সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: দুনিয়া কাঁপানো কেলেঙ্কারি

দুনিয়া কাঁপানো কেলেঙ্কারি



বিশ্বজুড়ে নানা সময়ে নানা ধরনের স্ক্যান্ডাল আর কেলেঙ্কারির অবতারণা হয়েছে। মানুষের আগ্রহ আর মিডিয়ার কল্যাণে সেগুলো খুব দ্রুত প্রসারও লাভ করেছে। এসব স্ক্যান্ডালের কোনোটি ব্যক্তিগত, কোনোটি পারিবারিক আবার কোনোটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। কেবল সমাজের পদস্থ লোকজনের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটছে তা নয়, বিভিন্ন দেশের বিশ্বনেতারাও নানা সময় কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছেন। তাদের সেই কেলেঙ্কারি কারও কারও রাজনৈতিক মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে। সারা বিশ্বে আলোচিত এমনই কয়েকটি কেলেঙ্কারির আদ্যোপান্ত নিয়েই আজকের লেখা।

আশির দশকে ভারত সরকার সুইডেন থেকে অস্ত্র ক্রয়ের জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ-সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়। সুইডেনের একটি অস্ত্র প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বোফর্স কোম্পানি। ভারত ১৩০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র সরবরাহের ব্যবসা পাওয়ার আশায় প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও কর্মকর্তাদের প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার ঘুষ প্রদান করে; কিন্তু ঘটনাক্রমে পত্রিকা মারফত সবিস্তারে তা প্রকাশিত হলে ভারত সরকার ও বোফর্স কোম্পানি উভয়ই তা অস্বীকার করে। এ ছাড়া পশ্চিম জার্মানি থেকে ৪৩০ কোটি রুপি মূল্যের সাবমেরিন ক্রয়ের চুক্তিতে জনৈক ভারতীয় এজেন্ট ৩০ কোটি রুপি দালালি হিসেবে কমিশন লাভ করেন। সংবাদপত্রে আসার আগেই ভারতীয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। যার কারণে পরবর্তীতে রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। এ কেলেঙ্কারি ও মামলার পরই দেশজুড়ে স্লোগান উঠেছিল, 'গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়'। ১৯৮৯ সালের লোকসভা ভোটে প্রধান ইস্যু ছিল বোফর্স কেলেঙ্কারি। যার জেরে ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা হারাতে হয় রাজীব গান্ধীকে।



বাফর্স কেলেঙ্কারিঃ
মার্চ, ১৯৮৬খ্রিঃ চারশটি ১৫৫ মিলিমিটার হাউইৎজার কামান কেনার জন্য সুইডেনের এ বি বোফর্স সংস্থার সঙ্গে ১৪৩৭ কোটি টাকার চুক্তি সই হয় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের।

এপ্রিল, ১৯৮৭খ্রিঃ সুইডিশ রেডিও চাঞ্চল্যকর ঘোষণায় জানাল, চুক্তি পাকা করার জন্য ভারতীয় রাজনীতিক ও প্রতিরক্ষার ক্ষমতাশালী অফিসারদের ঘুষ দিয়েছে বোফর্স।

২২ অক্টোবর, ১৯৯৯খ্রিঃ  উইন চাড্ডা, কুয়াতারোচ্চিকে, সাবেক ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব এস কে ভাটনগর, সাবেক বোফর্স প্রধান মার্টিন আর্ডবো এবং বোফর্স কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রথম চার্জশিট পেশ করল সিবিআই। চার্জশিটে উল্লেখ থাকলেও রাজীব গান্ধীর নাম বিচারের জন্য পেশ করা হয়নি; কারণ তার আগেই ১৯৯২ সালে তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সিবিআই কয়েকবার কুয়াতারোচ্চিকে ভারতে আনার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়। তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানায় মালয়েশিয়া ও আর্জেন্টিনা।

সেপ্টেম্বর, ২০০৯খ্রিঃ কুয়াতারোচ্চির বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার কেন্দ্রীয় সরকারি সিদ্ধান্ত জানানো হলো সুপ্রিমকোর্টে।

জানুয়ারি, ২০১১খ্রিঃ ভারতের আয়কর দফতরের আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে জানানো হলো, হাউইৎজার কামান বেচাকেনায় ৪১ কোটি টাকা ঘুষ পেয়েছিলেন ওত্তাভিও কুয়াতারোচ্চি এবং উইন চাড্ডা।

২০১২খ্রিঃ আবারও বোফর্সের গোলার শব্দে জেগে উঠেছে ভারতের কংগ্রেসবিরোধী মহল। বিজেপি বলেছে, যেভাবে কুয়াতারোচ্চিকে দেশের বাইরে 'সেফ প্যাসেজ' দেওয়া হয়েছিল, তাতেই সরকারের অবস্থান পরিষ্কার ছিল। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধজয়ে কার্যকর ভূমিকা নেয় বোফর্স কামান। কিন্তু বোফর্স কামানের দুর্ভাগ্য যে, যুদ্ধক্ষেত্রে তার গুরুত্ব বরাবরই চাপা পড়ে তা আঘাত হেনেছে রাজনীতির মাঠে।

১৯৮৪-১৯৮৭খ্রিঃ ১৯৮৪ সালে তাঁদের অনেকদিনের পারিবারিক বন্ধু রাজীব গান্ধীর সমর্থনে অমিতাভ অভিনয় থেকে সংক্ষিপ্ত বিরতি নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি এলাহাবাদ লোকসভা আসনের জন্য উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এইচ এন বহুগুনা-র বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ান এবং সাধারণ নির্বাচন-এর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি (মোট ভোটের ৬৮.২% পেয়ে) ভোটপার্থক্যে জয়লাভ করেন ।[১৮] তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন সংক্ষিপ্ত ছিলো। তিন বছর পরে তিনি পদত্যাগ করেন এবং রাজনীতিকে "নর্দমা" আখ্যা দেন। এই পদত্যাগের পিছনে ছিলো বচ্চন এবং তাঁর ভাইয়ের "বোফর্স কেলেঙ্কারী"-তে জড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত যা একটি খবরের কাগজ জনসমক্ষে তুলে আনে। বচ্চন এই কাগজের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। কিন্তু শেষে জানা যায় যে বচ্চন নির্দোষ এবং এই কেলেঙ্কারিতে কোনভাবে জড়িত ছিলেন না।[১৯]



লকহীড কেলেঙ্কারিঃ
বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য কেলেঙ্কারি যা তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোতে 'লকহীড কেলেঙ্কারি' শিরোনামে স্থান পেয়েছিল। ১৯৮৩ সালে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর লকহীড কেলেঙ্কারিতে জড়িত জাপান, হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, ইতালিসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশ। লকহীড একটি মার্কিন বিমান কোম্পানি, যা মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে এর বিমান জাপান, হল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাসীন মন্ত্রী, রাজপুত্র ও প্রথম শ্রেণীর রাজনীতিবিদদের বশে আনার জন্য বিক্রয়ের প্রচেষ্টা চালায়। মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণকারীদের মধ্যে জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা, হল্যান্ডের রানী জুলিয়ানার স্বামী প্রিন্স বার্নহার্ড, পশ্চিম জার্মানির সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্রাঞ্জ যোসেফ স্ট্রস, ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুইসি গুইয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লকহীড কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত প্রতিটি দেশে যে তদন্ত চলে তাতে জাপান ও হল্যান্ড সর্বাধিক আলোচিত হয়। জাপানের প্রধানমন্ত্রী তানাকাসহ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। হল্যান্ডের রানী জুলিয়ানার সিংহাসন নিয়ে টানাটানির অবস্থা শুরু হয়। ফলে জুলিয়ানার স্বামী বার্নহার্ডকে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। জাপান সরকার তানাকাকে চার বছরের জেল ও ২০ লাখ ডলার জরিমানা করে। সমগ্র বিশ্বের শিক্ষিত জনসমাজের কাছে লকহীড সর্বাপেক্ষা নিন্দিত কেলেঙ্কারি।


ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিঃ
যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের সদর দফতর ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট নামক স্থানে। ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ওই সদর দফতরেই ডেমোক্রেটিক দলের নির্বাচনী প্রচারণা, পরিকল্পনা এবং অন্যান্য আলাপ-আলোচনা করা হতো। তৎকালীন ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী রিচার্ড নিঙ্নের সহযোগীরা তা আড়িপেতে শোনা এবং টেপ করে নেওয়ার যে নোংরা পদ্ধতি অবলম্বন করে তা পরবর্তীতে ফাঁস হয়ে পড়ে। এতে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। সবাই এ কুকীর্তির নিন্দা জানায়। ফলে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট নিঙ্নকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়। ভিয়েতনাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তিপ্রচেষ্টা এবং রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কোন্নয়ন নিঙ্নের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলেও ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিঙ্নের রাজনৈতিক জীবনের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে রয়েছে। ৩৬ বছর পর ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেলেন আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নিঙ্ন। মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর পর তিনি মুক্ত হলেন। ইতিহাসবেত্তা স্ট্যানলি কাটলারের এক অনুরোধে বিচারক রইস ল্যামবার্থ বহুল আলোচিত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির ঘটনায় সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিঙ্নের দেওয়া সাক্ষ্যের নথিপত্র প্রকাশ না করায় নিঙ্নকে এ অভিযোগ থেকে মুক্তি দেন ওই বিচারক। রাজনৈতিক এই কেলেঙ্কারির কারণে সেই সময় প্রেসিডেন্ট নিঙ্ন পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট নিঙ্ন যিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। ১৭ বছর আগে তিনি মারা যান।


ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারিঃ
১৯৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইরানের কাছে বেশকিছু অস্ত্র বিক্রি করে এবং তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ নিকারাগুয়ার তৎকালীন সরকারবিরোধী কন্ট্রা বিদ্রোহীদের কাছে পাচার করে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রভর্তি প্রথম বিমানটি ১৯৮৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ইসরায়েলের মাধ্যমে ইরানে পৌঁছানো হয়। এ কেলেঙ্কারির কারণে কিছু উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তা প্রশাসন থেকে বিদায় নেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের মুখপাত্র ল্যারি স্পিকস, রাজনৈতিক পরিচালক মিথ ড্যানিয়েল, সিআইএ প্রধান উইলিয়াম ক্যাসি, হোয়াইট হাউস কমিউনিকেশন ডিরেক্টর প্যাট্রিক বুচানন, স্টাফপ্রধান ডোনাল্ড রিগ্যান, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকফার্লেনও ওই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিগ্যান সিনেটর জন টাওয়ার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রদত্ত রিপোর্টে বলা হয়, পদচ্যুত জাতীয় নিরাপত্তা সহকারী অলিভার নর্থ সব তৎপরতার নায়ক ছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট রিগ্যান স্বীকার করেন যে, ইরানে মার্কিন জিম্মিদের মুক্তির বিনিময়ে তিনি গোপনে এ চুক্তি অনুমোদন করেছিলেন। এটি যে ভুল ছিল তা তিনি নিজেই পরবর্তীতে স্বীকার করে নেন।

প্রীতম সাহা সুদীপ
সূত্রঃ   বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৭ মে ২০১২ খ্রিঃ।

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।