সাপ দেখলেই হইচই পড়ে যায়। ছড়িয়ে পড়ে
আতঙ্ক। মারার জন্য উদ্যত হয় সবাই। কিন্তু একজন ভিন্ন। তিনি সাপ বাঁচাতে ছোটেন সবখানে। কক্সবাজারের
টেকনাফ কিংবা উখিয়ায় সাপ ধরা পড়লে ডাক পড়ে তাঁর। পরম মমতায় সাপ উদ্ধার করে ছেড়ে
দেন বনে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে
ডাকেন ‘সাপের বন্ধু’।
শুধুই কী সাপ,রক্ষা করে চলেছেন কাছিম, শিয়াল
ও হরিণ। দিনে দিনে হয়ে উঠেছেন প্রাণীদের আপনজন। তিনি আমিন উল্লাহ (৪২)। সবাই চেনেন
সোনা মিয়া নামে।
উখিয়া উপজেলার জালিয়াপাড়া ইউনিয়নের
ছোট ইনানী গ্রামের বাসিন্দা তিনি। সোনা মিয়া সর্বশেষ ২৪ এপ্রিল উখিয়ার বড় ইনানীর
ছায়াবটতলা গ্রাম থেকে একটি অজগর সাপ উদ্ধার করে বনে ছেড়ে দেন। এটি আগের দিন রাতে
একটি মুরগির খামারে ঢুকে পড়ে। সোনা মিয়া জানান, প্রায়
৯ ফুট লম্বা পুরুষ অজগরটি খাবারের সন্ধানে মুরগির খামারে ঢুকেছিল। এটির ওজন প্রায়
পাঁচ কেজি। ২৪ এপ্রিল ইনানী সৈকতে গেলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি
সৈকতে একটি চায়ের দোকান চালান। এ দোকানের আয়ে চলে স্ত্রী,
চার সন্তানসহ ছয়জনের সংসার। কথার শুরুতেই জানতে চাইলাম এত কিছু
থাকতে সাপ নিয়ে কেন কাজ করছেন? মুচকি হেসে
সোনা মিয়া বলেন,‘কাউকে
না কাউকে তো এদের বাঁচাতে হবে।’
সোনা মিয়া জানান, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উখিয়ার বনাঞ্চলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ভেঙে পড়ে হাজার হাজার গাছপালা। খাদ্য সংকটে পড়ে গুইসাপ আর বেজি লোকালয়ে চলে আসত। লোকজনের ঘরের হাঁস–মুরগি, কবুতর ও গাছের ফল খেয়ে ফেলত। ওই সময় গ্রামে গ্রামে উঠতি বয়সী ছেলেরা দল বেঁধে গুইসাপ ও বেজি শিকারে নামত। এসব দেখে ওই প্রাণীদের প্রতি মায়া জমে যায়। কিছুদিন পর ছেলেদের বুঝিয়ে আহত গুই সাপ ও বেজি জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া শুরু করেন।
অভাবের সংসারে বেড়ে ওঠা সোনা মিয়ার
লেখাপড়া করা হয়নি। ১৯৯২ সালে ১৭ বছর বয়সে গাছ পরিবহন কাজে নিয়োজিত হাতির মাহুত
হিসেবে কাজে যোগ দেন। প্রায় দুই বছর এ কাজে ছিলেন। তখন থেকেই পুরোদমে বন্য
প্রাণী রক্ষায় মনোযোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনি যোগ দেন ‘ইনানী
রক্ষিত বনাঞ্চল সহব্যবস্থাপনার প্রকল্পে’।
আরণ্যক ফাউন্ডেশন ও কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সহযোগিতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন
করছে বেসরকারি সংস্থা সোসাইটি ফর হেলথ এক্সটেনশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (শেড)।
অপরিকল্পিতভাবে বনজ সম্পদ আহরণ, পাহাড় নিধন
ও অবাধে বন্য প্রাণী শিকার না করতে মানুষকে সচেতন করেন।
সোনা মিয়া জানান,
বন্য প্রাণী উদ্ধারের হিসাব অনেক দিন রাখেননি। ২০১৪ সাল থেকে
হিসাব রাখছেন। তাঁর দেওয়া
হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত ৩৫০টির মতো বিভিন্ন প্রজাতির সাপ উদ্ধার করে বনে
ছেড়েছেন। ২০১৫ সালে তিনটি গুইসাপসহ অন্তত ২৫টি শিয়াল ও ২০১৬ সালে উদ্ধার করেন
একটি শিয়াল, ৪০টির বেশি বন মোরগ ও ৩৫টি কাছিমসহ অসংখ্য বাদুড়।
একই বছর উদ্ধার করেন একটি হরিণও। এ ছাড়া ২০১৫ সালে কুকুরের আক্রমণ থেকে প্রাণে
রক্ষা করেছিলেন সৈকতে ডিম পাড়তে আসা আটটি সামুদ্রিক মা–কাছিমকে।
এসব কাছিম থেকে পাওয়া ৪৪৩টি ডিম সংরক্ষণ করে বাচ্চা ফোটানো হয়। যা পরে সাগরে
অবমুক্ত করা হয়েছিল। সাপ ধরা তো ঝুঁকির। কীভাবে কী করেন?
সোনা মিয়া বলেন, ‘নিজে
নিজেই ধরা শিখেছি। বড় কথা কৌশল। সেটা আমি জানি।’
ইনানী বন রেঞ্জ কর্মকর্তা সুনীল কুমার দেব রায় বলেন, ‘বন্য প্রাণী সংরক্ষণের নিবেদিত প্রাণ সোনা মিয়াকে নিয়ে এখন এলাকার মানুষ গর্ব করে। লোকজনের ঘরবাড়ি, চিংড়ি পোনা উৎপাদনের হ্যাচারি কিংবা দোকানপাটে সাপ ঢুকলেই সোনা মিয়ার ডাক পড়ে। আমরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বহু সাপ ধরেছি। পরে সেই সাপগুলো জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। তা ছাড়া তিনি শিয়াল ও কাছিম রক্ষায়ও কাজ করেন।’
সহব্যবস্থাপনা প্রকল্পের প্রকল্প
সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন জানান, সোনা মিয়া
এই প্রকল্পের একজন উপকারভোগী এবং বন পাহারা দলের সদস্য। একসময় তিনি বনে কাঠ
কাটতেন। এখন তিনি বন্য প্রাণী রক্ষার প্রহরী। বনাঞ্চল রক্ষার ব্যাপারে লোকজনকে
সচেতন করছেন তিনি। বিকল্প জীবিকায়নের জন্য শেড ৩০ হাজার টাকা দিয়ে সোনা মিয়াকে চা
ও ভাত বিক্রির একটি দোকান খুলে দিয়েছে। ব্যবসার পাশাপাশি সাপের কবল থেকে লোকজনকে
রক্ষা করে তিনি ‘সাপের বন্ধু’ খেতাব পেয়েছেন। শাহাদাত হোসেন বলেন,
‘সম্প্রতি আমরা সোনা মিয়ার জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহ
করে পুরস্কারের জন্য দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়েছি।’ সোনা
মিয়া বলেন, ‘পুরস্কারের
আশায় বন্য প্রাণী বাঁচাতে কাজ করছি না। তাদের জন্য আমার মায়া লাগে তাই করছি।
প্রাণিকুলকে বাঁচাতে সব সময় কাজ করে যাব।’
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।