সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: আমাজান নদ যেন এক বিস্ময়

আমাজান নদ যেন এক বিস্ময়



দৈর্ঘ্যে আফ্রিকার নীলনদের পরপরই আমাজান নদের স্থান হলেও অনেক ক্ষেত্রে নীলনদের চেয়ে এগিয়ে আছে আমাজান নদ। দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ ছুঁয়ে বনসাম্রাজ্য আমাজানিয়ার বুক চিরে এঁকে-বেঁকে আটলান্টিক মহাসাগরে পতিত হয়েছে বিস্ময়কর এ আমাজান নদ। আমাজান নদ প্রতি সেকেন্ডে এক লাখ পঁচাত্তর হাজার ঘনমিটার পানি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আটলান্টিকে। পৃথিবীর তাবৎ নদনদী হয়ে যত পানি সাগর-মহাসাগরে পতিত হচ্ছে এর এক-পঞ্চমাংশ পতিত হয় কেবল আমাজান হয়েই।
পানিপ্রবাহের এ পরিমাণ পৃথিবীর অন্য বৃহৎ ও দীর্ঘ নদী কঙ্গো অপেক্ষা পাঁচ গুণ এবং মিসিসিপি'র তুলনায় দশ গুণ। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আমাজান নদের যে পরিমাণ পানি আটলান্টিকে পৌঁছে তা নদটির মোট পানিপ্রবাহের মাত্র ৩৩ ভাগ। তাহলে কি রহস্য লুকিয়ে আছে অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশের ভাগ্যে? এ বিশাল পরিমাণ পানি যায় কোথায়? তবে কি এ বিশাল পরিমাণ পানি স্রেফ হাওয়া হয়ে যায়! হ্যাঁ, আমাজান অববাহিকার কোনো কোনো অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কখনোই মাটির সফেদ ঘ্রাণ স্পর্শের সুযোগ পায় না। এর আগেই বাষ্পীভূত হয়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়। ফলে আমাজানের দুই-তৃতীয়াংশ জলেরই আটলান্টিকের বিশাল বুক ছোঁয়ার সৌভাগ্য হয় না।

আমাজানের মোহনা পৃথিবীর অন্যসব নদনদীর চেয়ে চওড়া। এর প্রস্থ ৩২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ মোহনার মধ্যেই পৃথিবীর সর্ববৃহৎ স্বাদু পানির দ্বীপ মারাকোর অবস্থান। আয়তনে যেটি প্রায় আটচলি্লশ হাজার বর্গকিলোমিটার, ধরা যায় ছোট একটি দেশের সমান। আমাজান-আটলান্টিকের সঙ্গমস্থল থেকে ৩ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরেও পেরুর ইকুইটাসে আমাজানের প্রস্থ প্রায় দুই কিলোমিটার। এ অংশে সারা বছরই পানির পৃষ্ঠ থেকে নদের তলদেশ পর্যন্ত গভীরতা ৪০ থেকে ৫০ মিটার পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। সুতরাং এ স্রোতে বা গভীরতায় কারও আমাজানের তলদেশ ছোঁয়ার ইচ্ছা জাগলেও সেটা স্রেফ মামা বাড়ির আবদার ছাড়া আর কিছুই হওয়ার নয়। সমুদ্রের কাছাকাছি কয়েকশ কিলোমিটারের মধ্যে আমাজানের কোথাও কোথাও গভীরতা এমন কি সমুদ্রতল থেকেও বেশি! আমাজান নদের প্রধান দুই সন্তান অর্থাৎ শাখা নদী কুরুয়া ও মাদিরা। কেবল এ দুটি নদীই ৩৩০ কিলোমিটার লম্বা। প্রায় ১ হাজার ১০০ শাখা নদী সংযুক্ত হয়েছে আমাজানের নাড়ির বাঁধনে। বছরের বিভিন্ন সময় পানির স্তরের ব্যাপক ওঠা-নামা মানে হলো সমগ্র আমাজান অববাহিকা বছরের কোনো না কোনো সময় প্লাবিত হওয়া। 
ভার্জিয়া ফরেস্ট বা প্লাবন বনভূমির মোট আয়তন ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মতো। এর পরিমাণ আমাজানিয়ার মোট বনভূমির প্রায় চার শতাংশ। এ প্লাবন বনভূমি নদী থেকে কখনো কখনো আশি কিলোমিটার দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। প্লাবন বনভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ সাময়িক প্লাবনের সঙ্গে নিজেদের জীবন চক্রকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। বনভূমির মতো আমাজান নদের তলদেশও প্রাণীবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এর তলদেশেই বাস করে ঘাতক মাছ পিরানহা। তাজা মাংসের গন্ধ পেলেই এরা ছুটে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। একটি পিরানহার ঝাঁক পূর্ণ বয়স্ক তাগড়া একটি মহিষকেও কয়েক মিনিটের মধ্যে সাবাড় করে দিতে পারে। এদের রাক্ষুসে ক্ষুধা এমনই যে, শিকারকে নাগালে পাওয়ার পর এরা এক কণা মাংসও অবশিষ্ট রাখে না। পড়ে থাকে কেবল শিকারের হাড় বা কংকাল। পিরানহার অস্ত্র হচ্ছে এর দাঁত। এ দাঁতের সাহায্যেই নিঁখুতভাবে কেটে নেয় সে একেক টুকরা মাংস। আমাজানের তলদেশের অন্য এক সদস্য 'ইলেক্ট্রিক ঈল'। আমাজানের একেবারে তলদেশ অর্থাৎ তলদেশের কর্দমাক্ত অংশে এর নিবাস। এরা চোখে দেখতে পায় না। পাঁচ ফুট লম্বা এ প্রাণী চোখে দেখতে না পেলেও এর শরীরের চারপাশে এক ধরনের বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা রাখে। কোনো শত্রুর অস্তিত্ব অনুভব করলে ইলেক্ট্রিক ঈল রেডিয়েশনের মাধ্যমে শত্রুকে ঘায়েল করে। নামে ঈল হলেও সাধারণ ঈল জাতীয় মাছের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই-ই প্রায়।

আমাজান তলদেশের অন্য এক বিস্ময়কর প্রাণী 'মানাটি'। একে ওয়াটার অঙ্ বা পানির ষাঁড়ও বলা হয়। দেখতে জলহস্তীর সঙ্গে এর কিছুটা মিল রয়েছে বৈকি। আমাজানের বৃহত্তম জলজ স্তণ্যপায়ী প্রাণী এটি। ৯ ফুট লম্বা মানাটির ওজন এক হাজার পাউন্ড পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিদিন এরা ১০০ পাউন্ড খাবার খায়। আমাজান নদের উদ্ভিদ জগতের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত 'আমাজান পদ্ম'। বিরাট আকৃতির পাতাওয়ালা আমাজান পদ্ম নিমফিরেসি পরিবারভুক্ত। গোলাকার ও কাঁটাযুক্ত আমাজান পদ্মের পাতা পৃথিবীতে বৃহত্তম। পূর্ণ বয়স্ক পাতা সাড়ে ৬ ফুট চওড়া হয়। কাণ্ড আদার মতো। ফুল সাদা, ব্যস ১৫ থেকে ৪০ সে.মি.। মজার ব্যাপার হলো, এর ফুল প্রথমে সাদা। এরপর গোলাপি এবং ঝরার সময় লাল বর্ণ ধারণ করে। বর্ষাকালে রাতে ফোটে, দিনের আলোয় চুপসে থাকে। আমাজান নদের তটসংলগ্ন দেশগুলোতে এর বীজ থেকে ময়দা উৎপন্ন করা হয়। পাঠক, আপনি চাইলে ঢাকার ওয়ারীতে বলধা গার্ডেনে বেড়াতে এসে আমাজান পদ্মের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। পানিপ্রবাহের সমৃদ্ধতার মতো আমাজান নদ উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ। আমাজান প্রতিদিন হাজার হাজার টন জল বুকে নিয়ে ছুটে চলে নিরন্তর-নিরবধি।  

খালেদ আহমদ শিমুল
সূত্রঃ   বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ এপ্রিল ২০১২ খ্রিঃ। ব্যবহৃত সেটিংস।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।