মহাবিশ্বের সব কিছুই পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়তই ঘটছে কোন না কোন পরিবর্তনের ঘটনা। এর কোনটি মানুষের সংস্পর্শে আর কোনটি প্রকৃতির আপন নিয়মে। নতুনত্বের সন্ধানে মানুষ ক্রমশ ই ছুটছে নিত্য নতুন সব আবিস্কারের পেছনে। কখনো সাধ্যের মধ্যে আছে এমন কিছু কখনো এমন কিছু করছে যা, শুধুমাত্র কল্পনাতেই ভাবা সম্ভব। মহাশূন্য অভিযানে এক নতুন সাফল্য অর্জনের মধ্য দিয়ে মার্কিন মহাকাশ সংস্থা 'নাসা' নববর্ষ উদযাপন করেছে। নাসার গ্রেইল মিশনের দুটি নভোযান চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করেছে। এখন এই জোড়া নভোযান কক্ষপথে থেকে চাঁদকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলবে এবং চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তারতম্য কেন ও কোথায় হয় তা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা চালাবে যা এর আগে আর কখনো হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, নভোযান দুটির এ মিশনের মধ্য দিয়ে চাঁদ ও পৃথিবীর বিবর্তন সম্পর্কিত আমাদের ধারণা ও জ্ঞানের পরিধি বহুদূর প্রসারিত হবে।
'গ্রেইল' শব্দটা গ্র্যাভিটি রিকভারি অ্যান্ড ইন্টেরিয়র ল্যাবরেটরি কথাগুলোর সংক্ষেপ। গ্রেইল মিশনের দুই নভোযান গ্রেইল-ক ও গ্রেইল-খ গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর চন্দ্র অভিমুখে উৎক্ষেপণ করা হয়। ১০০ দিনেরও বেশি পথ পরিক্রমার পর নভোযান দুটি ২৫ ঘণ্টার ব্যবধানে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। এ ক্ষেত্রে দুটো নভোযানই মূল ইঞ্জিন চালু করে গতিবেগ কমিয়ে এনে দক্ষিণ মেরুর উপর উপ-বৃত্তাকার কক্ষপথে গিয়ে ঢোকে। প্রথমে ঢোকে গ্রেইল-ক এবং সেটা ৩১ ডিসেম্বর। গ্রেইল-খ ঢোকে ২৫ ঘণ্টা পর ১ জানুয়ারি। দুটো নভোযান প্রায় সাড়ে ১১ ঘণ্টায় চাঁদকে পরিক্রমণ করে চলেছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েক দফা ইঞ্জিন চালুর মধ্য দিয়ে দুই নভোযানের চন্দ্র পরিক্রমণের সময় কমিয়ে দু'ঘণ্টারও নিচে আনা হবে। ২০১২ সালের চলতি মার্চে মিশনের বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম শুরু হলে দুই নভোযান মেরুর কাছাকাছি প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে চন্দ্র প্রদক্ষিণ করবে। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে তখন দুই নভোযান ৩৪ মাইল উঁচুতে থাকবে।
গ্রেইলের বৈজ্ঞানিক মিশনে দুই নভোযান তাদের মধ্যকার দূরত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ করে পৃথিবীতে বেতার সংকেত পাঠাবে। চাঁদের অসম মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রগুলোর ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নভোযান দুটির গতির সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি হবে। চাঁদের ভরের বণ্টন সব জায়গায় সমান নয়। তার ফলে মাধ্যাকর্ষণের তারতম্য হয়ে থাকে। এর স্বাভাবিক দৃষ্টান্ত হলো চাঁদের পৃষ্ঠদেশে বড় বড় পর্বতমালা ও বাইরের বস্তুর গভীর অভিঘাতে সৃষ্ট বিশাল বিশাল গর্ত। তবে এ ছাড়াও চন্দ্রপৃষ্ঠের ভেতরের শিলারাশির বিন্যাস এক রকম নয় বরং অসম। কোথাও অত্যধিক ঘন, কোথাও যথেষ্ট হালকা। নভোযান দুটি এসব স্থানের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ টানের ওপর সূক্ষ্ম প্রভাব টের পাবে। সেই টানের তারতম্য তাদের যন্ত্রে ধরা পড়বে। মাধ্যাকর্ষণের তারতম্যের কারণে নভোযান দুুটির মধ্যকার দূরত্বেও সামান্য পরিবর্তন হবে।
বিজ্ঞানীরা এ তথ্যাবলীকে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের হাই রেজলিউশন মানচিত্রে রূপান্তরিত করবে। এ তথ্যাবলীর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচে কি চলছে বুঝতে পারবে। তাতে পৃথিবী ও চাঁদ কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্ব হিসেবে গড়ে উঠেছে সে সম্পর্কিত আমাদের জ্ঞান বিস্মৃত হবে। উভয় নভোযানে গ্রেইল মুনক্যাম নামে একটি ক্ষুদ্র ক্যামেরা আছে। সেই ক্যামেরার একমাত্র কাজ হলো সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রের মিডন স্কুলগুলোর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে চন্দ্রবিষয়ক বিভিন্ন তথ্য জানতে সাহায্য করা। তবে মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রবিষয়ক হাই রেজলিউশন মানচিত্র ও উঁচু-নিচু পৃষ্ঠদেশের অন্যান্য ছবি দেখে বিজ্ঞানীরা চাঁদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও গঠন বিন্যাস সম্পর্কে সম্ভাব্য ধারণা লাভ করতে পারেন।
গ্রেইল নভোযান দুটির ম্যাপিংয়ের কাজ জুনের প্রথমভাগ পর্যন্ত ৮২ দিন ধরে চলবে। চাঁদ এরপর পৃথিবীর পেছনে ছায়ায় ঢাকা পড়ে যাবে। কয়েক ঘণ্টার এ অন্ধকারে নভোযান দুটো যদি বেঁচে থাকতে পারে অর্থাৎ স্রেফ তাদের ব্যাটারির ওপর নির্ভর করে চলতে পারে তাহলে বছরের দ্বিতীয়ার্ধে তারা দ্বিতীয় দফা ম্যাপিংয়ের কাজ চালাবে। তখন সে কাজটা পরিচালিত হবে আরও নিচে নেমে এসে। সম্ভবত তখন নভোযান দুটি থাকবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৫ কিলোমিটার উপরে। গ্রেইল মিশনের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০ কোটি ডলার। দুটি নভোযানের প্রতিটির ওজন ৩০০ পাউন্ড। এগুলো দেখতে ওয়াশিং মেশিনের আকারের। * রকমারি ডেস্ক
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।