প্রাচীন ঐতিহ্য আর সৌন্দর্যের অনুপম লীলাভূমি ঢাকা। যান্ত্রিকতা আর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে ঢাকার অনেক ঐতিহ্যই এখন হুমকির সম্মুখীন। এর পরও ঢাকাকে আলোকিত করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখানকার বেশকিছু স্থাপনা আর ঐতিহ্য। আর এরকমই একটি নিদর্শন আহসান মঞ্জিল। এটি বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত পুরাকৃতির অনুপম শৈল্পিক স্থাপত্য।
প্রধান ফটক |
বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত পুরান ঢাকার ইসলামপুর এলাকা। আর এখানেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন আহসান মঞ্জিল। ঐতিহাসিক এ স্থাপনাটির রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তৎকালীন জালালপুর পরগনার (বর্তমানে ফরিদপুর-বরিশাল) জমিদার শেখ এনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থানে 'রংমহল' নামে একটি প্রমোদভবন নির্মাণ করেন। এনায়েতউল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র শেখ মতিউল্লাহ রংমহলটি ফরাসি বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেন। ফরাসিরা এখানে তাদের বাণিজ্যকুঠি নির্মাণ করেন। ১৮৩৫ সালে খাজা আলিমউল্লাহ ফরাসিদের কাছ থেকে কুঠিটি কিনে নেন এবং পরিবারসহ বসবাস শুরু করেন। পরে তার পুত্র নওয়াব আবদুল গণি ১৮৭২ সালে প্রাসাদটি আবার নির্মাণ করেন এবং প্রিয় পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন 'আহসান মঞ্জিল'। অবশ্য ঢাকাবাসীর কাছে এটি আগে থেকেই নবাববাড়ি নামেই বেশি পরিচিত। ১৯৮৫ সালের ১১ এপ্রিল সরকারি নির্দেশে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে আহসান মঞ্জিলকে জাদুঘরে রূপান্তরের কাজ শুরু হয়।
পাকিস্তান আমলের শেষ দিক থেকে আহসান মঞ্জিলকে স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে স্থাপনের জন্য প্রচেষ্টা চলছিল। শেষমেশ স্বাধীনতার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ঢাকা জাদুঘর এবং পর্যটন করপোরেশনকে যৌথভাবে একটি পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেন। সে অনুযায়ী পরিকল্পনাও তৈরি করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানের নেতৃত্বে প্রকল্পটির অগ্রগতি হয় এবং ১৯৭৭ সালে ঢাকা জাদুঘর কর্তৃক দুই কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে পরিকল্পনা করা হয়। অবশেষে ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আহসান মঞ্জিলকে ঢাকা জাতীয় জাদুঘরের শাখা হিসেবে উদ্বোধন করেন।
গত কয়েক শতাব্দীতে ঢাকায় নির্মিত অন্যান্য ইমারতের মধ্যে আহসান মঞ্জিল একটি উল্লেখযোগ্য ও অনবদ্য শৈল্পিক স্থাপত্য নিদর্শন। দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার দিকে প্রাকৃতিক দৃশ্যশোভিত প্রাসাদের মনোরম অঙ্গন বিস্তৃত। সমগ্র আহসান মঞ্জিল দুটি অংশে বিভক্ত। পূর্ব পাশের গম্বুজযুক্ত অংশকে বলা হয় প্রাসাদ ভবন এবং পশ্চিমাংশের আবাসিক প্রকোষ্ঠাদি নিয়ে গঠিত ভবনকে বলা হয় অন্দর মহল। প্রাসাদ ভবনটি আবার দুটি সুষম অংশে বিভক্ত। মাঝখানে অষ্টকোণ গম্বুজটি উত্তোলিত।
ব্রিটিশ ভারতীয় ঢাকার উপাধিপ্রাপ্ত নওয়াবদের বাসস্থান ছিল এই মঞ্জিলটি। স্থানীয়ভাবে ঢাকাবাসীর কাছে এর পরিচয় নবাববাড়ি নামে। অর্থাৎ এটি শুধু মঞ্জিলই নয়, নবাব পরিবারের আভিজাত্য, বিত্তবৈভব আর প্রভাবের প্রতীকও বটে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে গিয়ে নিজের চোখে সেসব ইতিহাস দর্শন একটি বড় পাওনা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এখানকার নবাবরাই এ দেশে প্রথম আধুনিক খেলাধুলা যেমন- ক্রিকেট, হকি ইত্যাদির প্রচলন করেছিলেন। তাদের উদ্যোগেই ১৮৯৯ সালে ঢাকায় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব গঠিত হয়। ঢাকায় প্রথম পানীয়জলের সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রচলন এই নবাবদেরই অবদান। কালের পরিক্রমায় আজ সেই নবাবরা নেই, নবাবীও নেই। তবুও আহসান মঞ্জিল সেই সময়কার ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গর্বের সঙ্গে।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে নবাবদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে মোট ২৩টি গ্যালারি রয়েছে। এতে আহসান মঞ্জিল পরিচিতি, ভবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সংস্কারপূর্ব ও পরবর্তী বিভিন্ন আলোকচিত্র, ঐতিহাসিক ঘটনা, নবাবদের ভোজনকক্ষ, ঢাল-তরবারি, অপূর্ব নির্মাণশৈলীর প্রধান সিঁড়িঘর, নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের বড় একটি তৈলচিত্র, বিলিয়ার্ড কক্ষ, ৯৪ লকারবিশিষ্ট সিন্দুক, নবাবদের বংশ পরিচিতি চিত্র, নবাব পরিবারের ঘনিষ্ঠ লেখক-সাংবাদিক মাওলানা আকরম খাঁ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হাকিম হাবিবুর রহমান, গবেষক পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি, নবাব সলিমুল্লাহর আলোকচিত্রসহ তার ব্যবহৃত অলঙ্কৃত চেয়ার, হুক্কা, তরবারি, লৌহখাপ, ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্র, কবি ও সংগীতজ্ঞ অতুল প্রসাদ সেন, রাজনীতিবিদ ডা. আনসারী, সমাজসেবক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ বিশিষ্ট মনীষীর প্রতিকৃতি, হিন্দুস্তানি কক্ষ, ঢালাই লোহার তৈরি নকশা সংবলিত আঙ্গুর লতাগুচ্ছ, নবাবদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি, নবাবদের তাসখেলার ঘর, ঢাকা ওয়ার্কসের কিছু দুর্লভ আলোকচিত্র, বিশিষ্ট ও রাজকীয় অতিথিদের বিশ্রামের জন্য স্টেট বেডরুম, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার বিবিধ নিদর্শন, প্রাসাদ ড্রইংরুম, গোলাঘর, নাচঘর।
আহসান মঞ্জিল জাদুঘরটি প্রতিদিন প্রায় হাজার দুয়েক দর্শক দেখতে আসেন। আর শুক্রবার আসেন প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার দর্শক। আহসান মঞ্জিল জাদুঘর গরমের সময় সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। আর শীতের সময় খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। শুক্রবার গরমের সময়ে খোলা থাকে বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এবং শীতের সময় শুক্রবার খোলা থাকে বেলা আড়াইটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার। তবে সরকারি ছুটির দিন এটি খোলা থাকে।
ফোন : ৭৩৯১১২২, ৭৩৯৩৮৬৬
* জুয়েল সরকার
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।