একাদশ পাঠ: রোজার আদব
রোজার গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে শরিয়ত নির্ধারিত সময়ে রোজা শুরু করা, তার আগে পরে শুরু না করা। এজন্য রমজান মাস শুরু হওয়ার পূর্বে বা পরে রমজানের রোজা হিসাবে রোজা রাখা যাবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখ এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়। তিনি আরো বলেছেন: তোমরা চাঁদ দেখার আগে রোজা রেখ না এবং চাঁদ দেখা পর্যন- রোজা ছেড় না।
প্রথম হাদিসে চাঁদ দেখে রোজা রাখার আদেশ করা হয়েছে এবং চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ার আদেশ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য রোজার সময়-সীমা দুই চাঁদের মধ্যবর্তী সময়। দ্বিতীয় হাদিসে চাঁদ দেখার আগে রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে এবং চাঁদ দেখার পূর্বে রোজা ছাড়তে নিষেধ করা হয়েছে। এখানে স্পষ্টভাবে নিষেধ করা হয়েছে যে, রমজান মাস আসার পূর্বে রমজানের রোজা রাখা যাবে না কেননা এতে শরীয়তের বরখেলাফ করা হয়। আরো বর্ণিত আছে যে, তোমরা রমজানে পূর্বে রোজা রেখ না। ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমরা রমজান মাস আসার একদিন বা দুদিন পূর্ব থেকে রোজা রেখ না। এজন্য শাবানের উনত্রিশ তারিখে রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। আম্মার থেকে বর্ণিত : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, সন্দেহপূর্ণ দিবসে রোজা রাখল সে যেন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবাধ্যতা করল।
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন : এটাই স্পষ্ট যে, রমজানের পূর্বে রোজা রাখতে নিষেধ করা হয়েছে এবং শরীয়তের মূলনীতিগুলো এর সমর্থন করে। সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে আমল না করা শ্রেয় বরং সতর্কতা হিসাবে আমল ছেড়ে দেয়া মুস্তাহাব।
এতে প্রমাণিত হয় যে, রোজার ক্ষেত্রে সৌর গণনা গ্রহণযোগ্য নয় কেননা এতে সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে আমল করা হয়।
* রোজার আরেকটি আদব হচ্ছে, সেহরী খাওয়া বিলম্ব করা যদি সুবহে সাদেক উদয় হওয়ার সম্ভবনা না থাকে। যায়েদ বিন সাবেত রা. থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন: আমরা রাসূলুল্লাহর সাথে সেহরী খেয়েছি অত:পর নামাজে দাঁড়িয়েছি। বর্ণনাকারী বলেন : আমি বললাম, এর মধ্যে কতটুকু সময় দুরত্ব ছিল। তিনি বলেন: পঞ্চাশ আয়াত পরিমাণ।
আবু যর রা: থেকে বর্ণিত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আমার উম্মত মঙ্গলের সাথে থাকবে যতদিন তারা সেহরী বিলম্ব করবে এবং ইফতার তাড়াতাড়ি করবে। এছাড়াও সেহরী বিলম্ব করা রোজা সম্পাদনে সহযোগী। আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘আর আহার কর ও পান কর যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কাল রেখা থেকে স্পষ্ট হয়’। কাল রেখা মানে রাতের আধাঁর আর সাদা রেখা মানে দিনের আলো। কিছু মানুষ এমন আছে যারা রাতের বেশি অংশ জাগ্রত থাকে অত:পর ঘুমাতে যায় তখন সেহরী খেয়ে ফেলে এতে তাদের ফজরের নামাজ ছুটে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। ফলে এরা রোজার সময় হওয়ার পূর্বে রোজা রাখে এবং তাদের থেকে ফজরের নামাজ ছুটে যায়। তাদের কাছে রোজার কি মূল্য থাকবে যতক্ষণ তারা মনোপ্রভৃত্তির অনুস্বরণ করবে?
রোজার আরেকটি আদব হচ্ছে : সূর্য অস- যাওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : ‘মানুষ কল্যাণের সাথে থাকবে যতদিন তারা ইফতারি তাড়াতাড়ি করবে’। অর্থাৎ এই উম্মত সম্মানের সাথে থাকবে যতদিন তারা এ সুনা্নতকে ধরে রাখবে।
ইফতার ও সাহরীর আদব : তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করা। যদি তা না পাওয়া যায় তাহলে শুকনা খেজুর দিয়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজ পড়ার পূর্বে তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। যদি তা না থাকত তাহলে শুকনা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। আর যদি শুকনা খেজুর না থাকত তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন। ইফতারে সময় বিভিন্ন খাদ্য ও পানীয় জাতীয় বস'র বেশি আয়োজন না করা উচিত। কারণ এতে সুন্নতের উপর আমল করা হয় না এবং জামাতের সাথে নামাজ আদায় ছুটে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে।
দ্বাদশ পাঠ: রোজাদারের জন্য যেসকল কাজ হারাম
রোজার কিছু আদব আছে যেগুলোর প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হয় এবং বাস-বায়ন করতে হয় যাতে রোজা শরীয়তসম্মতভাবে সম্পাদন করা যায়, রোজার উপকারগুলো লাভ করা যায় এবং তার উদেশ্য অর্জন হয়। কোন উপকার ছাড়া যেন অযথা কষ্ট না হয়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : কিছু রোজাদার এমন যারা শুধু ক্ষুর্ধাত থাকে এছাড়া আর কোন কিছু লাভ করে না। রোজা শুধু ক্ষুর্ধাত থাকার নাম নয় বরং এর সাথে র্গর্হিত কথা ও কাজ ছেড়ে দিতে হবে।
কেউ বলেছেন : সবচেয়ে সহজ রোজা হচ্ছে পানাহার ছেড়ে দেওয়া। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হলে পানাহার ছাড়ার সাথে সাথে অন্য কোন নিষিদ্ধ কাজ করা যাবে না। মুসলমানের উপর যে নিষিদ্ধ কাজ বর্জন করা আবশ্যক তা রোজার সময় বর্জন করা আরো বেশী আবশ্যক। যে অন্য সময় হারাম কাজ করে সে গোনাহগার হয় এবং শাসি-র উপযুক্ত হয়। আর যদি সে রোজার সময় করে তাহলে গোনাহ ও আযাবের পাশাপাশি তার রোজাও অসম্পূর্ণ ও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে।
প্রকৃত রোজাদার সে যে পানাহার থেকে বিরত থাকে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গোনাহ থেকে বিরত থাকে, তার জিহ্বা গালি-গালাজ ও খারাপ কথা বলা থেকে বিরত থাকে, তার শ্রবণ গান-বাজনা বাঁশির সুর গালি-গালাজ ও অন্যের দোষ শোনা থেকে বিরত থাকে, তার দৃষ্টি নিষিদ্ধ নজর থেকে বিরত থাকে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও আমল বর্জন করে নাই। তাহলে তার পানাহার ছেড়ে রোজা রাখার দরকার নেই। কেননা এতে সে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন বিনিময় পাবে না। (বুখারি : ১৯০৩)
রোজাদারের উচিত গীবত, অন্যের দোষ বর্ণনা ও গালি-গালাজ ছেড়ে দেওয়া। আবু হুরাইরাহ রা: থেকে বর্ণিত নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ যেন রোজা রাখা অবস'ায় কোন খারাপ কর্ম না করে। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে আসে বা গালি দেয় তাহলে সে যেন বলে আমি রোজাদার। (বুখারি : ১৮৯৪) আরেক বর্ণনায় রোজাকে ডাল বলা হয়েছে অর্থাৎ যা রোজাদারকে ঢেকে রাখে এবং তাকে অন্যের অস্ত্র আঘাত করতে বারণ করে। রোজা রোজাদারকে গোনাহের কাজে পতিত হওয়া থেকে হেফাজত করে, যার পরিণাম শাসি-।
আরেক বর্ণনায় এসেছে যে, রোজা ডাল স্বরূপ যতক্ষণ পর্যন- তা ভেঙ্গে ফেলা হবে। প্রশ্ন করা হল কিসের দ্বারা ভাঙ্গা হবে। তিনি বললেন : মিথ্যা বা গীবতের দ্বারা। (বায়হাকী : ১৭৩/৭)
এতে বুঝা যায় যে, গীবত রোজাকে ভেঙ্গে দেয় অর্থাৎ প্রভাব ফেলে। ডাল ভেঙ্গে গেলে যেমন কোন উপকার পাওয়া যায় না তেমনিভাবে রোজা যখন ভেঙ্গে যাবে তখন তার দ্বারা কোন উপকার পাওয়া যাবে না।
গীবত কী? গীবত হল : রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমার ভাইয়ের এমন কিছু উল্লেখ করা যা সে অপছন্দ করে।
এক বর্ণনায় এসেছে যে গীবতের কারণে রোজা ভেঙ্গে যায়। গীবত মানে অপর মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খাওয়া।
আল্লাহ তাআলা বলেন : এবং একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্য কী কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে ? (হুজুরাত : ১২)
গীবতের মাধ্যমে রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তার পূণ্য লাভ হবে না।
ত্রয়োদশ পাঠ : রোজাদারের জন্য যা করা অপছন্দীয়
রোজাদারের জানা উচিত যে সে একটি মহৎ ইবাদত সম্পাদন করছে। এ ইবাদতের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন কাজ না করা। রোজাদারের পূরাটা সময় ইবাদত গণ্য করা হবে। রাতের ঘুম ও রোজার অন-র্ভুক্ত হবে যখন সে রোজা রাখার শক্তি যোগানোর জন্য ঘুমাবে। সুতরাং রোজা রাখা অবস্থায় এ ইবাদতের সাথে এমন কিছু না করা যা তার সাথে সামঞ্জস্য রাখে না। এজন্য পূর্ববর্তীগণ যখন রোখা রাখতেন তখন মসজিদে বসে থাকতেন এবং বলতেন : আমরা আমাদের রোজা সংরক্ষণ করছি এবং আমরা কারো দোষ চর্চা করব না, যাতে আমাদের রোজা ঠিক থাকে।
রোজাদারের সর্বদা মসজিদে বসে থাকা জরুরি নয়, কেননা তার জীবিকা অর্জনের জন্য কাজের প্রয়োজন রয়েছে। তার করণীয় হচ্ছে সে যেখানে থাক না কেন রোজার সম্মান রক্ষা করবে। মূখে খারাপ কোন কথা বলবে না, গালি দিবে না যদি কেউ তাকে গালি দেয় তাহলে তার উত্তর দেবে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : তোমাদের কেউ যেন রোজা রাখা অবস্থায় কোন খারাপ কর্ম না করে। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে আসে বা গালি দেয় তাহলে সে যেন বলে আমি রোজাদার। (বুখারি : ১৮৯৪)
এ বর্ণনাগুলো দ্বারা রোজার গুরুত্ব বুঝানো হয়েছে। কেউ যদি তাকে প্রহার করে বা গালি দেয় তাহলে সে উত্তর দেবে না যদিও বদলা নেওয়া বৈধ তবে রোজা রাখা অবস'ায় এর থেকে বিরত থাকবে এবং বলবে আমি রোজাদার। অতএব যখন বদলা নেওয়াই রোজা অবস্থায় নিষেধ তাহলে তা শুরু করা মারাত্নক সীমালঙ্ঘন হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন : তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না আল্লাহ তাআলা সীমালঙ্ঘনকারিদের ভালবাসেন না। (বাকারা : ১৯০)
রোজার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আত্নসংযম এবং শয়তান ও তার সাহায্যকারীদের থেকে বিরত থাকার শক্তি অর্জন করা।
জনৈক আলেম বলেছেন : রোজাদারের উচিত সব অঙ্গের দ্বারা রোজা রাখা, চামড়া, চোখ, জিহ্বা, অন-র ইত্যাদি
সুতরাং কাউকে গালি দেবে না, কারো সাথে ঝগড়া করবে না, মিথ্যা বলবে না, সময় নষ্ট করবে না, কবিতা আবৃতি করে রাত্রে গল্প গুজব করবে না, অন্যায়ভাবে কারো প্রসংশা বা নিন্দা করবে না, অন্যায়ের দিকে হাত সমপ্রসারণ করবে না, অন্যায়ের দিকে পায়ে হেটে যাবে না।
উলামায়ে কেরাম বলেন : গোনাহ যেমন মুখের দ্বারা হয়, তেমনিভাবে চোখ, হাত ও ঠোঁটের দ্বারাও হয়।
গোনাহের দ্বারা রোজার সওয়াব কমে যায় যদিও রোজা ভেঙ্গে যায় না এবং রোজাদার রোজার পূণ্য পাবে না যদিও সে ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত থাকার কারণে কষ্ট করেছে। কেননা নিষিদ্ধ কর্ম বর্জনের মাধ্যমে শরীয়তের কাংখিত রোজা সে রাখে নাই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজাদারকে আদেশ করেছেন : যদি কেউ তাকে গালি দেয় তাহলে সে বলবে আমি রোজাদার। এর মাধ্যমে তিনি কোন খারাপ কর্ম বা কথার উত্তর সদাচরণের মাধ্যমে দিতে বলেছেন।
চৌদ্দতম পাঠ: রোজা বিনষ্টকারী বস্তুসমূহের প্রথমটির আলোকপাত
জেনে রাখা ভালো! রোজা বিনষ্টকারী বস্তুসমূহ নিয়ে নিয়ে আলোকপাত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এতে করে মুসলিম ব্যক্তি এ থেকে সতর্ক হবে ও দূরে থাকবে।
রোজা বিনষ্টকারী বস্তু দুই প্রকার (১) এক রোজা নষ্ট করে এবং কাযা ওয়াজিব করে (২) রোজার সাওয়াব নষ্ট করে কাযা ওয়াজিব করে না।
যে সব কাজ রোজা নষ্টকারী এবং কাযা ওয়াজিব করে তা কয়েক প্রকার:
(১) সহবাস
রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় রোজাদার ব্যক্তি সহবাস করলে তার রোজা নষ্ট হয়ে যাবে। তাকে দিনের বাকী অংশ না খেয়ে থাকতে হবে। আল্লাহর নিকট তওবা এবং ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। এবং এ রোজাটি পরবর্তীতে কাযা করবে। এবং তাকে কাফফরা দিতে হবে।
কাফফারা হলো- দাস-দাসী মুক্ত করা। তা না পারলে দুই মাস লাগাতার রোজা পালন। তা করতে সক্ষম না হলে ষাট জন মিসকিনকে খাদ্য প্রদান। প্রত্যেকের জন্য এক ফিতরা পরিমাণ গম, অথবা প্রচলিত খাদ্যদ্রব্য। রোজা রাখতে সক্ষম না হওয়া মানে শরিয়তের দৃষ্টিতে সামর্থ্য না রাখা। রোজার দ্বারা শুধু উপবাস বা এ জাতীয় কষ্ট উদ্দেশ্য নয়।
জনৈক সাহাবী এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বললেন: ধ্বংস হয়েছি এবং ধ্বংস করেছি; তিনি বললেন: কিসে তোমাকে ধবংস করেছে? আমি রমজানের রোজা আবস্থায় আমার স্ত্রীর সাতে সহবাসে লিপ্ত হয়েছি। তিনি বললেন, তুমি কি কোন মাস মুক্ত করতে পারবে? সে উত্তরে বলল, না । তিনি বললেন, লাগাতার দুইমাস রোজা পালন করতে পারবে? সে বলল, না। তিনি বললেন ষাটজন মিসকিনকে খাওয়াতে পারবে? সে বলল: না। অত:পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসে পড়লেন। ইতিমধ্যে তার কাছে কিছু তরল খাবার আসল যার মাঝে খেজুরও ছিল । নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটিকে বলল, এগুলো সদকা করে দাও। লোকটি বলল: আমার চেয়ে আরো অভাবী কোন ফকিরকে? কারণ এ দুই পাহাড়ের মাঝে আমার পরিবারের চেয়ে বেশি অভাবী আর কেউ নেই। তার কথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসলেন এবং বললেন, যাও এগুলো তোমার পরিবারের জন্য নিয়ে যাও। (বুখারী:১৯৩৬ মুসলিম: ১১১১)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন- “রোজাদারের সহবাস, বের হওয়ার দিক থেকে সিংগা এবং হায়েযের সাথে মিল রয়েছে। সহবাসের সময় যেমন বের হয় এগুলোর সময়ও বের হয়। আহার এবং পান করার সাথে মিল রয়েছে কাম্যবস্তু হিসেবে। তিনি বলেন, সহবাস, বীর্য নিগর্মনের কারণ হওয়ায় ইচ্ছাকৃত বমি, হায়িয এবং সিংগার সাথে মিল রয়েছে। অন্য দিকে কাম্যবস্তু হওয়ায় তা খাবার গ্রহণ এবং পান করার সাথে মিল রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের যে সংবাদ দিয়েছেন তা হলো, আল্লাহ রোজাদার সম্পর্কে বলেন '' সে আমার জন্য খাবার এবং পানাহার পরিহার করে।'' অতএব মানুষ কাম্যবস্তুকে আল্লাহর জন্য পরিহার করাটাই কাংক্ষিত ইবাদত। এর জন্য সে সাওয়াব পাবে।
দেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামতের মধ্যে একটি হলো সহবাস যা আত্মার বিকাশ এবং আনন্দ দানের জন্য জরুরী। এটা প্রবৃত্তি, রক্ত এবং দেহের সঞ্চালনের জন্য খাদ্যের চেয়েও বেশি ক্রিয়াশীল। আমরা যখন বিশ্বস করি করি শয়তান মানব সন্তানের শিরা উপশিরায় বিচরণ করে। এর ফলে পুষ্টি, রক্ত বৃদ্ধি করে। ফলে আত্মা প্রসার হয় বিকাশ হয় কাম্য বস্তুসমূহের দিকে। তাহলে বলা যায় এসব গুলো সহবাসের মধ্যে অনেক বেশি উপস্থিত রয়েছে। কারণ এটি আত্মার ইচ্ছাশক্তিকে প্রলম্বিত করে প্রবৃত্তির দিকে এবং ইবাদত বিমূখ করে। বরং বলা যায় প্রবৃত্তির মূল টার্গেট হলো সহবাস এবং এ কামভাব। যা আহার ও পান করা থেকেও বড়। এ জন্য সহবাসকারীর কাফফারা রদয়া ওয়াজিব। তার জন্য দাসমুক্তি অথবা সুন্নাত ও ইজমা ভিত্তিক যা সাবস্ত্য হবে তা আদায় ওয়াজিব। কারণ এ অপরাধ মারাত্মক ক্ষতি ও ভয়াবহ। এ হলো সহবাস হারাম করার বড় দুইটি কারণ। হ্যাঁ, বীর্য বের হওয়ার ফলে শরীর দুর্বল হয়। এতে তো অন্য উদ্দেশ্য আছে। দুর্বল করার ক্ষেত্রে এটা ইচ্ছাকৃত বমি এবং হায়েযের মতো বরং এ দুটোর চেয়েও বেশি। তাই সহবাস রোজা নষ্ট করার ক্ষেত্রে আহার এবং হায়িয থেকে অনেক বেশি ক্রিয়াশীল ।’’
পনেরতম পাঠ : রোজা বিনষ্টকারী দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকারের আলোচনা
জেনে রাখুন আল্লাহ তাআলা রোজাদারের জন্য রাতে নিজ স্ত্রীর সাথে সম্ভোগ বৈধ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
أُحِلَّ لَكُمْ لَيْلَةَ الصِّيَامِ الرَّفَثُ إِلَى نِسَائِكُمْ
তোমাদের জন্য রোজার রাতে স্ত্রী সম্ভোগ হালাল করা হয়েছে। (সূরা বাকারা-১৮৭)
রাতের জন্য বৈধতাকে নির্দিষ্ট করা দ্বারা দিনে হারাম হওয়া প্রমাণিত হল।
রোজা নষ্টকারী দ্বিতীয় কারণগুলো থেকে হলো, সহবাস ছাড়া অন্য উপায়ে যেমন: চুমো খাওয়া, আলিঙ্গন, বারবার কুদৃষ্টি অথবা হস্তমৈথুন এর ফলে বীর্য বাহির করা। এ সবের কোন একটি কারণে রোজাদার বীর্য বাহির করলে তার রোজা নষ্ট হবে যাবে। দিনের বাকী অংশ সে পানাহার বন্ধ রাখেবে এবং এ রোজা পরে কাযা করবে। কাফফারা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। তবে তাকে তওবা করতে হবে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এজাতীয় কর্মকান্ড হতে দূরে থাকতে হবে। কারণ, সে এক মহান ইবাদত করে যাচ্ছে এ সময়ে তার কাছে কাম্য হলো সে আল্লাহর জন্য কামভাব, পানাহারসহ সব ত্যাগ করবে। হ্যাঁ ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্নদোষ হলে এতে তার রোজার কোন ক্ষতি হবে না। এর জন্য কোন কাযা কাফফারারও প্রয়োজন নেই। কারণ এটা হয় তার অনিচ্ছায়। তবে তাকে গোসল করতে হবে।
রোজার নষ্টকারী তৃতীয় কারণ হলো ইচ্ছাকৃত খাবার ও পানীয় গ্রহণ করা।
وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ
আর আহার কর ও পান কর, যতক্ষণ না ফজরের সাদা রেখা কালো রেখা থেকে স্পষ্ট হয়। অত:পর রাত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ কর। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৭৮)
আল্লাহ তাআলা সুবহে সাদিক পর্যন্ত আহার ও পান করা কে বৈধ করেছেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পূর্ণ করতে বলেছেন। আহার ও পান করার মত একই হুকুম ঐ সব খাবারের জন্য যা মুখ ভিন্ন অন্য পথে দেহে প্রবেশ করে। এ ছাড়া শুকনাও তরল জাতীয় যে কোন খাবার মুখ দিয়ে প্রবেশেরও ঐ একই হুকুম। যেমন পুষ্টি ইনজেকশন গ্রহণ, ঔষধ খাওয়া, পরিত্রাণের জন্য রক্তগ্রহণ এসবই রোজা বিনষ্টকারী। কারণ এগুলো খাদ্য অথবা ঔষধ হিসেবে কাজ করে যা পেটে চলে যায়। তাই এগুলো খাদ্যের হুকুমের অন্তর্ভূক্ত। এটাই ফিকহবিদদের মত। হ্যাঁ যে ইনজেকশন পুষ্টি নয় এবং শিরায় গ্রহণ করা হয় তার ব্যাপারেও মত হলো এটা রোজা ভঙ্গকারী।
কারণ তাও রক্তের সাথে চলাচল করে এবং পেটে চলে যায়। আর যদি মাংসপেশীতে নেয়া হয় উত্তম হলো তা ত্যাগ করা। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সন্দেহ হয় এমন বস্তু পরিহার কর। (নাসায়ী: ৫৭২৭)
বাধ্য হয়ে যাকে এসব গ্রহণ করতে হবে এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত দেরী করাও তার পক্ষে সম্ভব নয় সে অসুস্থতার কারণেই তা গ্রহণ করবে এবং রোজা কাযা করবে। আল্লাহ রোগীর জন্য অনুমতি দিয়েছেন রোজা ভঙ্গের। এবং পরে কাযা করার। চোখে সুরমা লাগানো কোন কোন ফকিহ এটাকে রোজা ভঙ্গের কারণ মনে করেন। কারণ এটাও পেটে চলে যায়। অনেক সময় রোজাদার ব্যক্তি সুরমার স্বাদ তার কন্ঠে অনুভব করে। তাই রোজাদার ব্যক্তি রোজার দিনে সতর্কতা মূলকভাবে সুরমা পরিহার করতে পারলে ভাল।
ষোলতম পাঠ:
রোজা বিনষ্টকারী থেকে চতুর্থ প্রকার হলো শিংগা অথবা এ ধরণের কোন কিছু দিয়ে রোজাদারের রক্ত বের করা নিরাময় অথবা আরামবোধ করার উদ্দেশ্যে। এ ক্ষেত্রে মূলভিত্তি হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস যাতে বর্ণিত আছে '' শিংগাদানকারী এবং গ্রহণকারী উভয় ইফতার করল, মানে রোজা ভাঙ্গলো। (আহমাদ, তিরিমিযি, আবুদাউদ)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন: শিঙ্গা রোজা নষ্টকরে এটা বেশিরভাগ ফিকহবিদদের মত। যেমন আহমদ, ইসহাক, ইবনে খুযাইমা, ইবনে মুনযির, ওলামায়ে আহলে হাদীস এ মত পোষণ করেন। এবং এটা শরয়ি মূলনীতি অনুযায়ীও যুক্তিযুক্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনুসারী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এ অনুযায়ী আমল করেছেন ।
কতিপয় চিন্তাবিদ শিঙ্গার কারণে রোজা নষ্ট হবে বলে মনে করেন না। তারা দলিল হিসেবে বুখারী শরীফের একটি বর্ণনা পেশ করেন। যাতে বলা হয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোজা এবং হজের ইহরাম বাধা আবস্থায় শিঙ্গা লাগিয়েছেন। (হাদিস নং ১৯৩৮, ১৯৩৯) তবে ইমাম আহমদ রহ. বলেন যে একটি হাদীসে এসেছে
فعن عبدالله بن عباس رضي الله عنهما أن النبي صلى الله عليه وسلم احتجم وهو محرم، واحتجم وهو صائم]
এ হাদীসে وهوصائم শব্দটি বৃদ্ধিকে সঠিক নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন।
তারা বলেন: বিশুদ্ধ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিঙ্গা লাগিয়েছেন ইহরাম আবস্থায়। রোজা আবস্থায় নয়। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন : আহমদ রহ. যা বলেছেন এর উপর বুখারী মুসলিম রহ. উভয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
এ জন্য ইমাম মুসলিম রহ. বর্ণনায় "وهو صائم"، শব্দটি ব্যবহার করেননি।
অনিচ্ছাকৃত রক্ত বাহির হওয়া, যেমন নাক থেকে, আঘাত জনিত কারণে, দাতের মাড়ি থেকে এগুলো রোজার কোন ক্ষতি করবে না। কারণ এ অবস্থায় সে মাযুর। তবে দাত থেকে রক্ত বাহির হলে তা যেন ভিতরে না যায়, সে বিষয় খেয়াল রাখতে হবে অবশ্যই।
পঞ্চম প্রকার হলো ইচ্ছাকৃত বমি করা।
ইচ্ছাকৃত বমি বলতে পেটের ভিতর থেকে খাবার অথবা পানি বের করা। এ বিষয়ে হাদীস হলো
"من استقاء عمدا فليقض" حسنه الترمذي [ أخرجه الترمذي رقم 720، وأبو داود رقم 2380، وابن ماجة رقم 1676
যে ইচ্ছাকৃত বমি করল সে রোজা কাযা করবে। (তিরমিজী, আবু দাউদ)
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইচ্ছাকৃত বমি করতে নিষেধ করার কারণ হলো খাদ্য ও পানীয় বস্তু দেহে শক্তি বৃদ্ধি করে এ গুলো বের করা শরীরের জন্য ক্ষতি এবং স্বাস্থ্য দুর্বলের কারণ যার প্রভাব পরবর্তিতে ইবাদতেও পড়বে। তবে অনিচ্ছাকৃত বমি হলে এতে রোজা নষ্ট হবে না। হাদীসে এসেছে, যে অনিচ্ছায় বমি করল তার জন্য কাযা নেই। (তিরমিজী)
এমনিভাবে রোজাদার ব্যক্তি কুলি করার সময় গরগরা করবে না এবং নাকে পানি দেয়ার সময় খুব ভিতরে পানি দেবে না।
قال صلى الله عليه وسلم: "وبالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما" [أخرجه أبو داود رقم 142، 143، وابن ماجة رقم 407، وابن خزيمة في صحيحه رقم 150، وابن حبان في صحيحه رقم 159 والحاكم 1/ 147 ـ 148، وأحمد 4/ 33، وصححه الذهبي وابن حجر].
কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গরগরা করে কুলি করা এবং নাকে ভিতরে পরিস্কারের কথা বললেও তা রোজা আবস্থায় নিষেধ করেছেন।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. এর কারণ হিসেবে বলেন : এর মাধ্যমে গলা এবং নাক দিয়ে পানি পেটে চলে যাবে। এতে করে সরাসরি পান করলে যা হতো তাই হয়ে যাবে। যা রোজা ভঙ্গের কারণ হবে।
হ্যাঁ সতর্ক আবস্থায় পুরো শরীর পানি দ্বারা গোসল বা অন্য কোন মাধ্যমে শীতল করা বৈধ। তবে খেয়াল রাখতে হবে পানি যেন কণ্ঠনালী দিয়ে ভিতরে না যায়। আর যে ভুলে আহার বা পান করে তার রোজার কোন ক্ষতি হবে না বরং তা আল্লাহর পক্ষ হতে তার উপর অনুগ্রহ বলে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। উড়ন্ত মশা-মাছি, ধূলা-বালি হঠাঁৎ মুখ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেও রোজার কোন ক্ষতি হবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: আমার উম্মত ভুলে যা করে অথবা জোরপূর্বক তাকে দিয়ে যা করানো হয় এগুলো তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
সতেরতম পাঠ: কাযা রোজা আদায়ের বিধানাবলী সম্পর্কে
আমাদের অবশ্যই শরয়ী কারণে যে রোজা ভঙ্গা হয় তা কাযা করার বিধান জানা থাকা জরুরী। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ ﴿185﴾
‘আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আল্লাহ তোমাদের সহজ চান এবং কঠিন চান না।’
এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা রোগী এবং মুসাফিরকে রমজানের রোজা ভঙ্গের অনুমতি দিয়েছেন। এবং এ সুযোগ গ্রহণ করলে পরবর্তিতে ঐ পরিমাণ রোজা আদায় করতে বলেছেন। তবে কেউ যদি এ সুযোগ গ্রহণ না করে রোজা রাখে তার রোজা হবে এটাই জামহুরে ওলামার মত। অনুমতি দানের হেকমত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: আল্লাহ বান্দার জন্য সহজ করতে চান, কঠোর করতে চান না। অসুস্থ আবস্থায় অথবা সফর অবস্থায় রোজার আদেশ বহাল রাখলে বান্দার কষ্ট হতো। আবার পরে তা পূরণ করার হেকমত ও তিনি বর্ণনা করেছেন। তা হলো রোজার জন্য নির্ধারিত দিনগুলো পূরণ করা অর্থাৎ ১মাস রোজা পালন যা আল্লাহ ফরজ করেছেন। এ সুযোগ গ্রহণ করলে সহজও হবে রোজার মাসও পূরণ হবে। তৃতীয় আরেকটি শ্রেণী আছে যাদের জন্য রোজা ভঙ্গের অনুমতি আছে। তারা হলো অতিশয় বৃদ্ধ যারা বাধর্ক্যজনিত কারণে রোজা রাখতে অক্ষম। তারা রোজার পরিবর্তে প্রতিদিনের জন্য একজন অভাবী মানুষকে খাবার দেবে।
{وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين} [البقرة 184]،
আর যাদের কষ্ট হবে তাদের কর্তব্য মিছকীনকে ফিদয়া প্রদান করা।
এ আয়াতের আওতায় গর্ভবতী এবং দুগ্ধ দানকারীনি নিজের এবং সন্তানের উপর আশংকাবোধ করলে রোজা ভঙ্গের অনুমতির কথা ওলামাদের এক জামাআত অনুমোদন করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি গর্ভবতী অথবা দুগ্ধ দানকারীনিকে বলেছেন আপনিতো ঐসব লোকের পর্যায় যারা অক্ষম।
أنت بمنزلة الذين لا يطيقون الصيام،
ইবনে ওমর রা. কে প্রশ্ন গর্ভ অবস্থায় রোজা রাখা সম্পর্কে তার এক মেয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন: আহার গ্রহণ কর এবং প্রতি দিনের জন্য একজন মিসকিনকে খাবার দাও।
সার কথা হল: এদের সকলের জন্য অসুবিধার কারণে রমজানের দিনে খাবার গ্রহণ বৈধ। তবে এদের আবার তিন প্রকারে ভাগ করা হয়। (১) শুধু কাযা ওয়াজিব ফিদয়া দিতে হবে না। যেমন, অসুস্থ, মুসাফির এবং গর্ভবতী ও ধাত্রীদ্বয় যদি তাদের জীবনের উপর আশংকা করেন । (২) ফিদয়া ওয়াজিব কাযা করতে হবে না। যেমন, অতিশয় বৃদ্ধ অথবা এমন রোগী যা আর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। (৩) কাযা এবং ফিদয়া উভয়টি ওয়াজিব তারা হলেন গর্ভবতী এবং ধাত্রী তারা যদি শুধু মাত্র তাদের সন্তানের ক্ষতির আশংকা করেন। সে ক্ষেত্রে রোযা না রেখে ফিদয়া দেবেন। এখানে ফিদয়া হলো প্রতি দিনের জন্য এক ফিতরা পরিমাণ খাবার কোন মিসকিনকে খাইয়ে দেয়া বা দান করা।
আমাদের দীনে ইসলাম হলো সহজ ও সহনীয়। মানুষের অবস্থার প্রতি এর রয়েছে সজাগ দৃষ্টি। তাই যা মানুষ করতে অক্ষম তা তাকে চাপিয়ে দেয়া হয় না। দেখুন মুকিম, মুসাফির, সুস্থ ও রোগীর জন্য রয়েছে উপযোগী বিধান। এতে করে মুসলিম ব্যক্তি সব সময়ই আল্লাহর এবাদতের সাথে জড়িত থাকতে পারে, এবং কোন ফরজ আদায় তার থেকে একেবারে বাদ হয়ে যায় না। তবে তা অবস্থার আলোকে বিধান পরিবর্তন হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, তুমি তোমার রবের বন্দেগী কর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। (সূরা আল হিজর: ৯৯)
ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন, আমাকে আমার রব আদেশ করেছেন নামাজ এবং যাকাত আদায়ের জন্য যতদিন বেচে থাকি। (সূরা মারিয়াম: ৩১)
অনেকে ইসলামের এ উদারতার কথা বলে হারাম, নাজায়েয কাজ করে থাকে এবং ফরজ কাজ ছেড়ে দেয় আর বলে থাকে, আরে ধর্মতো সহজ এর মাঝে কোন বাড়াবাড়ি নেই। আসলে ইসলাম ধর্ম পালন করা সহজ। তবে এর অর্থ এ নই যে, মানুষ ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে এবং মন যে রকম চায় সে রকম জীবন যাপন করবে। বরং সহজের অর্থ হচ্ছে বান্দা এবাদত পালনে কষ্টের পথ পরিহার করে অসুবিধা জনিত অবস্থায় সহজ পথ অনুসরণ করবে। সকল প্রশংসা আল্লাহরই।
আঠারতম পাঠ : কাযা রোজার বিধান প্রসঙ্গ
এরশাদ হচ্ছে :
{ومن كان منكم مريضا أو على سفر فعدة من أيام أُخر} [البقرة 185]
আর তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হলে অথবা সফরে থাকলে তারা অন্য সময় তা পূর্ণ করে নেবে। (সূরা বাকারা : ১৮৫)
কোন ব্যক্তি জায়েয কারণে মাহে রমজানে রোজা ভঙ্গ করলে, যেমন- শরয়ী ওযর যা তার জন্য রোজা ভাঙ্গা মোবাহ করে দেয়, অথবা কোন হারাম কারণে, যেমন- কেউ স্ত্রী সহবাস বা অন্য কোন উপায়ে রোজা ভঙ্গ করল, তার উপর কাজা করা ওয়াজিব হবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
{فعدة من أيام أخر} [البقرة 184]
সে অন্য দিনে তা আদায় করে নেবে। (সূরা বাকারা : ১৮৪)
তবে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি কাজা আদায় করা মুস্তাহাব, কারণ এটা তার জিম্মাদারি। লাগাতার কাজা আদায় করা মুস্তাহাব। কেননা কাজা প্রথম আদায়েরই স্থলাভিষিক্ত।
যদি সাথে সাথে কাযা না করে, তাহলে অন্ততঃ কাযা করার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করতে হবে। দেরীতে কাযা করাও জায়েয। কেননা এর সময় প্রশস্ত। আর যে সব ওয়াজিবের ব্যাপারে প্রশস্ত সময় থাকে সেগুলো দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে দেরী করে করা জায়েয।
অনুরূপভাবে বিরতি দিয়েও রোজা কাযা করা জায়েয। কিন্তু যদি শাবান মাসের মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকে যে কয়দিনের রোজা তার কাযা হয়েছে, তাহলে সর্বসম্মতিক্রমে তার উপর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে কাযা আদায় করা ওয়াজিব হবে সময়ের সংকীর্ণতার কারণে। কোনরূপ ওজর ছাড়া পরবর্তী রমজানের পর পর্যন্ত কাযা রোজা পিছিয়ে দেয়া জায়েয নয়। কেননা আয়েশা রা. বলেন-
كان يكون عليّ الصوم من رمضان فما أستطيع أن أقضيه إلا في شعبان لمكان رسول الله صلى الله عليه وسلم (متفق عليه. أخرجه البخاري رقم 1950 ومسلم رقم 1146)
আমার মাহে রমযানের রোযা কাযা হত, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপস্থিতির কারণে শাবান মাস আসা পর্যন্ত রোজা কাযা করতে পারতাম না। (বুখারী : ১৯৫০, মুসলিম : ১১৪৬)
অত্র হাদীসের মাধ্যমে বুঝা গেল কাজার সময়টি শাবান মাসের সে কয়েকদিন অবশিষ্ট থাকা পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হয়, যে কয়দিন তার উপর রোজা রাখা ফরজ ছিল। এমতাবস্থায় পরবর্তী রমজান মাস প্রবেশ করার পূর্বে কাজা আদায় করা ওয়াজিব।
যদি পরবর্তী রমজান মাস প্রবেশ করা পর্যন্ত কাজা রোজা বিলম্বিত করে , তাহলে প্রথমে রমজানের রোজা পালন করবে, এবং পরে কাজা আদায় করবে।
যদি ওজরের কারণে ঐ সময় কাজা আদায় করতে সক্ষম না হয় তাহলে তার উপর শুধু কাজা আদায়ই ওয়াজিব থাকবে। আর যদি ওজর ছাড়া এমন দেরী হয়ে থাকে তাহলে কাজাসহ প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে ঐ শহরের প্রচলিত খাদ্য থেকে অর্ধ সা’ খাবার দিতে হবে।
যার ওপর কাজা ওয়াজিব, এমন ব্যক্তি যদি পরবর্তী রমজান আগমনের পূর্বে ইন্তেকাল করে, তাহলে তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। কেননা যে সময়ের মাঝে সে মারা গিয়েছে সে সময় পর্যন্ত দেরী করা তার জন্য বৈধ ছিল। আর যদি নতুন রমজানের পর মারা যায়, তাহলে যদি তার দেরী করাটা অসুস্থতা ও সফরের কারণে হয়ে থাকে তাহলেও তার উপর কোন কিছু বর্তাবে না। আর যদি ওজর ছাড়া দেরী হয়ে থাকে তাহলে মৃত ব্যক্তির পরিত্যাক্ত সম্পত্তি থেকে প্রতি দিনের জন্য একজন মিসকিনের খাবার দান করে দিতে হবে।
আর যদি কোন মৃত ব্যক্তির উপর কাফফারার রোজা ওয়াজিব থাকে, যেমন- জেহারের কাফ্ফারার রোজা, তাহলে প্রতি দিনের জন্য একজন মিসকীনকে খাবার খাওয়াবে, তার পক্ষ থেকে রোজা রাখলে চলবে না। আর এ খাবার হবে মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে। কেননা জীবিত থাকা অবস্থায়ই রোজার ব্যাপারে নায়েব বানানো চলে না। অতএব, মৃত্যুর পর কিভাবে তা হতে পারে? এটা হল, অধিকাংশ আলেমের অভিমত।
মান্নতের রোজা ওয়াজিব থাকা অবস্থায় যদি কোন ব্যক্তি মারা যায় তাহলে ওয়ারিশদের জন্য মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেতে রোজা রাখা মুস্তাহাব।
বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আছে- জনৈক মহিলা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল: আমার মাতা মান্নতের রোজা পালন না করে মারা গেছেন, আমি কি তার পক্ষ থেকে রোজা পালন করতে পারি? তিনি বললেন : হ্যাঁ। (বুখারী : ১৯৫৩, মুসলিম : ১১৪৭)
মৃত ব্যক্তির ওলিগণ হল তার ওয়ারিশ।
ইমাম ইবনে কাইয়েম রহ. বলেন : মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে মান্নতের রোজা রাখ যাবে। তবে ফরজ রোজা রাখা যাবে না। ইমাম আহমদ রহ. প্রমুখের এটিই অভিমত। ইবনে আব্বাস রা. ও আয়েশা রা. থেকে এমনটিই বর্ণিত হয়েছে। যুক্তি -কিয়াসও তাই বলে। কেননা মান্নত করা শরীয়তের নির্দেশ নয়। এটি বান্দা তার নিজের উপর নিজে ওয়াজিব করে নেয়। এটি অনেকটা ঋণের মত। আর এ কারণেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মান্নতের তুলনা ঋণের সাথেই দিয়েছেন। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা যে রোজা ফরজ করেছেন এবং সেটি ইসলামের রোকনসমূহের একটি। সে রোজার ক্ষেত্রে কোন প্রকার প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা চলবে না, যেমনিভাবে নামাজ ও কালেমার ক্ষেত্রে কাউকে নায়েব বানানো চলে না।
কারণ কালেমা ও নামাজের উদ্দেশ্য হলো বান্দা যে দাসত্বের আদিষ্ট হয়েছে তা স্বয়ং নিজে পালন করা। অন্য কেউ এটি আদায় করলে চলে না। অনুরূপভাবে অন্য কেউ তার পক্ষ থেকে নামাজ আদায় করলে চলবে না।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যা রহ. বলেন : মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে প্রতি দিনের পরিবর্তে একজন মিসকীনকে খানা খাওয়াবে। ইমাম আহমদ, ইসহাক রহ. প্রমূখ এ অভিমতটি গ্রহণ করেছেন। এর স্বপক্ষে অনেক যুক্তি আছে। কেননা মান্নত তার দায়িত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অতএব, মৃত্যুর পর তা পূর্ণ করা হবে। আর রমজান মাসের রোজা এর ব্যতিক্রম। কেননা আল্লাহ তাআলা অপারগ ব্যক্তির উপর রোজা ফরজ করেননি। বরং তাকে একজন মিসকীনকে খাওয়ানোর মাধ্যমে ফিদয়া দেয়ার আদেশ করেছেন। কাজা রোজা ঐ ব্যক্তির উপরই সাব্যস্ত হয়, যার রোজা রাখার শক্তি আছে। অপারগ বা অক্ষম ব্যক্তির উপর রোজা কাজা করা ফরজ করা হয়নি। অতএব, কেউ তার পক্ষ থেকে কাজা আদায় কারার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু মান্নত অথবা এ জাতীয় রোজা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সর্বসম্মতভাবে আদায় করা যাবে। কেননা সহীহ হাদীস দ্বারা এটি প্রামানণত হয়েছে।
উনিশতম পাঠ: তারাবীহের নামাজ এবং তার হুকুম
এই পবিত্র মাসে আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য শরীয়ত হিসেবে যা পেশ করেছেন তম্মধ্যে তারাবীর নামাজ একটি। এটি সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। মানুষ প্রতি চার রাকাত পর আরাম করে তাই এ নামাজকে তারাবীহ বলা হয় । তারাবীহ দুই রাকাত দুই রাকাত করে আদায় করতে হয়। তাহাজ্জুদও অনুরূপ। কোন কোন মসজিদের ইমাম না বুঝে ভুল করেন। তারা দুই রাকাতের পর তারাবীহ অথবা তাহাজ্জুদ কোনটিতেই সালাম ফিরান না। এটা সুন্নাতের খেলাফ। ওলামাগণ বলেছেন যে, যে ব্যক্তি তারাবীহ অথবা তাহাজ্জুদের তৃতীয় রাকাতের জন্য দাড়িয়ে যায় সে যেন ফজর নামাজের তৃতীয় রাকাতে দাড়ালো। অর্থাৎ তার নামাজ বাতিল বলে গণ্য হবে।
তারাবীহ জামাআতে মসজিদে আদায় করা উত্তম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ নামাজ মসজিদে পড়েছেন। তার সাথে লোকজনও নামাজ আদায় করেছে। আগমনকারী পরবর্তী রাতেও তিনি নামাজ পড়লেন। লোকজনও হয়েছিল বেশি। তার পর লোকজন তৃতীয় কিংবা চুতুর্থ রাত্রিতে একত্রিত হলো অথচ আল্লাহর রাসূল তাদের নিকট আসেননি।সকাল বেলা তিনি লোকদের লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা যা করেছ আমি তা দেখেছি, আমার বের না হওয়ার কারণ হলো, আমার ভয় হচ্ছিল যে, এ নামাজ তথা তারাবীহ তোমাদের জন্য ফরয হয়ে যাবে। (বুখারী: ১১২৯ মুসলিম : ৭৬১) বর্ণনাকারী বলেন, এ ঘটনা রমজান মাসে হয়েছিল। তার পর সাহাবা আজমাঈন তারাবীহ আদায় করেছেন। এবং সমস্ত উম্মত তা গ্রহণ করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
: "من قام مع الإمام حتى ينصرف كتب له قيام ليلة" [أخرجه أبو داود رقم 1375 وابن ماجة رقم 1327 والنسائي رقم 1365، 1606 والترمذي رقم 806،
যে ব্যক্তি ইমামের সাথে তারাবীহ শুরু করে শেষ পর্যন্ত থাকে তাকে পুরো রাত ইবাদতের সওয়াব দেয়া হয়। আবু দাউদ, ১৩৭৫, ইবনে মাজা: ১৩২৭ নিসায়ী: ১৩৬৫ তিরমিযী: ৮০৬
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় সওয়াবের নিয়তে কিয়ামুল লাইল করে তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়। (বুখারী: ২০০৯ মুসলিম : ৭৫৯) অতএব বুঝা গেল এটা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত আদায় না করা কোন প্রকারেই উচিৎ নয়।
তারাবীর রাকাত সংখ্যা সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা পাওয়া যায় না। বরং এতে স্বাধীন সুযোগ রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন : নামাজী ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী ২০ রাকাত পড়বে। এটি শাফী রহ. এবং আহমদ রহ এর প্রসিদ্ধ মত। ইচ্ছে হয় ৩৬ রাকাত পড়বে। এটা ইমাম মালেকের মত। ইচ্ছে হয় ১১,১৩ পড়বে, সব ক'টিই সঠিক আছে। রাকাত কম হলে কিয়াম লম্বা হবে আর কিয়াম স্বল্প হলে রাকাত বেশি হবে। শরীয়তে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যা বর্ণিত হয়নি। ওমর রা. উবাই ইবনে কাআব রা. এর হালকায় যখন সবাইকে একত্র করলেন তাদেরকে নিয়ে তিনি বিশ রাকাত পড়েছিলেন। সাহাবা আজমাঈন কেউ কম রাকাতে আবার কেউ বেশি রাকাতে তারাবীহ পড়তেন।
কতিপয় ইমাম-কে অস্বাভাবিক নামাজ আদায় করতে দেখা যায়, রুকু, সেজদা, ক্বিয়াম ইত্যাদিতে ধীরস্থীরতা বলতে কিছুই নেই। অথচ ধীরস্থীরতা নামাজের রুকন। নামাজে আল্লাহর সামনে হুজুরে কালব, একাগ্রতা এবং তিলাওয়াত থেকে নছিহত গ্রহণ হলো আসল। এটাতো অস্বাভাবিক তাড়াহুড়োর দ্বারা হাসিল হয় না। দীর্ঘ এবং ধীর স্থিরভাবে দশ রাকাত নামাজ উত্তম বিশ রাকাত তাড়াহুড়োর নামাজ থেকে। কারণ নামাজের প্রাণ এবং সার হলো মনকে আল্লাহর সামনে হাজির করা। অনেক সময় কমবস্তুও বেশি থেকে উত্তম হয়ে থাকে। এমনিভাবে তারতীলের সাথে ক্বিরাত পড়া দ্রুত পড়া হতে উত্তম। হ্যাঁ স্বাভাবিক দ্রুত, যে ভাবে পড়লে মাখরাজ এবং উচচারণ ঠিক থাকে তা চলে। যদি কোন হরফের উচ্চারণ বাদ পড়ে যায় দ্রুত পড়ার কারণে তাহলে তা নিষেধ। স্পষ্ট ক্বিরাত পড়া যা দ্বারা মুসল্লি উপকৃত হয় তা উত্তম। আল্লাহ তাআলা না বুঝে যারা পড়েন তাদের নিন্দা করেছেন ।
ومنهم أميون لا يعلمون الكتاب إلا أماني} [البقرة 78]
‘আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোন জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে। (সূরা বাকারা:৭৮) অর্থাৎ তারা না বুঝে পাঠ করে। কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য কুরআনের অর্থ বুঝা এবং সে অনুযায়ী আমল করা। শুধু তিলাওয়াত নয়। কতিপয় ইমাম তারাবীহ সঠিক পদ্ধতিতে পড়েন না। কারণ তারা ক্বিরাত পাঠে এতো তাড়াহুড়ো করেন যে, সঠিকভাবে কুরআন পাঠে বিঘ্ন হয়। রুকু সেজদা, কিয়াম, ধীরস্থীরতা যা নামাজের রুকন কোনটিই তারা আদায় করেন না। রাকাতের ক্ষেত্রেও তারা কম সংখ্যাকে গ্রহণ করে। এতে করে কম রাকাত, দ্রুত নামাজ আদায়, অস্পষ্ট ও অশুদ্ধ কিরাত তাদের নামাজে একত্র হয়ে যায়, এটা ইবাদত নিয়ে খেল তামাশা। আবার কেউ কেউ মাইক্রোফোনের মাধ্যমে ক্বিরাতের আওয়াজ মসজিদের বাহিরে ছড়িয়ে দেয়, এতে মসজিদের আশ-পাশে সোরগোল সৃস্টি হয় যা জায়েয নেই। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন: যে কুরআন পাঠ করে অথচ পাশে মুসল্লিগণ নফল আদায় করছে, তিলাওয়াতকারীর উচিত নয় এমন আওয়াজে ক্বিরাত পড়া যাতে তাদের নামাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
يا أيها الناس كلكم يناجي ربه فلا يجهر بعضكم على بعض في القراءة" انتهى. [مجموع الفتاوى (23، 61، 62، 63، 64 )]
‘হে লোক সকল তোমরা প্রত্যেকে আপন প্রভুকে ডেকে থাক, তাই ক্বিরাতে একে অপরের থেকে আওয়াজকে বড় করো না। মাজমুউল ফাতাওয়া। তাই তাদের উচিত আল্লাহকে ভয় করা, নামাজকে সুন্দর করা, নিজেদেরকে এবং যারা তাদের পেছনে তারাবীহ আদায় করছে তাদেরকে সঠিক পদ্ধতিতে নামায থেকে বঞ্চিত না করা। কতিপয় ইমাম ক্বিরাত পাঠে তাড়াহুড়ো করে এবং তিলাওয়াত দীর্ঘায়িত করে শেষ দশকের প্রথম দিকে অথবা মাঝামাঝি কুরআন খতম করার উদ্দেশ্যে। খতম শেষ হলে মসজিদ ছেড়ে দেয়, নিজের পরিবর্তে অন্যকে মসজিদে দিয়ে চলে যান। কখনো এমনও হয়, সে লোকটি ইমামতির যোগ্য নয়। এটা বড় ভুল।
কতিপয় আছেন কুরআন খতম করার পরে নামাজ কমিয়ে দেন, তিলাওয়াত ও কমিয়ে দেন। জান্নাম থেকে মুক্তির রাতগুলোতেও। ভাবটা এমন যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ দ্বারা খতমে কুরআন উদ্দেশ্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করে রাত জেগে ইবাদত করা এবং এর ফযিলত অনুসন্ধান নয়। এটা তাদের মূর্খতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বিশতম পাঠ: কুরআন শিক্ষা ও তিলাওয়াতে উৎসাহ সম্পর্কে
আল্লাহকে ভয় করুন। আমাদেরকে ঈমানের মত মূল্যবান নিয়ামত দিয়ে অনুগ্রহ, এবং কুরআন নাযিলের জন্য এ উম্মতকে মনোনীত করার জন্য তাঁর শোকর আদায় করুন। এ হলো মহান কুরআন, প্রজ্ঞাপূর্ণ বয়ান, সরল পথ। ইহা আল্লাহর কালাম, অন্য কোন কালামের তুলনা এর সাথে হয় না। কোন প্রকার বাতিল কোন দিকে থেকে তাকে স্পর্শ করতে পারে না। যা সুমহান প্রজ্ঞাময়ের পক্ষ হতে অবর্তীণ। আল্লাহ নিজে এর হিফাযতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। তাই কোন ত্রুটি- বৃদ্ধি এর দিকে আসতে পারে না। ইহা লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে, বহুভাষায় পঠিত হয়। এ থেকে জ্ঞানার্জন এবং গবেষণা দুটোই সহজ।
ولقد يسرنا القرآن للذكر فهل من مدكر} [القمر 17]
আমি তো কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব কোন উপদেশ গ্রহণ কারী আছে কি?’
হিফয করতে, না দেখে মুখস্থ পড়তে পারে ছোট-বড় আরব-অনারব সকলেই। মুখে তিলাওয়াত করতে ক্লান্তি কিংবা কানে শুনতে বিরক্তিবোধ হয় না। এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে জ্ঞানীগণের তৃপ্তি অপূর্ণ থেকে যায়। জিন-ইনসান; এর ক্ষুদ্র একটি সূরার মতও অস্তিত্বে আনতে অক্ষম। কারণ এটি এক চিরন্তণ মুজিযা, চিরস্থায়ী দলীল বা প্রমাণ। আল্লাহ ইহাকে তিলাওয়াত করতে, গবেষণা করতে আদেশ করেছেন এবং ইহাকে করেছেন বরকতময়।
كتاب أنزلناه إليك مبارك ليدبروا آياته وليتذكر أولوا الألباب}
ইহা এক বরকতময় কিতাব যা আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি যাতে তারা তার আয়াতে গবেষণা করে, এবং জ্ঞানীগণ উপদেশ গ্রহণ করে।
وقال صلى الله عليه وسلم: "من قرأ حرفا من كتاب الله فله حسنة والحسنة بعشر أمثالها، لا أقول ألم حرف ولكن ألف حرف ولام حرف وميم حرف" رواه الترمذي، وقال: حديث حسن صحيح [أخرجه الترمذي رقم 2910،
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব থেকে একটি হরফ পাঠ করল, তার জন্য রয়েছে একটি সাওয়াব যা দশটি সাওয়াবের সমতুল্য। আমি বলছি না আলিফ, লাম, মিম (মিলে) একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মিম একটি হরফ।’ তিরমিযি: ২৯১০
আল্লাহ তাআলা কুরআন অনুযায়ী আমলকারী হাফেযে কুরআনকে অন্য মানুষের উপর বিষেশ মর্যাদা দান করেছেন। নবী সাল্লাল্লহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
"خيركم من تعلم القرآن وعلمه" [أخرجه البخاري رقم 5027]،
তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঐ ব্যক্তি যে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়। (বুখারী: ৫০২৭)
তিনি আরো বলেন:
مثل المؤمن الذي يقرأ القرآن مثل الأترجة ريحها طيب وطعمها طيب، ومثل المؤمن الذي لا يقرأ القرآن مثل التمرة لاريح لها وطعمها طيب حلو، ومثل المنافق الذي يقرأ القرآن مثل الريحانة ريحها طيب وطعمها مر، ومثل المنافق الذي لا يقرأ القرآن كمثل الحنظلة ليس لها ريح وطعمها مر" رواه البخاري ومسلم [أخرجه البخاري رقم 5427 ومسلم رقم 797].
যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে সে হলো কমলা লেবুর মতো, তার স্বাদ এবং সুগন্ধি উভয়টি উৎকৃষ্ট। যে মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে হলো খেজুরের মত, যা সুস্বাদু তবে সুবাস নেই। যে মুনাফিক কুরআন তিলাওয়াত করে, সে হলো ঐ ফুলের মতো যার সুবাস আছে তবে স্বাদ তিক্ত। যে মুনাফিক কুরআন তিলাওয়াত করে না, সে হলো মাকাল ফলের মত যাতে কোন গন্ধ নেই, এবং তেতো। (বুখারী, ৫৪২৭ মুসলিম, ৭৯৭)
এসব বর্ণনা প্রথমত কুরআন তিলাওয়াতে দ্বিতীয়ত গবেষণা, চিন্তায়, তৃতীয়ত কুরআন অনুযায়ী আমলে উদ্বুদ্ধ করে।
কুরআনের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়। (এক) যারা হক আদায় করে তিলাওয়াত করে, অধ্যায়ন এবং গবেষণায় গুরুত্ব দেয়। তারাই সৌভাগ্যবান, তারাই করআনের প্রকৃত পরিজন। (দুই) যারা কুরআন বর্জন করে, শিখে না এর প্রতি সুদৃষ্টি ও নেই। তাদের জন্য আল্লাহ কঠোর আযাবের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন
{ومن يعشُ عن ذكر الرحمن نقيض له شيطانا فهو له قرين} [الزخرف 36]،
‘আর যে পরম করুণাময়ের কুরআন থেকে বিমুখ থাকে আমি তার জন্য এক শয়তানকে নিয়োজিত করি, ফলে সে তার সঙ্গী হয়ে যায়।’
وقال تعالى: {ومن أعرض عن ذكري فإن له معيشة ضنكا ونحشره يوم القيامة أعمى * قال رب لم حشرتني أعمى وقد كنت بصيرا * قال كذلك أتتك آياتنا فنسيتها وكذلك اليوم تنسى} [طه 124 ـ 126]
‘আর যে আমার কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জন্য হবে নিশ্চয় এক সংকুচিত জীবন এবং আমি তাকে কিয়ামত দিবসে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আপনি আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? অথচ আমি তো ছিলাম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন? তিনি বলবেন, এমনিভাবেই তোমার নিকট আমার নিদর্শনাবলী এসেছিল, কিন্ত তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে এবং এভাবেই আজ তোমাকে ভুলে যাওয়া হলো।’ (সূরা : তা-হা ১২৪-১২৬)
(তিন) যারা কুরআন শিখেছে তবে তিলাওয়াত এবং চর্চায় অবহেলা করলো, এটা হলো কুরআনকে ত্যাগ করা, নিজেকে বিরাট সওয়াব থেকে বঞ্চিত করা, এবং এ অবহেলা কুরআন ভুলে যাওয়ার বড় কারণ। তারাও উল্লেখিত আয়াতের আওতায় পড়বে। কারণ কুরআন তিলাওয়াত ত্যাগ করা, কুরআন ভুলে যাওয়া বিরাট ক্ষতি এবং শয়তান বন্দার উপর প্রভাব বিস্তারের কারণ, আত্মা নির্দয় হওয়ার কারণ। (চার) যারা শুধু কুরআন তিলাওয়াত করে। এতে চিন্তা গবেষণা এবং এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। এতে বড় কনো উপকার নেই। এবং যারা না বুঝে শুধু কুরআন তিলাওয়াত করে, তাদের আল্লাহ তাআলা নিন্দা করেছেন। ইয়াহুদী সম্প্রদায় সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
{ومنهم أميون لا يعلمون الكتاب إلا أماني وإن هم إلا يظنون} [البقرة 78]
‘আর তাদের মধ্যে আছে নিরক্ষর তারা মিথ্যা আকাঙ্খা ছাড়া কিতাবের কোন জ্ঞান রাখে না এবং তারা শুধুই ধারণা করে থাকে। (সূরা বাকারা:৭৮) অর্থাৎ তারা না বুঝে পাঠ করে। তাই মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য তিলাওয়াতের সময় মনোযোগী হবে। সাধ্যমত অর্থ বুঝার চেষ্টা করবে। না বুঝে খতম করা যথেষ্ট নয়। আল্লাহ আমাদের উত্তম সহায়ক।
চলমান - ৩য় ও শেষ পর্ব
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।