২০ বছর ধরে তিনি গাছের পেছনে ছুটছেন। প্রকৃতিকে শীতল করতে আম, জাম, কাঁঠাল ও কৃষ্ণচূড়ার হাজার গাছ লাগিয়েছেন। সেই গাছগুলোর নিচে এখন হাজার হাজার মানুষ, পশু-পাখি আশ্রয় নিচ্ছে। গাছ লাগানোকে সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন-পালনের মতোই কর্তব্য মনে করেন তিনি। টাকার জন্য নয়, ভালোবেসেই গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গাছ লাগানোকে পবিত্র কাজ মনে করেন। এলাকার মানুষ এখন তাঁকে ‘গাছপাগল মাওলা’ বলে ডাকে।
৩২ বছর বয়সী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া গ্রামে জন্ম এই ‘গাছপাগল’ মাওলা মিয়ার। পেশায় বর্গাচাষি মাওলা সীমান্তঘেঁষা মোগড়া ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় হাজার হাজার গাছ লাগিয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগই কৃষ্ণচূড়া। আর এই কাজ করছেন বর্গাচাষ করে উপার্জিত সামান্য অর্থের কিছু অংশ জমিয়ে। কোনো কিছুই বাদ যায়নি তাঁর গাছ লাগানো তালিকা থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে মোগড়া গ্রাম। একটু এগোলেই সীমান্ত। এই সীমান্ত থেকে উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় বিশালাকার এমন কোনো কৃষ্ণচূড়া গাছ নেই, যা মাওলার হাতে লাগানো নয়।
২০ বছর আগের কথা। মাঠে গরু চরাতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন মাওলা। কোথাও একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ছায়া মিলত না। প্রখর রোদে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভাবতেন, এখানে যদি একটা গাছ থাকত। সেই ভাবনা থেকেই সেখানে পুঁতে দিলেন একটি কৃষ্ণচূড়ার চারা। এরপর থেকে শুরু করলেন সড়কের পাশে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গাছ লাগানো। শুধু গাছ লাগানো নয়, গাছ বাঁচানোর কাজটাও করেন তিনি নিজে। গাছ রক্ষার জন্য বেড়া দেওয়ার পাশাপাশি নেন অভিনব কৌশল। গাছ লাগানোর পর এলাকার দুরন্ত শিশুর দলের হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি বাতাসা কিংবা সন্দেশ তাদের মধ্যে বিতরণ করেন।
গাছ নিয়ে মাওলা মিয়ার সুখ-দুঃখের স্মৃতিও কম নয়। বললেন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামালের সমাধি, গঙ্গাসাগর ৩৩ মুক্তিযোদ্ধার গণকবর, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টসহ নানা প্রতিষ্ঠানে তিনি নিজের হাতে গাছ লাগিয়েছেন। এসব গাছ তিনি প্রায়ই দেখে আসেন। এগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করেন। যখন দেখেন, গাছগুলো ছায়া দিচ্ছে পথচারীসহ হাজারো মানুষকে, তখন অনেক আনন্দ পান। বাড়িতে স্বজন এলে, কেউ প্রবাসে গেলে এমনকি কেউ ভালো খবর শোনালেও তাঁকে উপহার দেন একটি গাছের চারা। বছর দুয়েক আগের ঘটনা। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামালের সমাধিস্থলে লাগানো কৃষ্ণচূড়া গাছটি মরে যাওয়ার ঘটনা তাঁকে এখনো কষ্ট দেয়। নিজেকে সামাল দিতে পারেননি। গাছটির গোড়ায় বসে সেদিন অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন। মাওলা মিয়া বলেন, ‘আমি সব সময় ভাবি, সবাই যদি গাছের মায়া বোঝে, তাহলে দেশটা একদিন গাছে গাছে ভরে যাবে।’
মাসুকুর রহমান
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।