সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: বাধাকেই ভালোবাসলাম

বাধাকেই ভালোবাসলাম




বধির বাবার আনন্দের অন্ত ছিল না নাকি যেদিন আমার জন্ম হয়; আর আমি হয়তো কেঁদেছিলাম ভূমিহীন, সম্পদহীন, সিন্ধুসম দারিদ্র্যের দুর্বিপাকে পড়া এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করার কারণেজন্মেছিলাম এমন যে শঙ্কা ছিল কয়েক মাস বাঁচব হয়তোশীর্ণ শরীর, ক্ষুদ্র পেট কিন্তু ঐরাবতের ক্ষুধাহিমশিম খেতে হয়েছিল সম্বলহীন মা-বাবাকেশেষ পর্যন্ত চাচির দুগ্ধপানশুনেছি, এমন ছিলাম যে আদরে কারও কোলে ওঠা হয়নিমা-বাবা ছাড়া কেউ ভালোবেসেছে কি না, জানি নাশণের বেড়া, শণের ছাউনির ঘরে আমি যেন ছিলাম এক চাঁদশিক্ষার হাতেখড়ির ক্ষণ বিস্মৃত; বিস্মৃত বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের ক্ষণও


কিন্তু সুর করে উচ্চ স্বরে ধারাপাত পড়া যেন এখনো কর্ণকুহরে বেজে ওঠেআর শীতের সকালে মাদুর বিছিয়ে রবিরশ্মিতে কুসুমকোমল শরীর উষ্ণ করে বই পড়ার দিনগুলো স্মৃতিপটে ভাসেযতদূর মনে পড়ে, বাড়ি থেকে এক পাড়া পেরিয়ে চাচার সঙ্গে নগ্ন পদব্রজে স্কুলের আঙিনায় পা রেখেছিলামতিনটি কক্ষের প্রাইমারি স্কুল, অনেক পুরোনোস্কুলে যাওয়ার ব্যাকুলতা ছিল সব সময়তাই আমার জামা নেই, খাতা নেই, কলম-পেনসিল নেই; চিন্তা না করে হররোজ পাড়ি জমিয়েছি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার সময় আমার শিক্ষকেরা আবিষ্কার করলেন আমার মেধাতাই পাঁচ টাকার বিনিময়ে যখন ভর্তি হতে পারছিলাম না, তখন তাঁরা বিনা মূল্যে নতুন শ্রেণিতে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেনপঞ্চম শ্রেণির পড়াশোনা শেষ হলে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য তৈরি হলামবৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে শহরে পিটিআইয়ে গিয়েকিন্তু ভালো জামা কই, স্যান্ডেল-পাদুকা কইশুরু হলো মায়ের চেষ্টা১০ টাকায় সাদা রঙের রাবারের জুতাজীবনের প্রথম জুতা বলে কথাপরীক্ষার দিনে তাই জুতা পরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দোয়া চেয়ে আসা আল্লাহ তাআলা আমার প্রথম শ্রমকে বিফল করেননিতাই আমিই প্রথম ওই স্কুল থেকে বৃত্তি পেলামএ খবর এলাকার লোকজনকে শুধু বিমোহিত করেনি, বিস্মিতও করেছে আর তখন থেকেই হয়ে উঠলাম আলোচনার বিষয়

দিন গড়িয়েছে পরিবারের সদস্যসংখ্যা বেড়েছে; আর সঙ্গে অভাব-অনটন বেড়েছে ক্রমশউত্তরবঙ্গের মঙ্গায় তখন বগুড়াও আক্রান্ত হতোমা বলতেন, সামনে কার্তিক মাস আসছে, কেমনে যে যাবে দিনগুলো? মুষ্টি করে জমানো খাবারদাবার শেষ হয়ে যাবে কয়েক দিনেইসবারই প্রায় চাল বাড়ন্ততাই ধারকর্জ মেলে নাএক বছর মঙ্গায় এমন হলো যে তিন-চার দিন কোনো ভাত রান্না হলো না চালের অভাবেকিন্তু পেট খালি হলে চলে! কয়েক দিন শুধু ডাঁটা ভাজি খেয়েই চললযে কারণে মনে হয় এ যাব আমি আর কখনো ডাঁটা ভাজি খাইনিএকদিকে মঙ্গা, অন্যদিকে আগুনে কয়েক দফায় আমাদের বাড়ি পুড়ে যাওয়ায় আমরা কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিলাম নাএদিকে হাইস্কুলে যাওয়ার সময় হলোব্যয় বাড়ছে কিন্তু আয় কমছেতাই পড়াশোনার সুযোগও অভাবের তাড়নায় তাড়িত হওয়ার পথেবই কোথায় পাব, এখন তো আর বিনা মূল্যে বই পাওয়া যাবে নাআমার পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছাকে কেউ না কেউ সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সব সময়তাই সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন, এমন এক আপু তাঁর ষষ্ঠ শ্রেণির সব বই বিনা মূল্যে আমাকে দিয়েছিলেনআবার তিনি যখন অষ্টম শ্রেণিতে উঠলেন, তখন আমাকে তাঁর সপ্তম শ্রেণির বইগুলো দিয়ে দিলেনবই তো পেলাম কিন্তু পড়াশোনার প্রতিযোগিতায় আমি যে পিছিয়ে পড়ছিলামত্রাতা হিসেবে এলেন আমার শিক্ষক আনিসুর রহমানতিনি বললেন, ‘তুমি আমার ছোট ভাই আমি তোমার পড়াশোনার দেখভাল করতে চাই বিনা উদ্দেশ্যে 

তখন থেকে সামান্য সামান্য করে প্রতিযোগিতায় ফিরে আসি এবং নবম শ্রেণিতে প্রথম হইকিন্তু অষ্টম শ্রেণির বৃত্তিটা আমি পেলাম নাএই প্রথম খুব কষ্ট পেলামমনে মনে পণ করলাম, আমি এসএসসি পরীক্ষায় খুবই ভালো করে এই দুঃখ ঘুচাবআমার শিক্ষাজীবন শুধু সংকটময় নয়, দুর্বিষহ হওয়ার উপক্রম প্রায়যেহেতু নবম শ্রেণির বই দশম শ্রেণিতেও পড়তে হয়, তাই আমি আপুর কাছ থেকে কোনো বই পেলাম নাশুরু হলো বই সংগ্রহের অভিযানসব বই বাবদ প্রায় হাজার টাকার মামলাকে দেবে? চেয়ারম্যান, মেম্বার, গুণীজন, সজ্জন, কাউকে বলা শেষ রাখলাম না কিন্তু পেলাম কইশেষতক আমার স্যার বললেন, ‘আমি তোমাকে তোমার বই কিনে দেব কিন্তু অল্প অল্প করেদেখলাম, বই কিনতে যে বেগ পেতে হলো আবেগে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করলে খরচের অভাবে হয়তো লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে যাবেএর চেয়ে ঢের ভালো মানবিকে পড়াআমি হয়ে গেলাম মানবিকের ছাত্রনবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম এবং আমার ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারীর মধ্যে নম্বরের পার্থক্য হলো ১০০এবার আমার শিক্ষক মেধাকে আরও বিকশিত করার আপ্রাণ চেষ্টা শুরু করলেন; কাউন্সেলিং, প্রণোদনা এবং মনিটরিংতাঁর কথায় চেষ্টায় আমি যেন নিজেকে আরও বেশি বেগবান করলামঅভাব-অনটনের কথা ভুলে রাত-দিন শুধুই পড়াশোনাএসএসসি পরীক্ষার আগে আমার স্যার আমাকে তাঁর বাসায় নিয় গেলেন পূর্ণ তত্ত্বাবধানেশেষ করলাম এসএসসি পরীক্ষাএখন ফল বের হওয়ার পালা১৭ জুনের (১৯৯৯) সপ্তাহ খানেক আগে আমি আমার বন্ধুর সঙ্গে বলছিলাম যে এসএসসির ফল ভালো হলে আমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে নাফল বের হলোআমি রাজশাহী বোর্ডে মানবিক শাখায় ষষ্ঠ স্থান লাভ করলাম কিন্তু সংবর্ধনা পেলাম যেন আমি বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম হয়েছিনিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘এই হলো আমার স্থানকোনো কিছুর মোহে, কোনো কারণে এই স্থান থেকে আমি বিচ্যুত হব না

আমার ভালো ফল আমাকে অর্থকষ্ট থেকে মুক্তি দিলবগুড়ার তখনকার জেলা প্রশাসক সামসুল হক আমাকে মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে দেন, যেটা দিয়ে আমার লেখাপড়া ও সংসারের খরচ চলতে থাকলএদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এককালীন অনুদান দেন এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সুবর্ণ সুযোগ দেনমাননীয় প্রধানমন্ত্রী লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন২০০১ সালে এইচএসসি শেষ করলাম বেশ ভালোভাবে, মানবিক বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থানকিন্তু চারদিক যেন আবারও আর্থিক কষ্টের ঘনঘটা, আঁধার নামার আশঙ্কামনে হলো নিভে যাবে আমার উচ্চশিক্ষার আশার আলো অলৌকিকভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়াল প্রথম আলো, যেন প্রভাতের সোনালি আলোয় ছড়ানো নতুন আশার আলো 

নূর মোহাম্মদ তালুকদার স্যারের সহযোগিতায় প্রথম আলোর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবার শুরু হয় আমার উচ্চশিক্ষার মিশনমতিউর রহমান স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘তুমি আমার ছোট ভাইতুমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করবা নাশুধু পড়ালেখা করোবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন যতটা কঠিন হবে বলে ধারণা ছিল, তার তেমন কিছু আঁচ করতে পারিনিতালুকদার স্যার ও তাঁর পরিবার আমাকে দিয়েছে পড়াশোনার সব সুযোগএভাবেই শিক্ষাজীবন যবনিকাপাত করে কর্মজীবনে পদার্পণকর্মজীবনের শুরুতে গবেষণাকাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়িপড়ানো বা শিক্ষকতার যে ইচ্ছা তা আমি ঝেড়েই ফেলেছিলামআমার বন্ধুরা আমাকে এ পেশায় যোগদানের অনুপ্রেরণা দেয়যে কারণে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করিদীর্ঘ যুদ্ধময় শিক্ষাজীবন শেষে আমি উপলব্ধি করলাম, যে আলো জ্বলেছিল অজানা এক গ্রামে, সেটাকে প্রজ্বলিত করার পেছনে পর্যায়ক্রমে রয়েছে অনেক সহৃদয় ব্যক্তির নিঃস্বার্থ অবদান বাধা ছিল বলেই সবলে তাকে প্রতিহত করে সামনে আসাএমন সব আলোর জন্য আমি বলব যে নিজে নিভে যেয়ো না বরং নিজের মধ্যকার ক্ষীণ আলোকে জাগিয়ে ধরো আরও বেগবান করার জন্য, নিজেকে আলোকিত করোআর সে আলোয় উপকৃত হোক সর্বজন

আবদুল খালেক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক


সুত্রঃ প্রথম আলো, ০০:৪৬, নভেম্বর ০৯, ২০১৪

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।