বাংলার এক প্রান্তের জেলা দিনাজপুর। এখানকার জীবন, নদী, গাছপালা ও মানুষের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে ভিন্নমাত্রার পরিবেশ। মধ্যযুগের বিখ্যাত সামন্ত রাজার অমরকীর্তি রামসাগর, যা সারা বাংলার এক অনুপম সৌন্দর্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক দিঘিরূপে পরিগণিত। দিনাজপুর শহরের কেন্দ্র থেকে আট কিলোমিটার দক্ষিণে আউলিয়াপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রামসাগর দিঘি।
চারদিকে সবুজ প্রান্তর, পাহাড়ের মতো ধূসর, ছোট ছোট মাটির টিলার পাড় দ্বারা বেষ্টিত গ্রামীণ পরিবেশে। পাড়ভূমিসহ দিঘির মোট আয়তন ৪,৩৭,৪৯২ বর্গমিটার, বনবিভাগের দৈর্ঘ্য ১০.৩১ মিটার, প্রস্থ ৩৬৪ মিটার। গভীরতা প্রায় ৯ মিটার, সর্বোচ্চ পাড়ের উচ্চতা প্রায় ১৩.৫০ মিটার। রামসাগরের দৈর্ঘ্য ১১৮০ গজ ও প্রস্থ ৩২০ গজ। জানা যায়, সেচ-সুবিধা, প্রজাদের পানির কষ্ট দূরীকরণ এবং দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও সংস্থান হিসেবেই রাজা রামনাথের আমলে এ দিঘিটি খনন করা হয় এবং তার নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়। দিঘিটি খনন করতে তখন প্রায় ৩০ হাজার টাকা এবং ১৫ লাখ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়েছিল। দিঘির পাড়ের উচ্চ টিলার ওপর অবস্থিত মনোরম বাংলোটি দেশি-বিদেশি অসংখ্য কৌতূহলী পর্যটকের কাছে যেমন প্রতিনিয়তই স্বপি্নল আকর্ষণ, তেমনি বিহারিদের নিভৃত নিকেতনও বটে। এখানে একটি ছোট্ট চিড়িয়াখানা রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, বানর ও কিছু পশুপাখি রয়েছে। এর পাশে রয়েছে একটি শিশুপার্ক।
যেখানে শিশুরা অনায়াসে খেলাধুলা করতে পারে। রামসাগরে সত্য সন্ধানের প্রত্যাশায় ১৭৫৫ সাল থেকে প্রতিবছর মাঘের চাঁদের পঞ্চম তিথিতে এখানে বারুনি মেলা বসে। মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অরবিন্দ রায় জানান, ১৭৫০ সালে শুরু করে ১৭৫৫ সালের মধ্যে ঐতিহাসিক রামসাগর দিঘি খনন করা হয়। তৎকালীন রাজা প্রাণনাথ এলাকাবাসীর জলকষ্ট নিবারণের জন্য বিশাল আকৃতির দিঘিটি খনন করেছিলেন। জনশ্রুতি আছে. দিঘিতে পানি না ওঠার কারণে স্বপ্নে তাকে তার পুত্র রামনাথকে বিসর্জন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজা প্রাণনাথ হাতির বহর, ঘোড়ার বহর নিয়ে ও ঢাক-ঢোল বাজিয়ে রামসাগরে উপস্থিত হন এবং পুত্রকে স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশ অনুযায়ী পুকুরে নামতে বলেন। পুত্র রামনাথ যতই নিচে নামতে থাকেন ততই দিঘিতে জলধারা বাড়তে থাকে।
অবশেষে প্রিয়পুত্র রামনাথের সলিল সমাধির মধ্য দিয়ে রাজা প্রাণনাথের খননকৃত বিশাল দিঘি জনগণের কল্যাণে বিশাল জলধারা সমৃদ্ধ দিঘিতে পরিণত হয়। রামনাথের আত্দবিসর্জনের কারণে এ দিঘির নাম হয় রামসাগর। তখন থেকেই রামনাথের প্রতি শ্রদ্ধার অংশ হিসেবে প্রতিবছর মাঘ মাসের পঞ্চম তিথিতে বারুনি মেলা, গঙ্গাপূজা, সরস্বতী পূজা ও দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়।
রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর
সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ মে ২০১২ খ্রিঃ।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।