সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: সুলতানী স্থাপত্যের রত্ন-সোনামসজিদ

সুলতানী স্থাপত্যের রত্ন-সোনামসজিদ



অনেকেই বলে থাকেন শুধু আম, কাঁসা ও রেশম শিল্পেই নয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রত্নসম্পদে সমৃদ্ধ একটি জেলা। প্রাচীন বাংলার গৌড়ের রাজধানী হিসেবে শিবগঞ্জ উপজেলায় বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ও দর্শনীয় নিদর্শনগুলো হিন্দু শাসনামল বিশেষ করে সেন বংশের শেষ রাজাদের স্মৃতিচিহ্ন ও সুলতানী আমলে সুলতানদের নির্মিত মসজিদই এ এলাকার প্রধান ঐতিহাসিক স্থাপনা। আর এসব স্থাপনার মধ্যে সুলতানী স্থাপত্যের রত্ন বলে খ্যাত ছোট সোনামসজিদ অন্যতম।

ভারতের মালদহ জেলার মোহদীপুরে অনুরূপ একটি মসজিদ থাকায় সেটিকে বড় সোনামসজিদ এবং এটিকে ছোট সোনামসজিদ বলা হয়। এই ছোট সোনামসজিদ প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর কোয়ার্টার্সের তোহাখানা কমপ্লেঙ্ থেকে প্রায় আধাকিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে বিশাল এক দিঘির পাশ্বর্ে অবস্থিত। মসজিদের প্রধান প্রবেশপথের উপরিভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদটি মজলিস-ই-মাজালিস মজলিস মনসুর ওয়ালী মুহাম্মদ বিন আলী কর্তৃক নির্মিত হয় বলে জানা যায়। শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখ সংবলিত অক্ষরগুলো মুছে গেলেও এতে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর নাম উল্লেখ থাকায় ধারণা করা হয় তার রাজত্বকালের (১৪৯৪-১৫১৯) কোনো এক সময় সোনামসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের স্থাপত্যশৈলী সবাইকে মুগ্ধ করে। মসজিদের দরজাগুলো শোভাবর্ধক রেখা দিয়ে ঘেরা থাকলেও এর খুব কাছে না গেলে এ খোদাই কাজ চোখে পড়ে না।

মসজিদের মধ্য দ্বারের উপরস্থ লিপিটির অনুবাদ এই রকম : দয়াময় ও করুণাময় আল্লাহর নামে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন, আল্লাহ ছাড়া বিচার দিনের ওপর আর কাউকে ভয় কর না। যারা আল্লাহর মসজিদ তৈরি করেন তারা শীঘ্রই পথ প্রদর্শিতদের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং মহা নবী (সা.) বলেন যে, আল্লাহর জন্য যে একটি মসজিদ নির্মাণ করে, তার জন্য অনুরূপ একটি গৃহ বেহেশতে তৈরি করা হবে। এই মসজিদের নির্মাণ কার্য সুলতানগণের সুলতান, সৈয়দগণের সৈয়দ, পবিত্রতার উৎস, যিনি মুসলমান নর-নারীর ওপর দয়া করেন, যিনি সত্য কথা ও সৎ কাজের প্রশংসা করেন, যিনি ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষক, সেই আলাউদ্দুনীয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুজাফ্ফর হোসেন শাহ সুলতান আল হোসাইনীর (আল্লাহ তার রাজ্য ও শাসন চিরস্থায়ী করেন) রাজত্বকালে সংঘটিত হয়। খালেস ও আন্তরিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এবং আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে ওয়ালী মনসুর কর্তৃক জামে মসজিদ নির্মিত হয়। সর্বশক্তিমান আল্লাহ ইহকাল ও পরকাল উভয়স্থানে তাকে সাহায্য করেন। এর শুভ তারিখ হচ্ছে রহমতের মাস রজবের ১৪ তারিখ। এর মূল্য ও মর্যাদা বর্ধিত হোক। এ লিপিটির মধ্যের লাইনে তিনটি শোভাবর্ধক বৃত্ত রয়েছে। মসজিদটি অলঙ্করণের ক্ষেত্রে যে সোনালি গিল্টির (রংয়ের) ব্যবহার থেকে এর নামকরণ সোনামসজিদ হয়েছে বলে ধারণা করা হলেও সেই গিল্টি এখন আর নেই। মসজিদের চারদিকে একটি পুরু দেয়াল ছিল। পূর্ব-পশ্চিমে ৪২ মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ৪৩ মিটার লম্বা এই বহির্দেয়ালের পূর্বদিকের মধ্যবর্তী স্থানে একটি প্রধান ফটক ছিল। কিন্তু কালের আবর্তে প্রধান ফটকটি ছাড়া বহির্দেয়াল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এর চিহ্ন আজও স্পষ্ট রয়েছে। এ মসজিদটি ইট ও পাথরে নির্মিত। মসজিদের বাইরের দেয়ালে এবং ভেতরে গ্রানাইট পাথরখণ্ডের আস্তরণ দেখতে পাওয়া যায়। জানা যায়, ১৮৯৭ সালে প্রলঙ্করী ভূমিকম্পে ধ্বংসলীলার পর সংস্কার কাজের সময় পশ্চিম দেয়ালের দক্ষিণ অংশে পাথরের আস্তরণ অপসারিত হয়েছে। মসজিদের বাইরের দিকে চারকোণে চারটি বহুভুজাকৃতির বুরুজের সাহায্যে কোণগুলোকে মজবুত করা হয়েছে। মসজিদের সামনের দিকে পাঁচটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ৩টি করে প্রবেশ দ্বার রয়েছে। মসজিদের উত্তর-পশ্চিম কোণে উপরিভাগে দোতলার আদলে নির্মিত একটি রাজকীয় গ্যালারি রয়েছে যা ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় আজও বিদ্যমান। এর উত্তর-পশ্চিম কোণে গ্যালারির প্রবেশপথ রয়েছে। এর সামনে রয়েছে একটি মিহরাব। 
মসজিদটির অলঙ্করণের ক্ষেত্রে খোদাইকৃত পাথর, ইটের বিন্যাস, পোড়ামাটির ফলকের গিল্টি ও চকচকে টালি ব্যবহৃত হয়েছে। সোনামসিজদের প্রধান ফটকের প্রায় সাড়ে ১৪ মিটার পূর্বদিকে একটি পাথরের প্লাটফরম রয়েছে যার আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ৪.২ মিটার, পূর্ব-পশ্চিমে ৬.২ মিটার এবং উচ্চতা এক মিটার। এর চারকোণে একটি করে প্রস্তর স্তম্ভ রয়েছে। এখানে কয়েকটি বাঁধানো কবর রয়েছে। কিন্তু এখানে কারা সমাহিত আছেন তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে দুটি সমাধিতে কোরআনের আয়াত ও আল্লাহর কিছু নাম সংবলিত পাথরের সমাধিফলক। ইতিহাসবিদ ক্যানিংহ্যামের মতে, সমাধি দুটো হচ্ছে মসজিদের নির্মাতা ওয়ালী মাহম্মদ ও তার পিতা আলীর। সোনামসজিদের নির্মাণশৈলী গৌড়-লখনোতির সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইমারত এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই নিদর্শন অর্থাৎ গৌড়ের ছোট সোনামসজিদ দেখতে সারাবছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। দেশের যেকোনো স্থান থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আসার পর সোনামসজিদ যাওয়ার জন্য সরাসরি বাস সার্ভিস রয়েছে।

মো. রফিকুল আলম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি
সূত্রঃ   বাংলাদেশপ্রতিদিন, ১২ এপ্রিল ২০১২ খ্রিঃ।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।