দাবা একটি জনপ্রিয় খেলা যা বোর্ডের উপর খেলা হয়। যিনি দাবা খেলেন তিনি দাবাড়ু হিসেবে আখ্যায়িত। দাবায় দু’জন খেলোয়াড় অংশগ্রহণ করে। দাবা খেলায় জিততে হলে বোর্ডের ওপর ঘুঁটি সরিয়ে বা চাল দিয়ে বিপক্ষের রাজাকে “খেতে” বা নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়, দাবার পরিভাষায় একে বলে “কিস্তিমাত”।
দাবা বোর্ডে বর্গাকৃতি ৬৪টি সাদা-কালো ঘর থাকে। ঘরগুলোতে প্রতিটি খেলোয়াড়ের একটি করে রাজা (কিং) ও মন্ত্রী (কুইন, রাণী নয়), দু’টি করে - নৌকা (রুক), ঘোড়া (নাইট) ও হাতি (বিশপ) এবং ৮টি পন বা বোড়ে-সহ মোট ১৬টি গুটি থাকে। অর্থাৎ, দু'জন খেলোয়াড়ের সর্বমোট ৩২টি গুটি থাকে। র্যাংক বা সারিগুলোকে 'ওয়ান' (1) থেকে 'এইট' (8) সংখ্যা দিয়ে এবং ফাইলগুলোকে ইংরেজী 'এ' (a) থেকে 'এইচ' (h) বর্ণ দিয়ে নির্দেশ করা হয়। ফলে দাবার ছকের প্রতিটি ঘরকেই একটি অনন্য বর্ণ-সংখ্যা প্রতীক দিয়ে প্রকাশ করা যায়। দাবার নোটেশন বা লিপিবদ্ধকরণের এই পদ্ধতি খুবই কাজে আসে, কেননা এটি ব্যবহার করে যে-কোন দাবা খেলার সমস্ত চাল লিপিবদ্ধ করে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করে নিজের ভুলগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়।
উদ্দেশ্যঃ প্রতিপক্ষের রাজার বিরুদ্ধে কিস্তি বা চেকমেট দেবার পর যদি রাজা চেক সরাতে না পারে এবং পরবর্তীতে যদি নড়াতে না পারে তবে কিস্তিমাৎ হয়ে খেলা শেষ হবে।
উৎপত্তিঃ দাবা খেলার জন্ম ভারতবর্ষে বলে সর্বাধিক প্রচলিত মতবাদ । এছাড়া, পারস্য (বর্তমান ইরান) দেশে ৩য় শতাব্দীতে প্রচলিত শতরঞ্জ এবং চীন -এ ২য় শতাব্দীতে প্রচলিত শিয়াংছী নামক খেলাকে দাবার পূর্বসূরী হিসেবে গণ্য করার পক্ষেও মতামত আছে। কথিত আছে যে রাবনের স্ত্রী চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধে নিবৃত করার জন্য রাবনের সাথে দাবা খেলতেন । প্রাচীন ভারতীয় খেলা হিসেবে দাবার সংস্কৃত শব্দ শতরঞ্জ খেলাটি পরিবর্তিতরূপে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ক্রীড়াবিদেরা দাবার কৌশল এবং বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগে খেলাটির ধারাই পরিবর্তন করে দিয়েছেন। অনেক বছর ধরে দাবা খেলার প্রোগ্রাম ব্যবহার করে কম্পিউটারের সহযোগিতা নিচ্ছেন ব্যবহারকারীরা। তেমনি একটি হলো – ডিপ-ব্লু। এটিই ১ম যন্ত্রচালিত প্রোগ্রাম যা তৎকালীন বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারী কাসপারভকে ১৯৯৭ সালে পরাজিত করে।
বিশ্ব শিরোপাঃ সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রিত ক্রীড়া হিসেবে দাবা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় ষোড়শ শতকে। বিশ্ব দাবা প্রতিযোগিতায় ১৮৮৬ সালে ১ম অফিসিয়ালী শিরোপাধারী হন উইলিয়াম স্টেইনজ। বর্তমান (২০১০ সাল) শিরোপাধারী হলেন – ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ।
দাবা প্রতিযোগিতাসমূহঃ দাবা প্রতিযোগিতা হিসেবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপের পাশাপাশি প্রমিলা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ, জুনিয়র বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ, বিশ্ব সিনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপ, করেসপণ্ডেন্স দাবা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ, বিশ্ব কম্পিউটার দাবা চ্যাম্পিয়নশীপ এবং ব্লিটজ এণ্ড ৠাপিড ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপ (দ্রুতগতির দাবা) অন্যতম। তবে দাবা অলিম্পিয়াড-এ দলগতভাবে বিভিন্ন দেশের মধ্যেকার খেলা জনপ্রিয় প্রতিযোগিতা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। অনলাইনভিত্তিক দাবা শৌখিন ও পেশাধারী প্রতিযোগিতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
দাবা সংস্থার নিয়ন্ত্রক এবং নিয়ম-কানুনঃ
দাবা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত খেলা। আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ও ফিদে আন্তর্জাতিক দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বর্তমানে দাবা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাড়ীতে, ক্লাবে, টুর্ণামেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় লক্ষ লক্ষ দাবাড়ু অংশগ্রহণ করে। নির্দিস্ট নিয়মের বাইরেও বিভিন্ন ধরনের নিয়ম-কানুন প্রয়োগ করে খেলা হয়ে থাকে। বিশ্ব দাবা ফেডারেশন বা ফিদে কর্তৃক নির্ধারিত নিয়ম-কানুন দাবা খেলায় প্রয়োগ করা হয়। স্বীকৃত দাবা প্রতিযোগিতাগুলো ফিদে হ্যাণ্ডবুকে বর্ণিত নিয়মে পরিচালিত হয়।
গুটি স্থাপনা এবং পরিচালনাঃ
দাবা খেলা বর্গাকৃতি ৮টি রো ও ৮টি কলামে মোট ৬৪টি ঘরের সমষ্টিতে তৈরী বোর্ডে হয়ে থাকে। রো-গুলো রেংক বা সারি হিসেবে ১ থেকে ৮ সংখ্যায় নির্ধারিত এবং কলামগুলো ফাইল হিসেবে যা ইংরেজী অক্ষর এ থেকে এইচ পর্যন্ত হয়ে থাকে। দাবা বোর্ড কাগজের, কাঠের, প্লাস্টিকের তৈরী হয়ে থাকে। ৬৪টি বর্গাকৃতি ঘরগুলো দু’ধরণের হয়। একটি হালকা এবং অন্যটি গাঢ় কিংবা একটি সাদা এবং অন্যটি কালো। সাধারণতঃ ঘরগুলোর সাথে মিল রেখে ঘরগুলোর রং হয়। তবে দু’দলের মন্ত্রী বা কুইনের রং হবে নিজ ঘরের রংয়ে। গুটিগুলো দুই অংশে বিভক্ত। তাহলো সাদা এবং কালো সেট। খেলোয়াড়দের পরিচিতি হয় ‘সাদা’ এবং ‘কালো’। সাদা গুটি সর্বদা প্রথম চালানো হয়। এরপর থেকেই একটি গুটির পর অন্য দলের গুটি চালানো হয়। ব্যাতিক্রম হিসেবে ক্যাসলিংয়ের সময় দু’টি গুটি পরিচালিত হয়। খালি জায়গায় গুটি চালাতে হয় অথবা প্রতিপক্ষের গুটি দখল করে ঘর থেকে বাইরে উচ্ছেদ করা হয়। যদি কোন কারণে গুটি পরিচালনা করা না যায় তাহলে খেলা শেষ হয়েছে অথবা চেকমেটের সাহায্যে খেলা শেষ করা হয়। প্রতিটি দাবার গুটির নিজস্ব চলাচলের শর্ত রয়েছে। •রাজা বা কিং শুধু তার ঘরের সাথে সংযুক্ত যে কোন একটি ঘরে যেতে পারে। তবে বিশেষ শর্তে নৌকা বা রুকের সাথে ঘর পরিবর্তন করতে পারে যা ক্যাসলিং নামে পরিচিত। •নৌকা বা রুক যে-কোন ৠাংক বা ফাইলে যেতে পারে তবে অন্য গুটিকে অতিক্রম করে নয়। তবে বিশেষ শর্তে রাজার সাথে ঘর পরিবর্তন করতে পারে যা ক্যাসলিং নামে পরিচিত। •হাতি বা বিশপ যে-কোন আড়াআড়ি ঘরে যেতে পারে তবে অন্য গুটিকে অতিক্রম করে নয়। •মন্ত্রী বা কুইন নৌকা এবং হাতির সমন্বিত শক্তি হিসেবে যে কোন ঘরে তা ৠাংক, ফাইল কিংবা আড়াআড়ি যেতে পারে। তবে অন্য গুটিকে অতিক্রম করে নয়। •ঘোড়া বা নাইট কাছাকাছি দু’ঘর ৠাংক, ফাইলে গিয়ে ডানে কিংবা বামের অন্য ঘরে যেতে হবে যা ইংরেজী এল আকৃতির হবে। ঘোড়া গুটির বিশেষ বৈশিষ্ট হচ্ছে - একমাত্র এ গুটিই যে কোন গুটিকে অতিক্রম করে অন্য ঘরে যেতে পারে। •পন বা বোড়ে নিজস্ব ফাইলে এক ঘর করে অগ্রসর হয়। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে নিজস্ব ঘর থেকে ইচ্ছে করলে দু’ঘর সামনে যেতে পারে যদি ঘরগুলো খালি থাকে কিংবা প্রতিপক্ষের গুটিকে কেটে আড়াআড়ি অন্য ফাইলে যেতে পারে। তবে সামনে যদি কালো পন থাকে তবে আর অগ্রসর হতে পারবে না। পনের দুটি বিশেষ পরিচালনা আছে। সেগুলো হচ্ছে - (১) এন পাসেন্ট এবং অপরটি উত্তরণ।
এন প্যাসেন্ট কি? যখন একটি পন দুটি ঘরে যাবার সুবিধা নেয় এবং প্রতিপক্ষের পনকে পাশ কাটিয়ে নির্দিস্ট ফাইলের ঘরে যেতে চায় তখন ঐ পনকে দখল করা এন প্যাসেন্ট নামে পরিচিত। ইচ্ছে করলে ঐ পনকে প্রতিপক্ষের পন পরবর্তী পরিচালনে করতে হবে, এরপর হলে এ শর্ত পূরণ হবে না।
ক্যাসলিং কি? রাজা বা কিং শুধু তার ঘরের সাথে সংযুক্ত যে কোন একটি ঘরে যেতে পারে। তবে বিশেষ শর্তে নৌকা বা রুকের সাথে ঘর পরিবর্তন করতে পারে। প্রতিটি খেলায় প্রতিটি রাজা একটি বিশেষ ঘর পরিবর্তনের সুযোগ পায় যা ক্যাসলিং হিসেবে পরিচিত। শর্তগুলো হলো - খেলা চলাকালীন সময়ে রাজা ও নৌকা কোন ঘরেই নড়াচড়া করলে ক্যাসলিং হবে না। রাজা ও নৌকার মাঝে অন্য কোন গুটি থাকতে পারবে না। রাজা চেক অবস্থায় থাকতে পারবে না। পনের উত্তরণযখন একটি পন ৮ম ৠাংকে যায়, তখনই খেলোয়াড় ইচ্ছে করলে এর পরিবর্তে নিজ দলের মন্ত্রী, নৌকা, হাতি কিংবা ঘোড়া গুটি বোর্ডে আনতে পারে। সাধারণতঃ পন উত্তরিত হয়ে মন্ত্রীকে নিয়ে আসে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে যদি অন্য গুটি পছন্দ করা হয়, তখন তা আণ্ডার প্রমোশন নামে পরিচিত হয়। সময় নিয়ন্ত্রনঅপেশাদার এবং ঘরোয়া দাবা খেলাতে কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না।কিন্তু পেশাদার দাবা খেলায় নির্দিষ্ট সময় দেয়া থাকে।
কিছু বিখ্যাত দাবা খেলার উদাহরণঃ
- অমর গেমঃ এডল্ফ এনডারসন এবং লিওনেল কিয়েসেরিতস্কি (1851)
- চিরসবুজ গেমঃ এডল্ফ এনডারসন এবং জঁ দুফ্রেস্নে (1852)
- অপেরা গেমঃ পল মর্ফি এবং দুই মিত্র, ব্রানস্উইক-এর ডিউক ও কাউন্ট ইসুয়ার্ড (1858)
- লস্কর এবং বাওয়ার, এমস্টার্ড্যাম, 1889, বিখ্যাত জোড়া হাতি বিসর্জন-এর প্রথম উদাহরণ
- শতাব্দীর সেরা গেমঃ ববি ফিশার এবং ডনাল্ড বায়ার্ন (1956)
- ডীপ ব্লু এবং কাসপারভ, 1996, গেম 1, ইতিহাসের প্রথম গেম যাতে একটি কম্পিউটার বিশ্বসেরা দাবাড়ুকে পরাজিত করে (1996)
- কাসপারভ বনাম বিশ্ব, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কাসপারভ ইন্টারনেট-এর সহায়তায় ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের সাথে খেলেন (1999)
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।