সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মরুভূমিতে উট মানুষের বন্ধু হিসেবে কাজ করছে। দিগন্তজোড়া বালিয়াড়ি পথ পেরোতে গাড়ি বিকল হয়ে যেতে পারে, ঘোড়া ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়তে পারে; কিন্তু 'মরুভূমির জাহাজ' উট হার মানে না। মরুভূমিতে মানুষের অন্যতম উপযোগী বাহন হলো উট। মানুষ মরুভূমির উটের মাংস খায়, দুধ পান করে। জীবনাশঙ্কা দেখা দিলে উটটিকে মেরে তার কুঁজের ভেতর জমা পানি পান করে নিজের জীবনও বাঁচায়। উট সৌদি আরব ছাড়াও উপসাগরীয় অন্যান্য আরব দেশে প্রতিপালন ও রেস বা দৌড় প্রতিযোগিতায় ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীতে বর্তমানে উটের সংখ্যা প্রায় এক কোটি ৯০ লাখের মতো। এগুলোর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই আছে ১০ লাখের মতো।
সৌদি আরবে 'মাহাজিন' প্রজাতির উট বেশি দেখা যায়। কালো-লাল মিশ্র বর্ণের এই শ্রেণীর উট দুগ্ধ উৎপাদনে বিখ্যাত। এ প্রজাতির প্রতিটি উটের ওজন ৫০০ থেকে ৮০০ কেজি হয়। এ ছাড়া আছে 'মাঘাথির' বা সাদা উট, 'সুপুর' বা হলুদ উট, 'জুরক' বা নীল উট, 'হুমুর' বা লাল সাহিলিয়া বা উপকূলীয় উট, শালকুমুর এবং 'হিজন' নামের আরেক ধরনের উট। বিশেষজ্ঞ সাহালির মতে, মরু পরিবেশে উটের জনপ্রিয়তার কারণ_ ওই পরিবেশের সঙ্গে তার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের উপযোগিতা। মরুভূমিতে উট সহিষ্ণুতার প্রতীক। উটের পায়ের ক্ষুরও গরুর মতো চেরা। কিন্তু উটের পায়ের তলায় নরম প্যাড আছে। পায়ের তলদেশ এমন তাপরোধক কোমল জিনের তৈরি যেন একে উত্তপ্ত বালিতে চলার জন্য ও বালিতে দেবে না যাওয়ার জন্যই এমনভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। উটও রোমন্থন করে বা জাবর কাটে।
কিন্তু সাধারণ রোমন্থনকারীদের মতো চার কক্ষবিশিষ্ট পাকস্থলীর বদলে উটের পাকস্থলী তিন কক্ষবিশিষ্ট। ড্রোমেডারি উটের একটি কুঁজ থাকে আর ব্যাকট্রিয়ান উটের থাকে দুটি। যখন উট ভালো করে খেতে পায় তখন এর কুঁজ চর্বিতে ভর্তি হয়ে শক্ত টান টান অবস্থায় থাকে। যখন উট অভুক্ত অবস্থায় অনেকদিন থাকে তখন চর্বির অনেকটাই শক্তি উৎপাদনে ক্ষয় হয়, ফলে এর কুঁজ নরম থলথলে হয়ে যায়। উটের চোখগুলো চওড়া কিন্তু দীর্ঘ পাতায় প্রায় আবৃত থাকায় মরুভূমির ধুলাবালি থেকে সুরক্ষিত থাকে। সবল নাসারন্ধ্রগুলোর পেশিতে ঘন পশম থাকে এবং প্রয়োজনে উট এগুলোকে সংকুচিত ও প্রসারিত করতে পারে। এর পেটের নিম্নদেশে থাকা থলিকে এতকাল মনে করা হতো পানি জমা রাখার থলে, যেখান থেকে উট পানিশূন্য পরিবেশে কয়েক দিন যাবৎ পানি সেবন করে চলতে পারে। এখন গবেষণায় দেখা যায়, এতে এক ধরনের তরল পদার্থ আছে যা আগের ধারণাকে নাকচ করছে।
আরেক চমক দেখা যায় এর শরীরের তাপমাত্রায়। পানিশূন্য স্থানে এর শরীরের তাপমাত্রা পানিবহুল স্থানের তুলনায় ৫/৬ ডিগ্রি বেশি থাকে। বাইরের পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর অভ্যন্তরের তাপমাত্রা বেড়ে যায় বলেই এটি মরুভূমির চামড়া ঝলসানো গরমের উপযোগী প্রাণী হতে পেরেছে। এটি উপরের নরম ফাটা ঠোঁট ও নিচের ঝুলন্ত ধরনের রাবারসদৃশ ঠোঁটের সাহায্যে অনায়াসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তৃণ ও কাঁটাযুক্ত লতা-পাতা গুল্ম মুখে পুরে নিতে পারে। এর মুখের অভ্যন্তরের মাড়ি ও জিহ্বা এমনভাবে তৈরি, যার মাধ্যমে খসখসে ও কাঁটা জাতীয় খাবার খাওয়া সময় তার সুবিধা হয়। বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ সালেহের মতে উট অত্যন্ত সুচতুর কিন্তু শান্ত প্রাণী। উত্তেজিত না করলে সে কখনো কাউকে লাথি বা কামড় দেয় না। দীর্ঘ সময় চারণভূমিতে চরার পর নিজে নিজে আবার তাঁবুতে ফিরে আসে। কোথায় পানি পাওয়া যায় সে স্থানের অবস্থান ও অভিজ্ঞতা কখনো ভোলে না।
উট পালকের আচরণে আকস্মিক পরিবর্তন দেখলে অথবা পরিবেশ-পরিস্থিতির হঠাৎ পরিবর্তন ঘটলে কমবয়সী উট ভড়কে গিয়ে পালিয়ে যায় বা যেতে চায়। উটের সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। বিশেষজ্ঞ সাহিলির মতে, চার হাজার বছরেরও আগে আরববা সর্বপ্রথম উটকে পোষ মানায়। তিনি বলেন, আরব উপদ্বীপে ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগ থেকেই আরবদের নিত্যদিনের জীবনে উট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সম্প্রতি পিটিআই জানায়, আরব বিজ্ঞানীদের দাবি, গবেষণাগারে ক্যান্সারে আক্রান্ত ইঁদুরের ওপর গবেষণা চালিয়ে তারা এর প্রমাণ পেয়েছেন উটের দুধ ও মূত্রে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা ইঁদুরের শরীরে ঢোকানোর পর তাদের ক্যান্সারের প্রকোপ কমে গেছে। ওদের ক্যান্সার আক্রান্ত কোষগুলোও ধীরে ধীরে সেরে উঠেছে।
কারণ তারা ওই ইঁদুরগুলোকে দফায় দফায় উটের দুধ খেতে দিয়েছিলেন। আর উটের মূত্রেও একইরকম রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি দেখে তাদের শরীরে ইনজেকশনের সাহায্যে মূত্র প্রবেশ করিয়েও একই ফলাফল পেয়েছেন। তাদের দাবি_ উটের দুধ শুধু যে মানুষের পিপাসা মেটায় তা নয়, ক্যান্সার নিরাময়ের ওষুধ হিসেবেও কাজ করে। শুধু দুধই নয়, ক্যান্সার সারানোর ক্ষমতা আছে উটের মূত্রেও। আরব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফাউন্ডেশনের সভাপতি আবদুল্লাহ আলী নজর বলেছেন, উটের দুধ ও মূত্রে তৈরি ওষুধ ইঁদুরের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দারুণ সুফল পেয়েছি। এখন ওই ওষুধ মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে দেখা হবে।
বিশ্বজুড়েই উটের অনুপম বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম এর দুধ সমাদৃত। এ দুধের ভেষজগুণ গরু ও ছাগলের দুধের চেয়ে অনেক বেশি। এতে প্রোটিন তথা আমিষের পরিমাণ অন্যান্য প্রাণীর দুধের চেয়ে বেশি অথচ ক্ষতিকর ফ্যাট বা চর্বর্ির পরিমাণ কম। এতেই বোঝা যায়, যারা নিয়মিত এ দুধ পানের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের রোগমুক্ত রাখতে এটি কত সহায়ক। আরেকটি বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে_ প্রাপ্ত খাবারগুলোর মধ্যে ভিটামিন 'সি'-এর উৎস প্রায় না থাকলেও এর দুধে গাভীর দুধের তুলনায় ভিটামিন 'সি'র মাত্রা অনেক বেশি। উটের দুধে আয়রনের উৎস হিসেবে, গরু ছাগলের দুধের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। নন সেসুরেটেড ফ্যাটি এসিড শ্রেণীর এমন কিছু এসিড বা ভিনেগার জাতীয় উপাদানের মধ্যে আছে যা হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য খুবই প্রয়োজন। ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাশাস্ত্র মতে, মধু মিশিয়ে এ দুধ পান করলে বদহজম দূর হয়, হাঁপানি, কাশি লাঘব হয়, অনিদ্রা দূর হয়। কিছু নির্দিষ্ট ঔষধিগুল্মের সঙ্গে সেবন করলে রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসে। উল্লেখ্য, আরব সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে এখনো মাংস ও দুধের জন্য উট সর্বাধিক প্রিয় এবং উটের মাংস ও দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির গবেষণা চলছে।
তানভীর আহমেদ
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮ জুন ২০১২ খ্রিঃ।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।