সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: Sonar Technology- জলের তলে খোঁজাখুঁজি

Sonar Technology- জলের তলে খোঁজাখুঁজি


সাগর-মহাসাগর বা নদীতে জলের তলে কী আছে, তা দেখার প্রযুক্তি সোনার। সাউন্ড নেভিগেশন অ্যান্ড রেঞ্জিংয়ের সংক্ষিপ্ত রূপ সোনার। জলপথে চলাচল, তলদেশে বা তলদেশেরও নিচে কোনো বস্তুর (যেমন নিমজ্জিত জলযান) খোঁজ বা যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে পানির মধ্যে শব্দ ছড়ানোর কৌশল এই সোনার প্রযুক্তি। আবার পানির গভীরতা পরিমাপের (বেদিমেট্রি) বেলাতেও ব্যবহৃত হয় এই প্রযুক্তি। সাগরতলের মানচিত্র বা নেভিগেশনাল ম্যাপ তৈরির কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় সোনার প্রযুক্তি। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে পদ্মায় ডুবে যাওয়া পিনাক-৬ লঞ্চের খোঁজেও ব্যবহার করা হয়েছে সোনার। জানা যাক এ প্রযুক্তির বিস্তারিত।

দুই ধরনের সোনার রয়েছে—প্যাসিভ ও অ্যাকটিভ। প্যাসিভ সোনারে কোনো শব্দ-উৎস (যেমন অন্য কোনো জাহাজের শব্দ) বের করা হয়। অ্যাকটিভ সোনারে শব্দের স্পন্দন পাঠিয়ে সেটির প্রতিধ্বনি শোনা হয়। সোনারে ব্যবহৃত শব্দ-কম্পাঙ্ক অনেক নিচু মাত্রার ইনফ্রাসোনিক থেকে অতি-উচ্চমাত্রার আলট্রাসনিক পর্যন্ত হতে পারে। পানির নিচের এই প্রযুক্তিবিদ্যা ‘হাইড্রোঅ্যাকুস্টিকস’ হিসেবে পরিচিত। শব্দ-তরঙ্গের ওপরে নির্ভর করে সোনার প্রযুক্তি। সোনার খুব দ্রুতগতিশীল। ৭০ মিটার গভীরতায় শব্দ-সংকেতের যাওয়া ও আসা মিলিয়ে মোট পরিভ্রমণে লাগে মাত্র সিকি সেকেন্ড সময়। রাডার ও সোনারের মধ্যে প্রযুক্তিগত মিল রয়েছে। বায়ুমণ্ডলে রাডারে ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ। আর পানির নিচে সোনারে ব্যবহৃত হয় শব্দের চাপ উৎসারিত অ্যাকুস্টিক তরঙ্গ।

প্রাণিজগতে হাজার হাজার বছর আগে থেকেই থেকেই ডলফিন ও বাদুড় যোগাযোগ ও বস্তুর সন্ধানে শব্দ-তরঙ্গ ব্যবহার করে আসছে। তবে মানুষের বেলায় পানিতে ১৪৯০ সালে প্রথম এ রকম ব্যবহার লক্ষ করেন লেওনার্দো দা ভিঞ্চি। ১৯ শতকে বাতিঘরের বিকল্প হিসেবে জলের তলে বিপদ-আপদ শনাক্ত করতে নিমজ্জিত ঘণ্টার ব্যবহার ছিল। ১৯১২ সালে টাইটানিক জাহাজের দুর্ঘটনার পরে সাগরতলে কোনো কিছু শনাক্ত করার জন্য শব্দের প্রতিধ্বনি ব্যবহারের গুরুত্ব বেড়ে যায়। ১৯৩০ সালের দিকে মার্কিন প্রকৌশলীরা জলের তলে শব্দ শনাক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন।

ডলফিনের ইকোলোকেশন প্রক্রিয়া
১. ডলফিন তার নাকের মধ্যকার বায়ুপথ ব্যবহার করে একটা ক্লিক করে এবং কপালের মাঝ দিয়ে প্রেরণ করে থাকে। পানিতে পাঠানোর আগে সবগুলো শব্দ-ধারাকে একটা বিমে ফোকাস করে।
২. শব্দ যখন পানির নিচে কোনো বস্তুতে আঘাত করে, প্রতিধ্বনি রূপে এটা ফিরে আসে ডলফিনের কাছে।
৩. ডলফিন তার চোয়াল দিয়ে এই প্রতিধ্বনিকে গ্রহণ করে।
৪. চোয়ালের চর্বির মাঝের একটা পথ দিয়ে ডলফিনের কানের গভীর দেশে প্রেরণ করে দেয়; এরপর স্নায়ুর স্পন্দনকে মস্তিষ্কের সঙ্গে বিনিময় করে বস্তুর বৈশিষ্ট্য যেমন আকার, আকৃতি ও ধাতু নির্ণয় করে থাকে।


অ্যাকটিভ সোনারে ব্যবহৃত হয় একটা শব্দ-প্রেরক ও শব্দগ্রাহক যন্ত্র। অ্যাকটিভ সোনার থেকে শব্দের একটা স্পন্দন সৃষ্টি করা হয়। সাধারণত একে ‘পিং’ বলা হয়ে থাকে। একটা সংকেত উৎপাদক, পাওয়ার অ্যামপ্লিফায়ার এবং একটা ইলেকট্রো-অ্যাকুস্টিক ট্রান্সডিউসার/অ্যারে সমৃদ্ধ সোনার প্রক্ষেপক থেকে তৈরি হয় এই স্পন্দন। সৃষ্ট অ্যাকুস্টিক পাওয়ারকে একটা বিম বা ধারায় সংকুচিত করে আনার জন্য ব্যবহৃত হয় একটা বিম-ফর্মার। পাঠানো বিম বিশ্লেষণ-প্রক্রিয়ায় কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে—মানুষের শ্রবণশক্তি, ডিসপ্লে পর্দ বা সফটওয়্যার। স্পন্দন প্রেরণ থেকে গ্রহণ করা পর্যন্ত সময়কে পানির নিচে শব্দের গতির (প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১ দশমিক ৫ কিলোমিটার) সঙ্গে সমন্বয় করে নিমজ্জিত কোনো বস্তু থেকে দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়। এই স্পন্দনের কম্পনি পরিবর্তনশীল বা অপরিবর্তনশীল হতে পারে। সরণশীল লক্ষবস্তুর ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীল কম্পনির সাহায্যে ডপলার পরিবর্তন পরিমাপ করে শনাক্ত করার চেষ্টা করা হয়।

একটা কার্যকরী ছোট আকারের সোনার রয়েছে, যা দেখতে পানিরোধী টর্চলাইটের মতো। পানির দিকে লক্ষ করে বোতামে চাপ দিলে দূরের লক্ষ্যবস্তুর দিকের দৃশ্য ফুটিয়ে তোলে। আরেক রকমের সোনারে দেখা যায় মাছের ঝাঁক। পানির ওপরে ভাসমান যানের ট্রান্সডিউসার থেকে তলদেশের দূরত্ব পরিমাপ করার ক্ষেত্রে সোনার ব্যবহার করা হলে সেটাকে বলা হয় ইকো-সাউন্ডিং। পানির নিচ থেকে ওপরের দিকের তরঙ্গ পরিমাপ করার সময়ে তাকানো হয় ওপরের দিকে। পরিষ্কার পানি এবং পর্যাপ্ত আলোতে মানবীয় চোখ বা ক্যামেরায় ৫ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত দৃশ্যমান থাকে। বিশেষ করে নদী, হ্রদ, আবদ্ধ জলাশয়, উপকূলবর্তী এলাকার পানি ঘোলা হওয়ায় পানির তলে দৃশ্যমানতা কমে যায়। তবে, প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে বর্তমানে আধুনিক মডেলের সোনারে এসব অনেকাংশেই দূর হয়েছে।

মাছ ধরা এবং জলযান চালানোর ক্ষেত্রে চিরপ (কমপ্রেসড হাই ইনটেনসিটি রেডিয়েটেড পালস) হলো সবচেয়ে উন্নত মানের সোনার প্রযুক্তি। মানসম্পন্ন সোনার প্রযুক্তিতে একেকবার একটি করে কম্পনি প্রেরণ করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই একবারে একটি প্রতিফলিত কম্পনি ফিরে আসে। প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাণও সীমিত। অন্যদিকে নিচু থেকে উঁচু মাত্রার একটানা কম্পনি প্রেরণ করে থাকে চিরপ। ফিরে আসার পর প্রত্যেকটি কম্পনিকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে চিরপ। এর চিরপের মাধ্যমে তুলনামূলকভাবে ব্যাপক তথ্য পাওয়া যায় বলে উচ্চ রেজ্যুলেশনের অনেক স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়।
সাজিদ হোসেন
চার্টার্ড নৌ প্রকৌশলী

সূত্রঃ প্রথম আলো, ২২ আগস্ট ২০১৪ খ্রিঃ

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।