তুলি আগামীবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। একদিন সকালে ঘুম
থেকে উঠে ব্রাশ করতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করল তার মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে গেছে, ডান চোখ বন্ধ হচ্ছে না, কুলি করতে গেলে অন্য
পাশে চলে যায়। তুলি ভয়ে চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করল। চিৎকার শুনে তুলির মা
দৌড়ে এলেন। মেয়েকে দেখে মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তুলির বাবা অফিসে চলে গিয়েছিলেন।
মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলেন।
মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন কিন্তু কোন
বিষয়ের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাবেন তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। কারণ একদিকে মুখে
সমস্যা অন্যদিকে চোখ বন্ধ হয় না, দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন।
এমন সময় তুলির এক আত্মীয় বললেন, আমার এই ধরনের সমস্যা
হয়েছিল একজন ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও চিকিৎসায় আমি ভালো হয়েছি। মেয়েকে ওই
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার সাহেব রোগের বর্ণনা শুনে তুলিকে আশ্বস্ত
করলেন। বললেন, এটাকে ফেসিয়াল পলসি বা বেলস পলসি বলা হয়।
এই রোগ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই তবে শুধু ওষুধে এটা ভালো হয় না। ওষুধের পাশাপাশি
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হবে ও কিছু ব্যায়াম ও নিয়মকানুন মেনে চললে রোগী সুস্থ
হয়ে যাবে। তুলির বাবা-মা কিছুটা স্বস্তি পেলেও টেনশনমুক্ত হতে
পারলেন না কারণ সামনে মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা। তাই তুলির বাবা মেয়েকে নিয়ে গেলেন
আরেকজন নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনিও একই কথা বললেন।
ফেসিয়াল পলসি বা বেলস পলসি কী
এটা এক ধরনের প্যারালাইসিস। আমাদের সপ্তম ক্রেনিয়াল
নার্ভটিকে ফেসিয়াল নার্ভ বলে। যখন এটি আংশিক বা সম্পূর্ণ প্যারালাইজড হয়ে যায় তখন
তাকে ফেসিয়াল প্যারালাইসিস বা পলসি বলা হয়। জন বেল নামের এক ভদ্রলোক এই রোগটি প্রথম
আবিষ্কার করেন সেজন্য একে বেলস পলসিও বলা হয়।
কাদের বেশি হয়
এটি যে কোনো বয়সের মহিলা ও পুরুষের হতে পারে, তবে পুরুষের তুলনায় মহিলাদের এই রোগটি বেশি দেখা যায়।
কেন হয়
* ভাইরাল ইনফেকশন
* মধ্য কর্ণে ইনফেকশন
* ঠাণ্ডাজনিত কারণ
* আঘাতজনিত
* মস্তিষ্কের স্ট্রোকজনিত কারণ
* ফেসিয়াল টিউমার
* কানের অপারেশন পরবর্তী ফেসিয়াল নার্ভ ইনজুরি ইত্যাদি
লক্ষণ
* আক্রান্ত রোগীর মুখ একদিকে বাঁকা হয়ে যায়
* আক্রান্ত পাশের চোখ বন্ধ হয় না ও চোখ দিয়ে পানি পড়ে
* কুলি করতে গেলে অন্য পাশে চলে যায়
* খাবার গিলতে কষ্ট হয়
* কপাল ভাঁজ করতে পারে না
* অনেক সময় কথা বলতে কষ্ট হয়
রোগ নির্ণয়
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ও
রোগীর ইতিহাস জেনে রোগ নির্ণয় করতে পারেন, তবে অনেক
সময় কিছু প্যাথলজিক্যাল ও রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা করার প্রয়োজন পড়ে। যেমন-
* কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট উইথ ইএসআর
* এক্স-রে অফ টিএম (টেম্পরো-মেন্ডিবুলার) জয়েন্ট
* নার্ভ কন্ডাকশন ভেলসিটি (এনসিভি) অফ ফেসিয়াল নার্ভ।
চিকিৎসা
চিকিৎসা কারণের ওপর নির্ভর করে। ওষুধ কারণ অনুযায়ী ভিন্ন
ভিন্ন, তবে সব ক্ষেত্রেই ওষুধের পাশাপাশি মূল চিকিৎসা হল
ফিজিওথেরাপি। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক রোগীর অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের
ট্রিটমেন্ট প্লান করে থাকেন তার মধ্যে
* প্রোপ্রাইওসেপ্টিভ নিউরো মাস্কুলার ফ্যাসিলিটেশন
* ইনফ্রারেড রেডিয়েশন থেরাপি
* ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন থেরাপি
* অ্যাক্টিভ ও প্যাসিভ ফ্যাসিয়াল মাসল এক্সারসাইজ
* স্পিচ রি-এডুকেশন থেরাপি
* ব্যালুনিং এক্সারসাইজ
* রিংকলিং এক্সারসাইজ ইত্যাদি
অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি থেকে দিনে ২-৩ বার ফিজিওথেরাপি
নিলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়।
রোগীর সতর্কতা
চিকিৎসা চলাকালীন রোগীর কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
যেমন-
* ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে দূরে থাকতে হবে
* আইসক্রিম ও ফ্রিজের ঠাণ্ডা খাবার খাওয়া যাবে না
* বাইরে বা রোদে গেলে চোখে সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে যেন
আক্রান্ত চোখে ধুলাবালি ঢুকতে না পারে।
* রাতে ঘুমানোর সময় আক্রান্ত চোখের ওপর রুমাল বা নরম কাপড়
দিয়ে রাখতে হবে যাতে কোনো কিছু চোখের মধ্যে না পড়ে।
* চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যায়াম করতে হবে।
ডা. এম ইয়াছিন আলী
বাত, ব্যথা, প্যারালাইসিস ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ,
চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালটেন্ট,
ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি
হাসপাতাল, ধানমণ্ডি, ঢাকা
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।