লেখাপড়া শুরু হয়েছিল।
শেষ হয়নি। বিয়েটাও হলো বাল্যকালে। তবে আর্থিক টানাটানি শ্বশুরবাড়িতেও পিছু ছাড়ল না।
তবে পিছু হটেননি শরিফা খাতুন। অসুস্থ স্বামী, সংসার, সন্তান—সব সামলে নিজে হয়েছেন স্নাতক। নিজের
জীবনসংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে এলাকার ঝরে পড়া ও শ্রমজীবী শিশুদের জন্য তিনি তিনটি
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন বিএ পাস করেছেন। কেউ কেউ
চাকরিও করছেন।এখন যেখানেই বাল্যবিবাহের
খবর পান, সেখানেই ছুটে যান। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে বন্ধ করেন। কোনো পারিবারিক
নির্যাতন দেখলেই মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ান। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবার রাজশাহী জেলায়
‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ কার্যক্রম শরিফা খাতুনকে দিয়েছে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ জয়িতা’ সম্মাননা।
শরিফার বাড়ি বাঘা
উপজেলার বড় ছয়ঘটি গ্রামে। স্বামী মহসিন আলী পেশায় একজন দলিল লেখক। তাঁদের তিন সন্তান।
বড় মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া কুষ্টিয়া মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং সেন্টার থেকে পাস
করে এখন কুমিল্লা জেনারেল হাসপাতালে শিক্ষানবিশী করছেন। ছোট মেয়ে বাঘায় একটি কলেজে
উচ্চমাধ্যমিক পড়ছে। একমাত্র ছেলে ইমামুল মুরসালিন পড়ে নার্সারি শ্রেণিতে।
১৯৯০ সালের কথা।
তখনো শরিফার এসএসসি পরীক্ষার ফল বেরোয়নি। অসচ্ছল কৃষক বাবা তখন শরিফা খাতুনের বিয়ে
দেন। স্বামীও তখন বেকার। শরিফার পড়াশোনার আপাত ইতি ঘটলেও তিনি হাল ছাড়েননি। বিয়ের
১৪ বছর পর শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেছেন। মনের মতো করে
নিজের জীবনকে গড়ে নিতে পারেননি—এই ব্যথা সব সময় তাঁকে তাড়িত করে। তিনি লক্ষ করেন আশপাশের ছেলেমেয়েরা দারিদ্র্যের
কারণে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। আবার শ্রমজীবী হয়েই জীবন শুরু করছে।
১৯৯৫ সাল থেকে এই
শিশুদের জন্য তিনি আন্দোলনে নামেন। শরিফা এলাকার বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূর করার প্রয়োজনটাও
বোঝেন। এ জন্য বয়স্ক শিক্ষাও চালু করেন। ঝরে পড়া শিশুদের জন্য ব্র্যাকের সহযোগিতায়
বড় ছয়ঘটি গ্রামে দুটি এবং হিজলপল্লি গ্রামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর
বাঘা উপজেলার বড় ছয়ঘটি গ্রামে গিয়ে শরিফা খাতুনকে পাওয়া গেল। গ্রামের বাচ্চারা সবাই
তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি একটা বই ধরে সবাইকে বোঝাচ্ছেন। এই বিদ্যালয়ের জন্য
জমি দিয়েছেন গ্রামের চৌকিদার আবদুর রাজ্জাক। তিনি জানান, শরিফা উদ্যোগ নিয়ে এই বিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিছুদিন নিজে শিক্ষকতা করেছিলেন। আরেকজন শিক্ষককে দায়িত্ব দিয়ে
চলে গেছেন। এখনো তিনি বিদ্যালয়ে দেখাশোনা করেন। শরিফার একতলা টিনশেডের
একটি পাকা বাড়ি। প্রদাহের কারণে তাঁর স্বামীর একটি পায়ের পাতা সামনে দিক থেকে কেটে
ফেলতে হয়েছে। শরিফা জানান, স্বামীর চিকিৎসা করাতে তিনি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। কোনো
উপায় না দেখে স্বামীর চিকিৎসার জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
তিনি এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন। তাই দিয়ে পা-টা বাঁচানো গেছে।
কথা বলতে বলতেই শরিফার
এক ছাত্রী মিতার মা চামেলী খাতুন এলেন। তিনি জানালেন, শরিফার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা
নিয়ে তাঁর মেয়ে বিএ পাস করেছেন। এখন চাকরি করেন। গ্রামের কৃষক মাজদার
রহমান অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর মেয়ে শরিফা খাতুনকে বিয়ে দিচ্ছিলেন। খবর পেয়ে
এই শরিফা ছুটে যান। তাঁর কথায় বিয়ের আসর ভেঙে যায়। সেই মেয়ে এখন স্নাতক শ্রেণিতে পড়ছেন। নারী নির্যাতন বন্ধ
করার জন্য শরিফা কমিউনিটি পুলিশের সদস্য হয়েছেন। যেখানেই নির্যাতনের খবর, সেখানেই গিয়ে
শরিফা হাজির। বর্তমানে এলাকার ৬০ জন দুস্থ নারীকে নিয়ে ‘স্বনির্ভর নারী কল্যাণ সংস্থা’ গঠন করেছেন, যেটি কাজ করবে নারীদের
জন্য।
নিজে যেসব বাধা পেরিয়ে
এসেছেন, এখন অন্যদের জীবনের সেসব বাধা দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন শরিফা।
সূত্রঃ প্রথম আলো
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।