظلكم شهر عظيم مبارك"
অর্থাৎ, হে লোক সকল! এক মহান বরকতময় মাস তোমাদের উপর ছায়া ফেলেছে।
[فعن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: "أتاكم رمضان شهر مبارك، فرض الله عز وجل عليكم صيامه، تفتح فيه أبواب السماء وتغلق فيه أبواب الجحيم، وتغل فيه مردة الشياطين، لله فيه ليلة خير من ألف شهر، من حرم خيرها فقد حرم"  أخرجه أحمد 2/230، 425 وعبد بن حميد في المنتخب رقم 1429 والنسائي 4 / 129]..
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌তোমাদের নিকট রমজান এসেছে, বরকতময় এক মাস। আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর এর রোজা ফরজ করছেন। এ মাসে আকাশের সবগুলো দরজা খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের সবকটি দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুষ্ট-অবাধ্য শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এতে রয়েছে এমন এক রজনী, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয় সে (সর্বৈবভাবে) বঞ্চিত হয়। {বর্ণনায় আহমাদ২/২৩০, আব্দ বিন হুমায়দ, আল-মুন্তাখাব ১৪২৯ এবং নাসায়ী ৪/১২৯}
তিনি তাদেরকে এ মাসে ফরজ কিংবা নফল- সালাত, দান-সদকা, সৎ কাজ, দয়া-অনুগ্রহ, আল্লাহর ইবাদতে ধৈর্য্য ধারণ ইত্যাদি নেক আমল সম্পাদনে শ্রম ব্যয়ে উৎসাহ প্রদান করতেন। আরো উৎসাহ দিতেন মাসের দিবসগুলো রোজার মাধ্যমে আর রজনীগুলো কিয়ামের মাধ্যমে আবাদ করতে। প্রতিটি মুহূর্ত কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহ জিকিরে অতিবাহিত করতে।
সুতরাং শ্রদ্ধেয় পাঠক বৃন্দের নিকট আকুল আবেদন, এ মহিমান্বিত মাসকে উদাসীনতা ও উপেক্ষার মাধ্যমে নষ্ট করা হতে বিরত থাকুন। যেমনটি করে থাকে আত্মপ্রবঞ্চিত, দুর্ভাগা মানুষগুলো। যারা আল্লাহকে ভুলে যাওয়ার কারণে আল্লাহ তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্পর্কেই ভুলিয়ে দিয়েছেন। তাইতো কল্যাণকর মৌসুম অতিবাহিত হয়ে যায় কিন্তু তারা কোনোভাবে উপকৃত হতে পারে না। এর কোনো মূল্য, কোনো মর্যাদাই তারা জানে না।
বহু মানুষ আছে যারা এ মাসকে কেবল ভাল খাবারের মাস হিসাবে জ্ঞান করে থাকে। তাই নিজ চাহিদা পূরণে চেষ্টার ত্রুটি করে না। উন্নত খাদ্য-খাবার, উৎকৃষ্ট সব পানীয় জোগাড়ই তাদের মূখ্য কাজ হয়ে দাড়ায়। অথচ কে না জানে, অধিক পানাহার ইবাদতে বিঘ্নতার সৃষ্টি করে। প্রতিটি মুসলমানের নিকট শরিয়তের দাবিও হচ্ছে, পানাহার যতদূর সম্ভব কম করা যাতে ইবাদতের উদ্যম সৃষ্টি হয়। অধিকহারে ইবাদত করা যায়।
আবার কিছু মানুষ আছে যারা মাহে রমজানকে দিনে ঘুমানো আর রাতে জাগ্রত থাকার মাস হিসাবে জ্ঞান করে থাকে। ফলে দিনের বেলা ঘুমিয়ে কাটায় আর রাত অতিবাহিত করে অহেতুক ও ক্ষতিকর সব কাজে। সারা রাত জাগ্রত থাকার ফলে পূর্ণ দিন ঘুমোয়। জামাত বরং সময় মত নামাজের পর্যন্ত গুরুত্ব থাকে না।
কেউ কেউ আছে, রকমারী সব খাদ্য-খাবার নিয়ে ইফতার করতে বসে আর জামাতের সাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করার কথা খেয়াল থাকে না বরং সে দিকে কোনো গুরুত্বই থাকে না।
এসব মানুষের কাছে মাহে রমজানের কোনো গুরুত্ব নেই। করণীয় কর্তব্যে অবহেলা ও অবৈধ কাজ সম্পাদন করে এ মাসের সম্মানহানি হতে বাঁচার কোনো তাগিদই তাদের নেই। এরা রমজানকে কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যের মৌসুম হিসাবেই দেখে থাকে। সম্পদ আহরণ ও পার্থিব ঐশ্বর্য্য কামানোর মোক্ষম সুযোগ হিসাবেই বিবেচনা করে। ফলে কেনা-বেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মসজিদ ছেড়ে বাজারকেই ঠিকানা হিসাবে বেচে নেয়। মসজিদে যদি যায়ও কিন্তু খুব তাড়াহুড়া করে। মোটেও অপেক্ষা করতে চায় না। কারণ বাজারেই তারা হৃদয় তরীর নোঙ্গর ফেলেছে। সেখানেই তাদের আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে।
এমনও কিছু মানুষ আছে রমজান মাস যাদের নিকট মসজিদ, হাট-বাজার রাস্তা-ঘাটসহ জন সমাগমের স্থানসমূহে ভিক্ষাবৃত্তির মাস বলে পরিগণিত। ফলে তারা এ মাসকে অতিবাহিত করে এখানে সেখানে যাওয়া-আসা, এ শহর থেকে অন্য শহরে সফর এবং এ স্থান থেকে ঐ স্থানে ছুটাছুটি করে ভিক্ষাবৃত্তি ও সম্পদ আহরণের ধান্ধায়। তারা মূলত: অভাবহীন এবং সুস্থ সবল। কিন্তু মানুষের কাছে নিজেদেরকে উপস্থাপন করে দরিদ্র-অভাবী, সহায়-সম্বলহীনরূপে। আল্লাহ প্রদত্ত সুস্থতা ও অভাবহীনতার মত অমূল্য নিয়ামত অস্বীকার করে তারা সম্পদ আহরণ করে অনুনোমোদিত ও অবৈধ পন্থায়। মহা মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট করে মহা ক্ষতিকর কাজে । এ শ্রেণীর লোকের কাছে রমজানের কোনো মূল্য ও বৈশিষ্ট্যই অবশিষ্ট থাকে না।
হে আল্লাহর বান্দাবৃন্দ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী সম্বন্ধে কম-বেশি আমাদের সকলেরই জানা আছে। সমস্ত সৃষ্টিকুলের মাঝে আল্লাহর সর্বাধিক ইবাদত সম্পাদনকারী ব্যক্তি নি:সন্দেহে তিনিই। সারা বছর প্রতিটি মুহূর্ত তিনি মহা মহিমের ইবাদতে কাটাতেন। ইবাদতই ছিল তাঁর জীবনের প্রধান কাজ। তা সত্ত্বেও রমজান মাসে তিনি অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক প্ররিশ্রম করতেন। নিবিষ্ট মতে ইবাদতের জন্য এ মাসে অন্যসব ব্যস্ততা কমিয়ে দিতেন যা মূলত: ইবাদতই ছিল। উত্তম কাজ হতে অবসর হয়ে অতি উত্তম কাজে মনোনিবেশের উদ্দেশেই এমনটি করতেন।
সালাফে সালেহীনরাও নবী আদর্শের অনুবর্তিতায় আধ্যাত্মিক উন্নতি ও মাওলা সুবহানাহুর সান্নিধ্য-সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত-আনুগত্যে এ মাসকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। নেক আমল সম্পাদনের লক্ষ্যে অন্যান্য ব্যস্ততা কমিয়ে দিতেন। রাতগুলো তাহাজ্জুদ আর দিনগুলো রোজা, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে আবাদ করতেন। এসব আমলের মাধ্যমে মসজিদগুলো থাকত সদা সজীব। প্রতিটি স্থান হতে রাহমানুর রাহীমের জিকিরের গুঞ্জরণ প্রতিধ্বনিত হত। এ যেন নির্মল এক বেহেস্তি পরিবেশ।
তাদের সাথে আমরা আমাদের অবস্থা একটু তুলনা করে দেখিতো। এ মাস সম্বন্ধে আমাদের অনুভূতি কি? কত টুকু নাড়া দিতে পেরেছে আমাদেরকে এ মাস?
সম্মানিত ভ্রাতৃবৃন্দ! এ মাসে নেক আমলের প্রতিদান বৃদ্ধি করে দেওয়া হয় ঠিক। একইভাবে পাপকাজের শাস্তিও কিন্তু কঠিন করে দেওয়া হয়। সুতরাং আমাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিৎ। সম্মান প্রদর্শন করা উচিৎ তাঁর নিদর্শনসমূহকে।
{ومن يعظم حرمات الله فهو خير له عند ربه} [الحج 30].
আর কেউ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র বিষয়সমূহকে সম্মান করলে তার রবের নিকট তা-ই তার জন্য উত্তম। (সূরা হাজ, আয়াত ৩০)
আল্লাহ আমাদের সকলকে নেক কথা ও কাজে ব্যস্ত হবার তাওফিক দান করুন। শত কোটি দরূদ ও সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।
পঞ্চম পাঠ: রোজার শুরু ও শেষ সময়
আল্লাহ তাআলা বলেন,
{أحل لكم ليلة الصيام الرفث إلى نسائكم هن لباس لكم وأنتم لباس لهن علم الله أنكم كنتم تختانون أنفسكم فتاب عليكم وعفا عنكم فالآن باشروهن وابتغوا ما كتب الله لكم وكلوا واشربوا حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر ثم أتموا الصيام إلى الليل} [البقرة 187].
সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছেতারা তোমাদের জন্য পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের জন্য পরিচ্ছদআল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা নিজদের সাথে খিয়ানত করছিলেঅতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবূল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেনঅতএব, এখন তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা অনুসন্ধান করআর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়অতঃপর রাত পর্যন্ত সিয়াম পূর্ণ কর। {সূরা বাকারা:১৮৭}
আল্লাহ তাআলা আয়াতটিতে রোজার শুরু ও শেষ সময় সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বর্ণনা দিয়েছেন। এতই সুস্পষ্ট যে প্রতিটি মানুষ অতি সহজে বুঝতে পারবে। রোজা শুরু হবে সুবহে সাদিক উদিত হলে আর শেষ হবে সূর্য অস্ত গেলে। অন্যভাবে বললে, রোজার শুরু সময় হচ্ছে, সুবহে সাদিক উদিত হওয়া আর শেষ সময় সূর্য অস্ত যাওয়া। যেমনি করে তিনি রোজার মাসের সূচনা সময়টিও নির্ধারণ করেছেন প্রতিটি মানুষের বোধগম্য করে খুবই স্পষ্ট নির্ধারণীর মাধ্যমে। আর তা হচ্ছে, চাঁদ দেখা যাওয়া কিংবা পূর্ববর্তী শাবান মাসকে ত্রিশ দিনে পূর্ণ করা। আমাদের দ্বীন-ইসলাম আসলেই একটি সহজ ও বোধগম্য দ্বীন। সকল শ্রেণীর সকল পেশার মানুষই তা অনায়াসে পালন করতে পারে।
{وما جعل عليكم في الدين من حرج} [الحج 78]
দ্বীনের ব্যাপারে তিনি তোমাদের উপর কোনো কঠোরতা আরোপ করেননি। {সূরা হজ্:৭৮}
সুতরাং সকল প্রশংসা কেবল আল্লাহর জন্য। একটি উল্লেখ যোগ্য সময় পর্যন্ত রোজা অতি দীর্ঘ থাকার পর এ সহজীকরণ আল্লাহর পক্ষ হতে তাঁর বান্দাদের জন্য (বিশেষ নেয়ামত স্বরূপ) বিধিত হয়েছে ।
ইমাম বোখারি রহ. বারা রা. থেকে উদ্ধৃত করেছেন,
كان أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم إذا كان الرجل صائما فحضر الإفطار فنام قبل أن يفطر لم يأكل ليلته ولا يومه حتى يمسي، وأن قيس بن صرمة الأنصاري كان صائما، وفي رواية كان يعمل في النخيل بالنهار وكان صائما، فلما حضر الإفطار أتى امرأته فقال لها: أعندك طعام، قالت له: لا ولكن أنطلق فأطلب لك، وكان يومه يعمل، فغلبته عيناه فجاءته امرأته فلما رأته قالت: خيبة لك أنمت؟ فلما انتصف النهار غشي عليه فذكر ذلك للنبي صلى الله عليه وسلم، فنزلت هذه الآية: {أحل لكم ليلة الصيام الرفث إلى نسائكم} [البقرة 187] ففرحوا فرحا شديدا، ونزلت: {وكلوا واشربوا حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر} [البقرة 187] [أخرجه البخاري رقم 1915].
অর্থাৎ, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিদের অবস্থা ছিল যখন তাদের কেউ রোজা রাখতেন আর ইফতার করার পূর্বেই ঘুমিয়ে যেতেন, তখন তিনি সে রাত ও পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে থাকতেন। কায়স বিন সিরমাহ নামক জনৈক আনসারি রোজা ছিলেন। কোনো কোনো রেওয়ায়াতে এসেছে, তিনি দিনের বেলায় খেজুর বাগানে কাজ করতেন। ইফতারের সময় হলে তিনি স্ত্রীর নিকট এসে খাবার চেয়ে বললেন, তোমার নিকট কোনো খাবার আছে কি? স্ত্রী বললেন: না, তবে তালাশ করে দেখি কিছু পাই কি না? তিনি দিনে কাজ করেছেন, তাই ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন। স্ত্রী ফিরে এসে তাকে (ঘুমন্ত) দেখতে পেয়ে বললেন, আ-হা-রে... ঘুমিয়ে গেলেন? পরদিন দুপুরে তিনি বেহুশ হয়ে পড়লেন। এ ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়, {أحل لكم ليلة الصيام الرفث إلى نسائكم} [البقرة 187] অর্থাৎ, সিয়ামের রাতে তোমাদের জন্য তোমাদের স্ত্রীদের নিকট গমন হালাল করা হয়েছে। {বাকারা:১৮৭} এতে সাহাবারা খুবই আনন্দিত হলেন। আরো নাযিল হল,
{وكلوا واشربوا حتى يتبين لكم الخيط الأبيض من الخيط الأسود من الفجر} [البقرة 187]
আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। {সূরা বাকারা:১৮৭} {বোখারি:১৯১৫}

বোখারিতেই বারা রা. থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রমজানের রোজার বিধান নাযিল হলে লোকেরা পূর্ণ রমজান মাস স্ত্রীদের নিকটবর্তী হতো না। তবে কিছু লোক এ ব্যাপারে নিজেদের সাথে খিয়ানতে প্রবৃত্ত হলেন। তখন আল্লাহ নাযিল করলেন,
{علم الله أنكم كنتم تختانون أنفسكم فتاب الله عليكم وعفا عنكم} [البقرة 187]
আল্লাহ জেনেছেন যে, তোমরা নিজদের সাথে খিয়ানত করছিলেঅতঃপর তিনি তোমাদের তাওবা কবূল করেছেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করেছেন। [সূরা বাকারা:১৮৭], {বোখারি:৪৫০৮}
خان واختان এর অর্থ একই। অর্থাৎ, তোমরা রোজার রাত্রিতে মেলা-মেশার মাধ্যমে নিজেদের সাথে খেয়ানত করতে। এরপর তোমাদের তাওবা করার পূর্বেই আল্লাহ তোমাদের তাওবা কবুল করেছেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। এ অপরাধে তোমাদের পাকড়াও করেননি। বরং ব্যাপারটি খুবই সহজ করে দিয়েছেন। সূর্যাস্ত থেকে পরদিন সুবহে সাদিক উদিত হওয়া অবধি পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বৈধ করে দিয়েছেন। এখন থেকে সুবহে সাদিক হতে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপরি উক্ত তিন বস্তু (খাওয়া, পান করা ও স্ত্রী সহবাস) ও রোজা পরিপন্থী বিষয়গুলো থেকে রোজাদার বিরত থাকলেই চলবে।
কারণ আল্লাহ বলছেন, {ثم أتموا الصيام إلى الليل} [البقرة 187]অত:পর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ কর।
তাই সূর্যাস্ত নিশ্চিত হয়ে রাত শুরু হবার সাথে সাথে রোজা শেষ হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
: "إذا أقبل الليل من ههنا وأدبر النهار من ههنا وغربت الشمس فقد أفطر الصائم" [أخرجه البخاري رقم 1954 ومسلم رقم 1100].
যখন রাত এ দিক হতে আসে, দিন এ দিক হতে যায় আর সূর্য অস্ত যায় তখন রোজাদারের ইফতার হয়ে যায়। [ বোখারি ১৯৫৪ ও মুসলিম ১১০০]
কিছু লোক ইফতার ও সেহরি বিষয়ে শরয়ি দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করে। তাদের একদল বরং বলতে গেলে অনেকেই রাত জাগরণ করে, রাতের শেষ ভাগে এসে ঘুমানোর ইচ্ছা হলে ফজরের পূর্বে সেহরি খেয়ে নেয়। এরপর ঘুমিয়ে পড়ে আর ফজরের নামাজ সময়মত জামাতে পড়া হয় না। এর মাধ্যমে তারা অনেকগুলো ভুল-ভ্রান্তির শিকার হয়।
এক. তারা নির্ধারিত সময়ের আগেই রোজা পালন শুরু করে।
দুই. জামাতের সাথে ফজরের নামাজ ছেড়ে দেয়।
তিন. নামাজ সময় মত আদায় করে না। বরং ঘুম ভাঙ্গার পর আদায় করে। এতে করে কখনো কখনো জোহরের সময় হয়ে যায়।
কিছু কিছু বেদআতি সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে (সময় মত) ইফতার না করে তারকা উজ্জ্বল হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করে।


ষষ্ঠ পাঠ : রোজার নিয়ত করার বিধান
রোজার নিয়ত করা জরুরি এতে কোন সন্দেহ নেই।  প্রতিটি ইবাদতে যেমন নিয়ত করা শর্ত তেমনি রোজাতেও নিয়ত করা ফরজ এবং রোজা সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত। নিয়ত ছাড়া রোজা সহীহ হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন - 
"إنما الأعمال بالنيات وإنما لكل امرئ ما نوى"
নিশ্চয় সমস্ত আমল নিয়তের উপরই নির্ভরশীল আর প্রতিটি ব্যক্তিই যা নিয়ত করে তাই সে পায়।
নিয়তের পদ্ধতি : রোজা আদায়ে ইচ্ছুক ব্যক্তি রোজা শুরু করার সময় অন্তরে উপস্থাপন করবে যে, আমি রমজানের রোজা রাখছি অথাব ক্বাজা রোজা রাখছি কিংবা মান্নত বা কাফ্ফারার রোজ রাখছি।
নিয়ত করার সময়: যে প্রকারের রোজাই হোক না কেন নিয়ত রাত থেকেই করতে হবে। রাতের প্রথম অংশে হতে পারে, মাঝের অংশে হতে পারে অথবা শেষাংশেও হতে পারে। ‍‍‍‍‍‍‍‍‍
আয়েশা রা. হতে মারফু হাদিস বর্ণিত -যে ব্যক্তি সুবহে সাদেক উদয় হওয়ার পূর্বে-রাতেই রোজার রাখা স্থির করে না, তার রোজা বিশুদ্ধ হয় না। ( দারা কুতনি : ১৭২/২, বাইহাকি ২০২/৪ তিনি বলেন হাদিসটির সকল বর্ণনা কারিই নির্ভরযোগ্য)
ইবনে ওমর রা. হাফসা রা. হতে এবং তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
"من لم يبت الصيام قبل الفجر فلا صيام له"
 যে ব্যক্তি সুবহে সাদেক উদয় হওয়ার পূর্বে-রাতেই রোজা রাখা স্থির করে না তার রোজা বিশুদ্ধ হয় না।( আহমাদ ২৮৭/৬, তিরমিজি ৭৩০ আবু দাউদ ২৪৫৪)

এ ছাড়া রোজা সাধারণত: দিন ব্যাপিই হয়ে থাকে এবং পূর্ণ দিন রোজা রাখাই হলো ওয়াজিব। এখন যদি দিনের কিছু অংশ রোজার নিয়ত করা ছাড়া অতিবাহিত হয়ে যায়, তখন এ কথা বলা সহীহ হবে না যে, লোকটি পূর্ণ দিন রোজা রেখেছে। কারণ, নিয়ত কখনো যা অতিবাহিত হয়েছে তাকে ইবাদতের অন্তর্ভূক্ত করতে পারে না। যখন থেকে নিয়ত করে তখন থেকেই তার কার্যকারিতা শুরু বলে বিবেচিত হয়।
নিয়তের স্থান হল মানুষের অন্তর। সকল ইবাদতের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য। সুতরাং নিয়ত অন্তরেই করবে, মুখে উচ্চারণ করার কোন প্রয়োজন নেই। মুখে উচ্চারণ করা বরং শরিয়ত পরিপন্থি। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সাহাবিদের কারো থেকে এ ধরনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি যে, তারা কখনো বলেছেন نويت أن أصوم বা نويت أن أصلي ইত্যাদি। সুতরাং নিয়ত মুখে উচ্চারণ করা বিদআত । রোজার নিয়তে সেহর- ইফতার খাওয়াই যথেষ্ট। এতে রোজা আদায় হয়ে যাবে।
শায়খ তকি উদ্দিন ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‍‍‌রোজাদার যখন রাতের খাবার খায় রোজা রাখার ইচ্ছায়ই খায়। এ কারেণইতো রমজানের রাতের খাওয়া এবং ঈদের রাতের খাওয়ার মধ্যে প্রার্থক্য করে। তিনি আরো বলেন, যে ব্যক্তি জানতে পারে যে, আগামি কাল রমজান এবং সে রোজা রাখার ইচ্ছা করে, এতেই তার নিয়ত হয়ে যায়। আলাদাভাবে নিয়ত করার প্রয়োজন নেই। যুগ যুগ ধরে মুসলমানদের আমল এ রকমই চলে আসছে।,
নফল রোজার নিয়ত: নফল রোজার নিয়ত দিনের বেলায়ও করা জায়েয আছে। তবে শর্ত হচ্ছে সুবহে সাদেক থেকে নিয়ে নিয়তের সময় পর্যন্ত রোজার পরিপন্থি কোন কাজ যথা খাওয়া পান করা ইত্যাদি তার থেকে সংঘটিত হতে পারবে না। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত,
"دخل عليَّ النبي صلى الله عليه ذات يوم فقال "هل عندكم من شيء ؟" فقلنا: لا، قال "فإني إذاً صائم" رواه الجماعة إلا البخاري، [أخرجه مسلم رقم 1154].
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট প্রবেশ করে বললেন, তোমার নিকট খাওয়ার কোন কিছু আছে কি? আমরা বললাম: না,  তখন রাসূলুল্লাহ বললেন, তাহলে আমি রোজা রাখলাম।
(হাদিসটি ইমাম বুখারি ছাড়া সবাই বর্ণনা করেছেন। ( মুসলিম, হাদিস নং - ১১৫২)  
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাবার চাওয়া দ্বারা প্রমাণিত হয় তিনি ইতি পূর্ব হতে রোজা রাখার নিয়ত করেননি। আর তাঁর  "فإني إذا صائم"  বলা প্রমাণ করে, তিনি রোজা আরম্ভ করেছেন দিনের বেলা হতে। এতে বুঝা যায় নফল রোজার নিয়ত দিনের বেলা করলেও চলবে। সুতরাং এ হাদিসটি পূর্বে উল্লেখিত হাদিস-
 "من لم يبت الصيام قبل طلوع الفجر فلا صيام له"
জন্য খাসকারী। অর্থাৎ সে হাদিসটি ফরজ রোজার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে নফল রোজার ক্ষেত্রে নয়। 
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন- নফল রোজা দিনের বেলা নিয়ত করার মাধ্যমে সহিহ হবে। এ বিষয়টি যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী "إني إذاً صائم"দ্বারা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া আরও প্রমাণ করে যে, নফলের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা ফরজের তুলনায় বেশি । যেমন ফরজ নামাজ দাড়ানো এবং জমিনে ভালোভাবে স্থির হওয়া ব্যতিত সহিহ হয় না। আর নফল নামাজে এগুলো আবশ্যিক নয় । নফল সালাত বসে ও বাহনের উপর আরোহণ করে উভয় অবস্থায় সহিহ। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ যে তিনি নফলের ব্যাপারটি প্রশস্ত করেছেন। এ কারণে দেখা যায় নফল ইবাদতের ক্ষেত্রে ফরজের তুলনায় আমাদের জন্য অনেকটা শৈথিল্য দেখানো হয়েছে।   
নফল রোজার নিয়ত দিনের বেলায় করার বিষয়টি একাধিক সাহাবি হতে বর্ণিত হয়েছে, যেমন,  আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, মুয়াজ বিন জাবাল, হুজাইফা, আবু তালহা, আবু হুরায়রা ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. প্রমুখ।
সপ্তম পাঠ : রমজানের রোজা যাদের উপর ওয়াজিব
স্মর্তব্য যে, রমজান মাসের রোজা ইসলামের অন্যতম একটি ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন
 {يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام} [البقرة183] إلى قوله {فمن شهد منكم الشهر فليصمه} [البقرة 185]،
হে ঈমানদারগণ তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে।(সূরা বাকারা:১৮৩ ) -থেকে নিয়ে- অতঃপর তোমাদের কারো নিকট রমজান উপস্থিত হলে সে যেন রোজা রাখে। (বাকারা:১৮৫)
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
"بني الإسلام على خمس: شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمد رسول الله، وإقام الصلاة وإيتاء الزكاة، وصوم رمضان، وحج البيت من استطاع إليه سبيلا" متفق عليه [أخرجه البخاري رقم 8 ومسلم رقم 16]
ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের উপর রাখা হয়েছে, এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। সালাত কায়েম করা। জাকাত প্রদান করা। রমজানের রোজা রাখা। বাইতুল্লাহর হজ করা যে তার সামর্থ রাখে। ( বুখারি-৮ মুসলিম-১৬)
আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় রোজা ফরজ। আর হাদিস দ্বারা বুঝা যায়, রোজা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুকন। সকল মুসলমান এ বিষয়ে একমত যে, রমজানের রোজা ফরজ। যে অস্বীকার করবে সে কাফের ও মুরতাদ বলে গণ্য হবে। তাকে তাওবা করতে বলা হবে, যদি তাওবা করে ভাল, অন্যথায় হত্যা করা হবে । প্রতিটি মুসলমানের ওপরই রমজানের রোজা ফরজ।
যদি কোন ব্যক্তি রমজান মাসে ইসলাম গ্রহণ করে তাকে অবশ্যই অবশিষ্ট দিনগুলো রোজা রাখতে হবে। তবে মাসের শুরু হতে যে সব রোজা ছুটে গেছে সেগুলোর কাজা করা ওয়াজিব নয়। রোজা সাধারণত:  প্রাপ্ত বয়স্কদের উপরই ওয়াজিব । নাবালেগ-অপ্রাপ্ত বয়স্কদের উপর ওয়াজিব নয়। আর কিশোর বাচ্চা যে ভালো মন্দের বিচার করতে পারে, তার জন্য রোজা ওয়াজিব নয়। তবে সে রোজা রাখেলে তা নফল হবে। আর প্রতিটি অভিভাবকের উচিত রোজা রাখতে সক্ষম বাচ্চাকে রোজা রাখার প্রতি উৎসাহিত করা, নির্দেশ দেয়া। যাতে তার অভ্যাস গড়ে উঠে। পাগলের উপর রোজা রাখা ওয়াজিব নয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :  তিন ব্যক্তি হতে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে একজন হল পাগল যতক্ষণ না তার চেতনা ফিরে আসে। 
মোট কথা, রোজা প্রাপ্ত বয়স্ক সকল সুস্থ-সক্ষম ও নিজ বাড়িতে অবস্থানকারী-মুকিম মুসলমানের উপর আদায় হিসাবে ওয়াজিব হয়। অসুস্থ হলে তার উপর কাজা হিসেবে ওয়াজিব হয়। অর্থাৎ সুস্থ হওয়ার পর তাকে অবশ্যই রোজার কাজা করতে হবে। অনুরূপভাবে হায়েজ-নিফাসবতী নারীদের উপর রোজার কাজা ওয়াজিব। আর মুসাফিরকে রোজা রাখা ও না রাখার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। রোজা রাখতেও পারবে আবার ইফতারও করতে পারবে। তবে না রাখলে পরে কাজা করতে হবে।
কোন ব্যক্তি দিনের বেলা রোজা রাখার উপযুক্ত হয়েছে অর্থাৎ তার উপর রোজা ফরজ হয়েছে। যেমন রোজার দিনে কাফের ইসলাম গ্রহণ করেছে, বাচ্চা বালেগ হয়েছে, কোন নারী হায়েজ নেফাস হতে পবিত্র হয়েছে, অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থতা লাভ করেছে, মুসাফির সফর থেকে ফিরে এসেছে, পাগল ভালো হয়ে গিয়েছে, এবং দিনের বেলায় রমজানের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হয়েছে। এদের বিধান হলো তারা দিনের অবশিষ্ট অংশে পানাহার করতে পারবে না। খানা পিনা হতে বিরত থেকে দিনের বাকী অংশ অতিবাহিত করতে হবে। এবং পরে কাজা করতে হবে। কারণ, দিনটি হচ্ছে শরিয়তের পক্ষ হতে রোজার জন্য নির্দিষ্ট। কোন কারণ বশত:  তারা সহিহভাবে রোজ রাখতে পারে নি, তাই পরে কাজা করে নিবে। আর পানাহার থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে রমজান মাসের সম্মান রক্ষার্থে।
প্রতিটি মুসলমানের উপর অপরিহার্য্য কর্তব্য হচ্ছে, দ্বীন ও দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া। বিশেষ করে যে সব রূকনের উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত। যেমন রোজা, এ মহান ইবাদতটি একজন মুসলমানের জীবনে বছরে একবার করে আসে। পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে কিছু এমন যা প্রতিটি মুহূর্তে একজন মুসলমানের জন্য জরুরি। যেমন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ মর্মে সাক্ষ্য দেয়া, অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। এ দুটি শাহাদাত প্রতিটি মুসলমানের জন্য অনিবার্য। এ থেকে কোন মুসলামান এক মুহূর্তের জন্যও পৃথক হতে পারে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যা একজন মুসলমানের জীবনে দৈনিক পাঁচবার করে ফিরে আসে। কিছু ইবাদত আছে এমন যা বছরে একবার আসে যেমন জাকাত ও রোজা। আবার কিছু আছে এমন যা সারা জীবনে মাত্র একবার আসে। যেমন হজ। প্রতিটি মুসলমান এ সকল আহকামের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
এখানে কিছু আহকাম এমন আছে যেগুলো শুধু দৈহিক ইবাদত বলে গণ্য যেমন দুই শাহাদাত ও নামাজ রোজ। কিছু আর্থিক ইবাদত বলে বিবেচিত যেমন জাকাত। আবার  কিছু আছে যা দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের সংমিশ্রণে বাস্তবায়িত হয়, যেমন হজ।
সকল ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় আবশ্যক। নিয়ত খালেছ থাকতে হবে। কারণ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,   
"إنما الأعمال بالنيات وإنما لكل امرئ ما نوى"
নিশ্চয় সমস্ত আমল নিয়তের উপরই নির্ভরশীল আর প্রতিটি ব্যক্তি যা নিয়ত করে তাই পাবে।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, উক্ত ইবাদত আদায় করতে হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের অনুবর্তিতায়।  হাদিসে এসেছে,  যে ব্যক্তি এমন আমল করল যে ব্যাপারে আমাদের কোন নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। ( বুখারি, মুসলিম ও আহমাদ)
সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের আবশ্যিক কর্তব্য হল, সে ইসলামের রূকনগুলোকে গুরুত্ব সহকারে আদায় করবে এবং নির্ধারিত সময়ে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর তারিকা অনুযায়ী আদায় করবে।
সব শেষে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা হলো, হে আল্লাহ! রোজাসহ আমাদের সকল আমালকে খালেস করো। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে কবুল করে নাও। আর তোমার জিকির, শোকর ও সুন্দর ইবাদতের জন্য আমাদের সহযোগিতা করো।  
অষ্টম পাঠ : রমজানের রোজা যাদের উপর ফরজ নয় এবং তাদের করণীয়...
বিভিন্ন কারণে রমজান মাসে যাদেরকে রোজা না রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এ পর্বে আমরা তাদের আলোচনা করবো। সাথে সাথে তাদের করণীয় কি সে বিষয়েও আলোকপাত  করবো।
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
{يا أيها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون * أياما معدودات فمن كان منكم مريضا أو على سفر فعدة من أيام أخر، } [البقرة 185]
হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যাতে তোমরা মু্ত্তাকি হতে পার। নির্দিষ্ট কিছু দিন। অত:পর তোমাদের কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে তার সময় অন্যান্য দিন।[সূরা বাকারা:১৮৫]
আয়াতে যে সকল মুসলমান রমজান মাস পাবে তাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে যদি কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকে। সুতরাং প্রতিটি মুসলমানের উপর রমজানের রোজা আবশ্যিক। শরয়ি কোন অপারগতার কারণে রোজা রাখতে অক্ষম হলে তাকে সে রোজার কাজা করতে হবে।
যে সব ওজরের কারণে রোজা না রাখা জায়েয
১- অসুস্থতা, রোজার কারণে যদি অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষতি, আরোগ্য লাভ বিলম্বিত কিংবা অসুস্থতা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাহলে তার জন্য রোজা না রাখাই উত্তম। কারণ, আল্লাহ তায়ালা পরম দয়ালু। তিনি তার বান্দাদের কোন কষ্ট দিতে চান না। তাদের  কস্টের প্রতি লক্ষ্য রেখেই আল্লাহ তাদের রোজা না রাখার অনুমতি দিয়েছেন। সুতরাং নিজ বান্দাদের যে সুযোগ তিনি দিয়েছেন তাকে গণিমত মনে করাই শ্রেয়।
২- সফর: সফর অবস্থায় রমজান এসে গেলে অথবা রমজানের মধ্যে সে কোথাও সফরে গেলে, তার জন্য উত্তম হলো রোজা না রাখা। রোজা রাখা তার জন্য কষ্ট হোক বা না হোক। আল্লাহ যেহেতু সুযোগ দিয়েছেন, সুযোগকে কাজে লাগাবে এটিই তার জন্য উত্তম। 
সফরের দূরত্ব: সফরের দূরত্ব আশি কিলোমিটার। পূর্বেকার যুগে মানুষ পায়ে হেঁটে অথবা উটের পিঠে চড়ে স্বাভাবিক গতিতে চললে দুইদিন দুইরাতে আশি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারত। তাই আশি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার পর একজন ব্যক্তি মুসাফির হয়ে যায়।
এ ক্ষেত্রে হঠাৎ সফর করা এবং যারা সবসময় সফরে থাকে তাদের মধ্যে কোন প্রার্থক্য নেই। সুযোগ সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন গাড়ী চালক সে এক দেশ থেকে অন্য দেশে সব সময় সফরে থাকে। সাভাবিকভাবেই সে সব সময় মুসাফির থাকবে এবং তার জন্য রোজা না রাখাই উত্তম। যখন সে মুকিম হবে তখন রোজা রাখবে। মুসাফির রোজার দিনে বাড়ীতে ফিরে আসলে তাকে দিনের বাকী অংশ না খেয়ে থাকতে হবে এবং রোজা কাজা করবে। কোনো মুসাফির নিজ সফরে চার দিনের বেশি থাকার নিয়ত করলে তাকে অন্যান্য মুকিমর মত রোজা রাখতে হবে এবং সালাত পুরোই আদায় করতে হবে। । কারণ, চার দিনের বেশি থাকার নিয়ত করার কারণে তার জন্য সফরের আহকাম বাতিল হয়ে গিয়েছে। আর যদি চার দিন অথবা তার থেকে কম থাকার নিয়ত করে। অথবা কোন কাজে বের হয়েছে কিন্তু জানে না কাজটি কবে শেষ হবে তার জন্য রোজা না রাখা জায়েজ আছে। কারণ তার পক্ষে সফরের বিধান এখনো বলবত রয়েছে ।
৩- হায়েজ-নেফাস, নেফাস ও হায়েজবতী নারীদের উপর স্রাব চলা কালীন রোজা রাখা হারাম। সহিহ বুখারি ও মুসলিমে আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, জনৈকা নারী তাকে জিজ্ঞেস করলো, ঋতুবতি নারী রোজার কাজা করে অথচ সালাতের কাজা করে না। তিনি বললেন, আমাদের রোজা কাজা করার আদেশ দেয়া হয়েছে আর সালাত কাজা করার আদেশ দেয়া হয়নি। (বুখারি:৩২১/৩৩৫)
ঋতুবতী মহিলাদের উপর ঋতুচলা কালিন সময়ে রোজা রাখা নিষেধ এ বিষয়ে উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নত এবং মুসলমানদের ইজমা হল মহিলাদের ঋতুস্রাব রোজার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সুতরাং হায়েজ বা নিফাস অবস্থায় রোজা রাখা জায়েয নয়। কেউ রোজা রাখলে তার রোজ সহিহ হবে না। তিনি বলেন, এটিই যুক্তি সঙ্গত। প্রতিটি বিধানে ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও সমতা বিধান করাই হলো শরিয়তের উদ্দেশ্য। রক্তস্রাবের সময় রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হলে শরীরের ক্ষতি হবে এবং শরীর দুর্বল হয়ে যাবে। এবং তার রোজা সামঞ্জস্যতার স্তর হতে ছিটকে পড়বে। এ কারণে তাকে রক্তস্রাবহীন সাভাবিক সময়ে যখন শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি বিদ্যমান থাকে ছুটে যাওয়া রোজার কাজা করতে বলা হয়েছে। আর সে সময়ের রোজা হবে  সামঞ্জস্যপূর্ণ। বমি রোজার পরিপন্থী নয়। কারণ বমির কোন নির্দিষ্ট সময় নেই যা থেকে সে নিরাপদ থাকতে পারে। 
৪- দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা যা হতে  ভালো হওয়ার আশা করা যায় না এবং রোজা রাখা একে বারেই অসম্ভব।  এমন অসুস্থ ব্যক্তিদের রোজা রাখা জরুরি নয়। তারা প্রতিটি রোজার পরিবর্তে প্রতিদিন একজন করে মিসকিনকে খানা খাওয়াবে। তাদেরকে রোজার কাজা করতে হবে না।
৫- বার্ধক্য: এমন বৃদ্ধ ব্যক্তি যিনি রোজা রাখতে সম্পূর্ণ অক্ষম তার জন্য রোজা রাখা ওয়াজিব নয়। সে প্রতিটি রোজার পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খানা খাওয়াবে তাকে রোজার কাজা করতে হবে না।
(বার্ধক্যে উপনীত ব্যক্তির চেতনা যদি একেবারেই অবশিষ্ট না থাকে তার উপর কোন কিছুই ওয়াজিব হবে না) 
৬- গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলা: রোজার কারণে যদি তাদের নিজেদের অথবা সন্তানদের ক্ষতির আশংকা হয় তাহলে তাদের জন্য রোজা রাখা ওয়াজিব নয়। তবে তারা যে কদিন রোজা রাখেতে পারেনি সে কদিনের কাজা করবে। আর যদি কোন নারী শুধু সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কায় রোজা হতে বিরত থাকে তবে তাকে কাজা করার সাথে সাথে প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খানা খাওয়াতে হবে।
প্রমাণ, আল্লাহ তায়ালা বলেন,
{وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين} [البقرة184].
আর যারা রোজা রাখতে অক্ষম তারা একজন মিসকিনকে খানা খাওয়াবে।
নবম পাঠ : রোজার ফজিলত
হে আমার মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দ, আমরা আপনাদেরকে এ মাসের ফজিলত সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। মহান আল্লাহর কাছে তাওফিক প্রার্থনা করছি, যাতে আমরা রমজানের মহা মূল্যবান মুহূর্তগুলোকে নেক আমালের মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারি। আরো প্রার্থনা করছি হে আল্লাহ তুমি আমাদের থেকে তা কবুল করে নাও এবং আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দাও।
আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমলের বিনিময় দশগুণ থেকে সাতশতগুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেয়া হয়। আল্লাহ বলন, কিন্তু রোজা তার ব্যতিক্রম, কারণ সেটি কেবলমাত্র আমার জন্যই রাখা হয় আর তার বিনিময় আমিই দিব। সে আমার কারণেই তার প্রবৃত্তিগত চাহিদা ও পানাহার ত্যাগ করে থাকে। রোজাদারের জন্য দুইটি খুশি, একটি খুশি হলো ইফতারের সময়, আর অপর খুশি হলো আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের সময়। রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম। (বোখারি:১৮৯৪ ও মুসলিম:১১৫১)
এ হাদিস রমজানের ফজিলত ও অন্যান্য আমলের তুলানায় রোজার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপর প্রমাণস্বরূপ।
রোজার বৈশিষ্ট্য:
১. রোজার মধ্যে এখলাস অন্যান্য আমলের তুলনায় বেশি পাওয়া যায়। যেমন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আল্লাহ বলেন সে আমার কারণেই পানাহার ও প্রবৃত্তিগত চাহিদা ত্যাগ করেছে। 
২. আল্লাহ তাআলা সমগ্র আমল থেকে রোজাকেই তার নিজের জন্য নির্বাচন করেছেন  এবং তিনি নিজেই রোজার বিনিময় বলে সুসংবাদ দান করেছেন। তিনি বলেন - রোজা আমার জন্য আর আমিই তার বিনিময় দিয়ে থাকি।
৩. রোজাদারের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতের আনন্দ লাভ। একটি হলো ইফতারের সময় যখন আল্লাহ তাদেরকে পানাহারের অনুমতি দান করেন আর অপরটি হলো আখেরাতে যখন আল্লাহর সাথে তাদের সাক্ষাত হবে। আর এ ধরনের খুশি হলো আল্লাহর আনুগত্যের খুশি তাই একে প্রশংসনীয় খুশিই বলা চলে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন-
{قل بفضل الله وبرحمته فبذلك فليفرحوا} [يونس 85].
বল, এগুলো আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের মাধ্যমে। সুতরাং এ কারণেই তাদের খুশি হওয়া উচিত। [সূরা ইউনুস: ৮৫]
৪. আল্লাহ তাআলা রোজাদারের সম্মানে জান্নাতের একটি দরজা নির্ধারিত করেছেন, যে দরজা দিয়ে কেবল রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে সাহাল বিন সায়াদ হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয় জান্নাতে রাইয়ান নামক একটি দরজা আছে । কিয়ামত দিবসে এ দরজা দিয়ে কেবল রোজাদাররাই প্রবেশ করবে। অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। বলা হবে, রোজাদাররা কোথায়? তখন তারা দাড়াবে এবং  জান্নাতে প্রবেশ করবে। তারা প্রবেশ করার পর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না । [বোখারি ১৮৯৬, মুসলিম ১১৫২]
৫. আল্লাহ তাআলা রোজাদারকে কষ্টদায়ক গুনাহ ও ক্ষতিকর বস্তু হতে হেফাজত করেন। আরো হেফাজত করেন জাহান্নামের আগুন থেকে। যেমন হাদিসে এসেছে। 
الصيام جُنَّة রোজা ঢালস্বরূপ। অর্থাৎ রোজার কারণে মানুষ জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাবে।
রোজার অপর একটি ফজিলত হলো, রোজাদারের দোয়া আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য। যেমন আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একজন রোজাদারের জন্য ইফতারের সময় এমন কিছু দোয়া আছে যা কখনোই রদ করা হয় না। [ইবনে মাজা:১৭৫৩ হাকিম:৪২২]
৬. একজন রোজাদার যাতে বেশি বেশি করে দোয়া করতে থাকে। আল্লাহ তাআলা রোজার বিধান বর্ণনার ক্ষেত্রে মাঝে একটি আয়াতে বলেছেন,
وإذا سألك عبادي عني فإني قريب أجيب دعوة الداع إذا دعان} [البقرة 186]
আমার বান্দারা আমার সম্বন্ধে তোমাকে জিজ্ঞেস করলে (বলবে) আমি নিকটেই আছি। প্রার্থনাকারী প্রার্থনা করলে তার প্রার্থনার জবাব দিয়ে থাকি। [সূরা বাকারা: ১৮৬]
৭. রোজা রোজাদারের প্রতিটি আমলকে ইবাদতে পরিণত করেযেমন আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা: হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
রোজাদারের চুপ থাকা তাসবিহ স্বরূপ, তার ঘুম ইবাদত, তার দোয়া গ্রহণযোগ্য আর তার কাজের সাওয়াব অধিক হারে বৃদ্ধি করে দেয়া হবে। (আবু দাউদ, বাইহাকী )
৮. রোজা সবরের একটি অংশরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোজা ধৈর্য্যের অর্ধেক। [তিরমিজি ও ইবনে মাজা] আর ধৈর্য্য সম্বন্ধে মহান আল্লাহ বলেছেন, নিশ্চয় ধৈর্য্যশীলদের বিনিময়-পুরস্কার হিসাব ছাড়া দেয়া হবে।
রোজা সুস্থতা ও সুসাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা রোজা রাখ এবং সুস্থ থাকএ ছাড়াও রোজা রাখার অনেক বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ উপকার আছে যেগুলো এখানে বর্ণনা করে শেষ করা খুব একটা সহজ নয়, তবে বিশেষ বিশেষ কয়েকটি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। সতর্ক ও উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট মনে করছি।

দশম পাঠ : রোজার উপকারিতা
১-: মানবাত্মা পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে সমগ্র ইবাদতের তুলনায় রোজাই সবচেয়ে বেশি উপকারী। রোজার প্রভাব এ ক্ষেত্রে ব্যাপকমানুষের আত্মার পরিশুদ্ধি এবং চারিত্রক গুণাবলির উৎকর্ষতা অর্জনে রোজা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে থাকে
রোজা মানুষের অন্তরে আল্লাহ ভীতি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপাদান এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সকল প্রকার অন্যায় অনাচার হতে বিরত রাখার পাঠশালা
আল্লাহ তাআলা বলেন, হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। [সুরা বাকারা : ১৮৩]
মহান আল্লাহ এ আয়াতে এটিই বলছেন যে, তিনি তার বান্দাদেরকে তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত করার জন্য রোজা ফরজ করেছেন। এতে একথা স্পষ্ট হয় যে, রোজার সাথে তাকওয়ার নিভীড় সম্পর্ক রয়েছে
তাকওয়ার অর্থ:
তাকওয়া এমন একটি শব্দ যার মধ্যে যাবতীয় উত্তম চরিত্র পঞ্জিভূতআল্লাহ তায়ালা তাকওয়া সাথে অসংখ্য কল্যাণ ও উপকারিতা যুক্ত করেছেন
এর গুরুত্ব বিবেচনা করেই আল্লাহ বারবার তাকওয়ার আলোচনা  করেছেন
মনীষীগণ তাকওয়ার ব্যাখ্যায় বলেছেন:-
 فعل أوامر الله، وترك مناهيه، رجاء لثوابه وخوفا من عقابه،
পুরস্কারের আশায় ও শাস্তি হতে বাঁচার জন্য আল্লাহর যাবতীয় আদেশ পালন করা এবং নিষেধগুলো হতে বিরত থাকা।
আল্লাহর বাণী   {لعلكم تتقون} সম্পর্কে ইমাম কুরতবি রহ. বলেন, এখানে لعل  মুমিনদের আশা-আগ্রহ সৃষ্টি আর (تتقون) গুনাহ হতে বিরত থাকার কথা বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছেমানুষের পানাহার হ্রাস পেলে কু-প্রবৃত্তির চাহিদাও হ্রাস পায়। আর কুপ্রবৃত্তির চাহিদা হ্রাস পেলে পাপ-অন্যায়ের আকর্ষণও লোপ পায়।
কারো কারো মতে আয়তের ব্যাখ্যারই প্রয়োজন নেই বরং রোজার দ্বারা মানুষ এমনিতেই মুত্তাকী হতে পারেযেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-- রোজা ঢালস্বরূপ এবং রোজাই তাকওয়ার অন্যতম কারণ
২:- রোজার দ্বারা একজন বান্দার অন্তরে আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি ভালোবাসা এবং গুণাহের প্রতি স্থায়ী  ঘৃণা জন্ম নিতে থাকেফলে রোজা মানুষের চিন্তাধারাকে পরিবর্তনের দিকে ধাবিত করে এবং জীবন চলার পথে তার নৈতিকতা ও আচার আচরণকে পরিবর্তন করে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়
৩:- রোজার মাধ্যমে মানুষের মাঝে ধৈর্য্য ও সহনশীলতা ফিরে আসেকারণ, রোজার কারণে অনেক পছন্দনীয় কাজ ছাড়তে বাধ্য হয় এবং অনেক অনিষ্টকর কাজ হতে দুরে থাকতে হয়রোজার দ্বারা একজন গুনাহগার ব্যক্তি গুনাহ ছাড়তে সাহসী হয়। এবং রোজার কারণে অনেক গুনাহ করা সম্ভবও হয় না। রোজা একজন মানুষকে গুনাহ হতে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ দেয়। ফলে একটি সময় এমন হয় যে, সে আর গুনাহই করে নাযেমন একজন ধূমপায়ীর ধূমপান করতে করতে তার অভ্যাস এমন হয়েছে সে ধূমপান না করলে তার মাথা ঠিক থাকে নাসেও রোজার মাধ্যমে তার এ কুঅভ্যাসটি অনেক সহজে  ত্যাগ করতে পারে। কেননা, রোজা রাখার ফলে সে দীর্ঘ সময় ধূমপানের সুযোগ পায় নাএতে একমাস যাবত ধূমপান ছাড়া থাকার অনুশীলন তাকে করতে হয়অনুরূপভাবে রোজার মাধ্যমে  যাবতীয় গুনাহ থেকেই ইচ্ছা করলে বিরত থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারে।  
রোজা মানুষের অন্তরকে নরম করে এবং আল্লাহর জিকিরের জন্য উর্বর করে
৪:- রোজাদারের জন্য অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগী করা সহজ করে দেয় হয়। আর এ বিষয়টি দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, রোজাদার ব্যক্তিরা রমজান মাসে বেশি বেশি করে ভালো কাজের দিকে অগ্রসর হয়। বছরের অন্য সময় যেসব কাজ করতে তারা কষ্ট অনুভব ও অলসতা করে।
৫:- একজন রোজাদার তার কু-প্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করতে সক্ষমকারণ রমজানের বাইরে কুপ্রবৃত্তি তার উপর বিজয়ী থাকে এবং তাকে অন্যায় ও অশ্লিল কাজের দিকে ধাবিত করতে থাকেআর রমজান আসলে, রমজান তার কুপ্রবৃত্তি লাগাম টেনে ধরে এবং তাকে সত্য ও নৈতিকতার দিকে ধাবিত করে।  
চলমান-২য় পর্ব

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।