কিংবদন্তি
আছে, বদর
শাহ নামের একজন পীর প্রথম চেরাগ জ্বালিয়ে দেও, দৈত্যদানোয় ভরা এই শহর থেকে দূর করেছিলেন অশুভ আত্মা। আর যে
পাহাড়ের ওপর তিনি
চেরাগ জ্বালিয়েছিলেন তার নাম হয়েছিল চেরাগী পাহাড়। তবে কেউ যদি এই গল্প শুনে চেরাগী পাহাড়
খুঁজতে বের হন তিনি হতাশই হবেন। কেননা ওখানে কোনো পাহাড়ই নেই,
শুধু
সারি সারি দালান।
চেরাগী
পাহাড়ের মতো চট্টগ্রাম নগরের আরও বহু এলাকার সঙ্গে পাহাড় নামটি থাকলেও বাস্তবে সেখানে এখন
পাহাড়ের ছিটেফোঁটাও নেই। কিছু কিছু এলাকায় পাহাড় টিকে থাকলেও তা কর্তিত, খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।
নগরের
একটি বিখ্যাত পাহাড়ের চূড়ায় ছিল চাকমা রাজার ভবন। সেখানে বসত গানের আসর। তা নিয়ে নানা
উপকথাও তৈরি হয় লোকমুখে। স্থানীয় লোকজন বলতেন, সেই পাহাড়চূড়ায় পরিরা গান গায়, নেচে বেড়ায়। এমন কাহিনির
সূত্র ধরে পাহাড়টির
নাম হয়েছিল পরীর পাহাড়। ইংরেজদের কাছে ফেয়ারি হিল নামে পরিচিত এই পাহাড়ে ব্রিটিশ আমলেই
চট্টগ্রাম বিভাগ ও জেলার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এখানকার আদালত ভবনটি প্রত্নতাত্ত্বিক
নিদর্শন। কিন্তু কালে
কালে সংকুচিত হয়ে পড়েছে ‘পরীর
পাহাড়’। পরীর
পাহাড়ের পশ্চিম-উত্তরাংশের
নাম ছিল টেম্পেস্ট হিল। এই পাহাড়ের মালিক ছিলেন হ্যারি নামের এক পর্তুগিজ।
পরবর্তীকালে পাকিস্তান সরকার এটিকে হুকুম দখল করে কালেক্টরের বাসভবন নির্মাণ করেন। বর্তমানে কালেক্টরের বাসভবনসহ
গোটা টেম্পেস্ট
হিলটাই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। টেম্পেস্ট হিলের পূর্বে ও পরীর পাহাড়ের উত্তর-পূর্ব দিকে
একটি অনুচ্চ পাহাড়ে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের অফিস ও বাংলো ছিল। এটিও কেবল নামেই আছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ ফোরাম, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ আইনবিদদের সংগঠন বেলার তথ্য মতে গত ২০ বছরেই কেবল ১১০টি পাহাড় হারিয়ে গেছে। আশির দশকের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরে ২৩০টি পাহাড়ের চূড়া চিহ্নিত করা হয়েছিল। এখন সরকারি-বেসরকারি মিলে অর্ধশত পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। আর আছে কিছু বিচ্ছিন্ন, কর্তিত চূড়াবিহীন পাহাড়।
ইতিহাস
ঘেঁটে জানা যায়, কোতোয়ালি
এলাকার মুসলিম হাইস্কুলের উত্তর-পশ্চিম দিকে জেল রোডের পীর বদর শাহর দরগাহ পর্যন্ত অনুচ্চ একটি টিলার
নাম ছিল মারকট
সাহেবের পাহাড়। সেটিও কালের গর্ভে বিলীন। আন্দরকিল্লাহ
নজির আহমদ চৌধুরী রোড, মোমিন
রোড, বৌদ্ধমন্দির
রোডের মাঝখানে কয়েকটি
পাহাড় ইংরেজ শাসনকর্তাদের কাছ থেকে কোনো এক চাকমা রাজা কিনে নিয়েছিলেন বলেই এসব
পাহাড়কে লোকজন চাকমা রাজার পাহাড় হিসেবেই চিনত। এগুলোর মধ্যে একটি হলো ডিসি পাহাড়। এই পাহাড়ের শীর্ষে
বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা
প্রশাসকের বাসভবন রয়েছে। ডিসি পাহাড়ের অধিকাংশ এলাকা চারটি নার্সারির দখলে রয়েছে। এ
ছাড়া পুরো এলাকায় কয়েকটি পাকা সরু সড়ক নির্মাণ করে নাগরিকদের হাঁটার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ডিসি
পাহাড়ের উন্মুক্ত
মঞ্চে সারা বছরই চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ডিসি পাহাড়ের পাশে পুরোনো টেলিগ্রাফ অফিসের
উত্তরে অবস্থিত ফরেস্ট হিল। এখানে চট্টগ্রাম জেলার বন বিভাগের সদর দপ্তর। রাজাপুকুরের পশ্চিম প্রান্তে ও কদম মুবারক
মসজিদের দক্ষিণ
পাশে পাহাড়ের শীর্ষে ছিল চাকমা রাজার বাসা। এখন সেই পাহাড়ও নেই, বাসাও নেই, নেই সেই দিঘিও।
আন্দরকিল্লাহ
জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়টির নাম রংমহল। এ নামটি মোগল আমলের। মোগল রাজকর্মচারীদের অবসর
বিনোদনের স্থান ছিল এটি। এই পাহাড়টিরও চারদিক থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সাবেক কিউরেটর শামসুল হোসাইন জানান, চট্টগ্রামের অনেক পাহাড়
বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রবর্তক সংঘের পাহাড়টি। এটির বিস্তার ছিল খুলশি
পর্যন্ত। সেখানে এখন
পাহাড়ের লেশমাত্র নেই। ষোলশহর এলাকার দুই পাশেই পাহাড় ছিল। তা-ও নেই। মেহেদীবাগের আমীরবাগ
আবাসিক এলাকাটি পুরোটাই ছিল পাহাড়। মেডিকেল কলেজের পাশেও ছিল পাহাড়। তিনি বলেন, ‘আমরা তো শুধু পাহাড় হারাচ্ছি না—সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের
ইতিহাস, ঐতিহ্য
ও সংস্কৃতিকেও হারিয়ে ফেলছি।’
১৮৭৮
সালের ২৩ আগস্ট পল্টন পাহাড়ের ওপর স্থাপিত হয় চিটাগাং ক্লাব। তার অদূরে একই পাহাড়ে সার্কিট
হাউসও নির্মিত হয়। পল্টন পাহাড়টি একসময় পশ্চিমে বাটালি পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃতি ছিল। বর্তমানে এটি এখন
মূল পাহাড় থেকে
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ব্রিটিশ
আমলে চট্টগ্রামের একটি পাহাড়ের চূড়ায় দেবমন্দির নির্মিত হয়েছিল বলে এর নাম হয়েছিল
দেবপাহাড়। এখন এটি প্রায় সমতল আবাসিক এলাকা। এর পশ্চিম প্রান্তের কিছুটা অংশ এখনো দেখা যায় টিলার মতো।
চকবাজার জয় পাহাড়ের
চিহ্নও মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। গোলপাহাড়ে নিত্য যানজটের ভিড়, ওখানেও পাহাড় কই। আর মাথা
উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা চট্টগ্রামের সবচেয়ে উঁচু বাটালি পাহাড়ের চারপাশটা যেন কেউ খুবলে খেয়ে গেছে।
প্রতি বর্ষায় এ পাহাড়ের
কিছু না কিছু অংশ ধসে পড়ে।
নগরের
কয়েকটি রাস্তার সংযোগস্থল টাইগারপাস। রাস্তার দুই পাশে উঁচু পাহাড়। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধেও
এখানকার পাহাড় গভীর বনজঙ্গলে ঢাকা ছিল। দিনদুপুরেও বাঘ দেখা যেত বলে নাম হয়েছিল টাইগার পাস। তবে এখন
এই পাহাড়সারির
কঙ্কালটাই যেন টিকে আছে। সেভাবে পার্সিভাল হিল, মোলহিল,
দেওয়ানবাড়ি
পাহাড়, গোদির
পাহাড়ের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। লালখানবাজার মোড় থেকে উত্তর-পশ্চিম কোনাকুনি সুউচ্চ
পাহাড়শ্রেণী ওয়্যারলেস
কলোনি পর্যন্ত বিস্তৃত। গত শতকের তিন দশক পর্যন্ত এখানে গভীর বন ছিল। এখানে বাঘের বিচরণ
ছিল বলেই এই পাহাড়ি এলাকাটির নাম বাঘঘোনা। তবে এখন বনজঙ্গলের অস্তিত্ব নেই। পাহাড় কেটে এখানেও গড়ে উঠেছে
আবাসিক এলাকা। খুলশী
আবাসিক এলাকার কথাই ধরা যাক। এটিও গড়ে উঠেছে পাহাড়েই।
গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের পশ্চিমে চারদিকে বিস্তীর্ণ পাহাড়ের পাদদেশে এক প্রাকৃতিক হ্রদ ছিল। লোকজন এই হ্রদের নাম দিয়েছিল ডেবা। এখন এই ডেবাটির অস্তিত্ব নেই। আর যে পাহাড়গুলোর কোলে ডেবার জন্ম হয়েছিল সেগুলোও বিলীন হতে হতে এখন নিশ্চিহ্ন প্রায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৬৫ সালে মোগল অভিযানের সঙ্গে এসেছিলেন পর্যটক শিহাবউদ্দিন আহমদ তালিশ। তাঁর ফতিয়া ই ইব্রিয়া বইতে তিনি লিখেছেন, ‘কর্ণফুলীর তীরে পরস্পর সন্নিহিত উঁচু-নিচু পাহাড়। সুরক্ষিত দুর্গ হিসেবে এটা মহাবীর আলেকজান্ডারের দুর্গের মতো দুর্ভেদ্য।’ চট্টগ্রামের দুর্ভেদ্য সেই পাহাড় আর নেই। শুধু নামগুলো আছে। প্রয়োজন মানুষকে হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছে। নির্বিচারে পাহাড় কাটার এই উৎসব চলছেই।
ওমর
কায়সার
তথ্যসূত্র
১. চট্টগ্রামের ইতিহাস: চৌধুরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্মা তত্ত্বনিধি
২. বন্দর শহর চট্টগ্রাম: আবদুল হক চৌধুরী
৩. কিংবদন্তির গল্প: সুচরিত চৌধুরী
৪. সুলতানী আমল: আবদুল করিম
৫. হাজার বছরের চট্টগ্রাম
সূত্রঃ
প্রথম আলো, তারিখঃ ০২-১১-২০১২ ইং
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।