বধির
বাবার আনন্দের অন্ত ছিল না নাকি যেদিন আমার জন্ম হয়; আর আমি হয়তো কেঁদেছিলাম ভূমিহীন, সম্পদহীন, সিন্ধুসম দারিদ্র্যের
দুর্বিপাকে পড়া এই পরিবারে
জন্মগ্রহণ করার কারণে। জন্মেছিলাম
এমন যে শঙ্কা ছিল কয়েক মাস
বাঁচব
হয়তো। শীর্ণ শরীর, ক্ষুদ্র পেট কিন্তু ঐরাবতের
ক্ষুধা। হিমশিম খেতে হয়েছিল সম্বলহীন মা-বাবাকে। শেষ পর্যন্ত চাচির দুগ্ধপান। শুনেছি, এমন ছিলাম
যে আদরে কারও কোলে ওঠা হয়নি। মা-বাবা
ছাড়া কেউ ভালোবেসেছে কি না,
জানি
না। শণের বেড়া, শণের ছাউনির ঘরে আমি যেন
ছিলাম এক চাঁদ। শিক্ষার হাতেখড়ির ক্ষণ বিস্মৃত; বিস্মৃত বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের ক্ষণও।
কিন্তু সুর করে উচ্চ স্বরে
ধারাপাত পড়া যেন এখনো কর্ণকুহরে বেজে ওঠে। আর
শীতের সকালে
মাদুর বিছিয়ে রবিরশ্মিতে কুসুমকোমল শরীর উষ্ণ করে বই পড়ার দিনগুলো স্মৃতিপটে ভাসে। যতদূর মনে পড়ে, বাড়ি থেকে এক পাড়া
পেরিয়ে চাচার সঙ্গে নগ্ন
পদব্রজে স্কুলের আঙিনায় পা রেখেছিলাম। তিনটি
কক্ষের প্রাইমারি স্কুল, অনেক
পুরোনো। স্কুলে যাওয়ার ব্যাকুলতা ছিল সব সময়। তাই আমার জামা নেই, খাতা নেই, কলম-পেনসিল নেই; চিন্তা না করে হররোজ পাড়ি
জমিয়েছি স্কুলে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার সময় আমার
শিক্ষকেরা আবিষ্কার করলেন
আমার মেধা। তাই পাঁচ টাকার বিনিময়ে যখন ভর্তি হতে
পারছিলাম না, তখন তাঁরা বিনা মূল্যে নতুন
শ্রেণিতে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। পঞ্চম
শ্রেণির পড়াশোনা
শেষ হলে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য তৈরি হলাম। বৃত্তি
পরীক্ষা দিতে হবে শহরে
পিটিআইয়ে গিয়ে। কিন্তু ভালো জামা কই, স্যান্ডেল-পাদুকা কই। শুরু হলো মায়ের চেষ্টা। ১০ টাকায়
সাদা রঙের রাবারের জুতা। জীবনের
প্রথম জুতা বলে
কথা। পরীক্ষার দিনে তাই জুতা পরে বাড়ি বাড়ি
গিয়ে দোয়া চেয়ে আসা। আল্লাহ
তাআলা আমার প্রথম শ্রমকে বিফল করেননি। তাই
আমিই প্রথম ওই স্কুল থেকে
বৃত্তি
পেলাম। এ খবর এলাকার লোকজনকে শুধু বিমোহিত
করেনি, বিস্মিতও
করেছে। আর তখন থেকেই হয়ে উঠলাম আলোচনার বিষয়।
দিন গড়িয়েছে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে; আর সঙ্গে অভাব-অনটন বেড়েছে ক্রমশ। উত্তরবঙ্গের মঙ্গায় তখন বগুড়াও আক্রান্ত হতো। মা বলতেন, সামনে কার্তিক মাস আসছে, কেমনে যে যাবে দিনগুলো? মুষ্টি করে জমানো খাবারদাবার শেষ হয়ে যাবে কয়েক দিনেই। সবারই প্রায় চাল বাড়ন্ত। তাই ধারকর্জ মেলে না। এক বছর মঙ্গায় এমন হলো যে তিন-চার দিন কোনো ভাত রান্না হলো না চালের অভাবে। কিন্তু পেট খালি হলে চলে! কয়েক দিন শুধু ডাঁটা ভাজি খেয়েই চলল। যে কারণে মনে হয় এ যাবৎ আমি আর কখনো ডাঁটা ভাজি খাইনি। একদিকে মঙ্গা, অন্যদিকে আগুনে কয়েক দফায় আমাদের বাড়ি পুড়ে যাওয়ায় আমরা কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিলাম না। এদিকে হাইস্কুলে যাওয়ার সময় হলো। ব্যয় বাড়ছে কিন্তু আয় কমছে। তাই পড়াশোনার সুযোগও অভাবের তাড়নায় তাড়িত হওয়ার পথে। বই কোথায় পাব, এখন তো আর বিনা মূল্যে বই পাওয়া যাবে না। আমার পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছাকে কেউ না কেউ সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সব সময়। তাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, এমন এক আপু তাঁর ষষ্ঠ শ্রেণির সব বই বিনা মূল্যে আমাকে দিয়েছিলেন। আবার তিনি যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেন, তখন আমাকে তাঁর সপ্তম শ্রেণির বইগুলো দিয়ে দিলেন। বই তো পেলাম কিন্তু পড়াশোনার প্রতিযোগিতায় আমি যে পিছিয়ে পড়ছিলাম। ত্রাতা হিসেবে এলেন আমার শিক্ষক আনিসুর রহমান। তিনি বললেন, ‘তুমি আমার ছোট ভাই। আমি তোমার পড়াশোনার দেখভাল করতে চাই বিনা উদ্দেশ্যে।’
তখন
থেকে সামান্য সামান্য
করে প্রতিযোগিতায় ফিরে আসি এবং নবম শ্রেণিতে প্রথম হই। কিন্তু অষ্টম শ্রেণির বৃত্তিটা আমি পেলাম না। এই প্রথম খুব কষ্ট পেলাম। মনে মনে পণ করলাম, আমি এসএসসি পরীক্ষায় খুবই
ভালো করে এই দুঃখ ঘুচাব। আমার শিক্ষাজীবন শুধু সংকটময়
নয়, দুর্বিষহ
হওয়ার উপক্রম প্রায়। যেহেতু
নবম শ্রেণির
বই দশম শ্রেণিতেও পড়তে হয়,
তাই
আমি আপুর কাছ থেকে কোনো বই পেলাম
না। শুরু হলো বই সংগ্রহের অভিযান। সব বই বাবদ প্রায় হাজার টাকার মামলা। কে দেবে?
চেয়ারম্যান, মেম্বার, গুণীজন, সজ্জন, কাউকে বলা শেষ রাখলাম না।
কিন্তু
পেলাম কই। শেষতক আমার স্যার বললেন, ‘আমি তোমাকে তোমার বই কিনে
দেব কিন্তু
অল্প অল্প করে।’ দেখলাম,
বই
কিনতে যে বেগ পেতে হলো আবেগে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করলে খরচের অভাবে হয়তো লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে
যাবে। এর চেয়ে ঢের ভালো মানবিকে পড়া। আমি হয়ে গেলাম মানবিকের ছাত্র। নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে
উত্তীর্ণ হলাম এবং আমার ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর মধ্যে নম্বরের পার্থক্য হলো ১০০। এবার আমার শিক্ষক মেধাকে আরও বিকশিত
করার আপ্রাণ
চেষ্টা শুরু করলেন; কাউন্সেলিং, প্রণোদনা এবং মনিটরিং। তাঁর কথায় চেষ্টায় আমি যেন নিজেকে
আরও বেশি বেগবান করলাম। অভাব-অনটনের
কথা ভুলে রাত-দিন
শুধুই পড়াশোনা। এসএসসি পরীক্ষার আগে আমার স্যার আমাকে
তাঁর বাসায় নিয়
গেলেন পূর্ণ তত্ত্বাবধানে। শেষ
করলাম এসএসসি পরীক্ষা। এখন ফল
বের হওয়ার
পালা। ১৭ জুনের (১৯৯৯) সপ্তাহ খানেক আগে আমি
আমার বন্ধুর সঙ্গে বলছিলাম
যে এসএসসির ফল ভালো হলে আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। ফল বের হলো। আমি
রাজশাহী বোর্ডে মানবিক শাখায় ষষ্ঠ স্থান লাভ করলাম কিন্তু সংবর্ধনা পেলাম যেন আমি
বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছি। নিজেকে
বোঝানোর চেষ্টা
করলাম, ‘এই হলো
আমার স্থান। কোনো কিছুর মোহে, কোনো কারণে এই স্থান থেকে আমি বিচ্যুত হব না।’
আমার ভালো ফল আমাকে অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি দিল। বগুড়ার তখনকার জেলা প্রশাসক সামসুল হক আমাকে মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন, যেটা দিয়ে আমার লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চলতে থাকল। এদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এককালীন অনুদান দেন এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুবর্ণ সুযোগ দেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ২০০১ সালে এইচএসসি শেষ করলাম বেশ ভালোভাবে, মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান। কিন্তু চারদিক যেন আবারও আর্থিক কষ্টের ঘনঘটা, আঁধার নামার আশঙ্কা। মনে হলো নিভে যাবে আমার উচ্চশিক্ষার আশার আলো। অলৌকিকভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়াল প্রথম আলো, যেন প্রভাতের সোনালি আলোয় ছড়ানো নতুন আশার আলো।
নূর মোহাম্মদ তালুকদার স্যারের
সহযোগিতায় প্রথম আলোর অনুষ্ঠানের
মাধ্যমে আবার শুরু হয় আমার উচ্চশিক্ষার মিশন। মতিউর রহমান স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে
বলেছিলেন, ‘তুমি
আমার ছোট ভাই। তুমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করবা না। শুধু পড়ালেখা করো।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষাজীবন যতটা
কঠিন হবে বলে ধারণা ছিল, তার
তেমন কিছু আঁচ করতে পারিনি। তালুকদার স্যার ও তাঁর পরিবার আমাকে
দিয়েছে পড়াশোনার সব সুযোগ। এভাবেই
শিক্ষাজীবন যবনিকাপাত
করে কর্মজীবনে পদার্পণ। কর্মজীবনের
শুরুতে গবেষণাকাজের সঙ্গে
জড়িয়ে
পড়ি। পড়ানো বা শিক্ষকতার যে ইচ্ছা তা আমি
ঝেড়েই ফেলেছিলাম। আমার বন্ধুরা আমাকে এ পেশায় যোগদানের
অনুপ্রেরণা দেয়। যে কারণে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক
হিসেবে যোগদান করি। দীর্ঘ
যুদ্ধময় শিক্ষাজীবন শেষে
আমি
উপলব্ধি করলাম, যে আলো
জ্বলেছিল অজানা এক গ্রামে,
সেটাকে
প্রজ্বলিত করার
পেছনে পর্যায়ক্রমে রয়েছে অনেক সহৃদয় ব্যক্তির নিঃস্বার্থ অবদান।
বাধা
ছিল বলেই সবলে তাকে প্রতিহত করে সামনে আসা। এমন সব
আলোর জন্য আমি বলব যে
নিজে নিভে যেয়ো না বরং নিজের মধ্যকার ক্ষীণ আলোকে জাগিয়ে ধরো আরও বেগবান করার জন্য, নিজেকে আলোকিত করো। আর সে আলোয় উপকৃত হোক সর্বজন।
আবদুল
খালেক
ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।