সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: একজন হিটলারের গল্প

একজন হিটলারের গল্প



  
যুদ্ধ আর মৃত্যু যেন একে-অন্যের প্রতিশব্দ। সভ্যতার আদি থেকেই ক্ষমতা দখল ও নানামুখী বিরোধের জের ধরে পৃথিবীর ইতিহাসে অসংখ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর এ যুদ্ধের কারণে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে অনেক নগর এমনকি সভ্যতাও। একের পর এক যুদ্ধ বৈশ্বিক সভ্যতার অগ্রগতিকে করেছে বাধাগ্রস্ত মানবিকতাকে করেছে বিপন্ন। এমনই ভয়াবহ স্মৃতির চাক্ষুষ উদাহরণ প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্ব মানচিত্রকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘতম যুদ্ধটির মাত্র ২৫-৩০ বছর না পেরোতেই আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের খড়গ নেমে আসে শান্তিপ্রিয় পৃথিবীবাসীর কপালে। গোটা পৃথিবী বিস্ময় আর বিহ্বল চোখে তাকিয়ে দেখল আরও একটি ধ্বংসযজ্ঞ। দেখল আরও একটি বিশ্বযুদ্ধ।


এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে সভ্য সমাজের সবচেয়ে বড় আর ধ্বংসাত্দক যুদ্ধ বলা হয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই যুদ্ধে গোটা পৃাথবী লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে। জার্মানির সঙ্গে মিত্রপক্ষের যুদ্ধের মাধ্যমে এর সূচনা ঘটে। মিত্রপক্ষে প্রথমদিকে ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং পোল্যান্ড। জার্মানির সঙ্গে পরবর্তীতে ইতালি যুক্ত হয়ে অক্ষশক্তি হিসেবে আত্দপ্রকাশ করে। জার্মানি কর্তৃক দখলকৃত কিছু দেশ হতেও অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী প্রেরিত হয়। বিশেষত পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধে এসব দেশের সৈন্যরা অংশগ্রহণ করে; অন্যান্য জাতিসমূহ মিত্রশক্তির সঙ্গে যোগ দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির সঙ্গে যে কোনো ধরনের আক্রমণ থেকে বিরত থাকার মর্মে অনাক্রমণ চুক্তি নামে একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিল। কিন্তু ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে এবং এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির সঙ্গে যোগ দেয়। মূলত জার্মানি এবং জাপান দুই অক্ষশক্তিই যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করার মাধ্যমে একে যুদ্ধে ডেকে আনে। অপরদিকে চীনের সঙ্গে জাপানের ছিল পুরাতন শত্রুতা; ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ চলছিল। এর ফলে চীনও মিত্রপক্ষে যোগদান করে। ১৯৪৫ সালে জার্মানি এবং জাপান উভয় দেশের নিঃশর্ত আত্দসমর্পণের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ভয়াবহ এই যুদ্ধে আনুমানিক ৬ কোটি ২০ লাখ মানুষ মারা যায়, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বা রাশিয়ার নাগরিক। নিহতের এই বিশাল সংখ্যার মূল কারণ ছিল গণহত্যা আর অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার। আধুনিক সময়ে সংঘটিত এই যুদ্ধে অস্ত্র হিসেবেও আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার করা হয়। ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ব্যবহার এই যুদ্ধের ভয়াবহতাকে কয়েক হাজার গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসে একজন ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়। তিনি অ্যাডলফ হিটলার। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। মিত্রপক্ষে ছিল যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, রাশিয়া ও গণচীন। জার্মানির সঙ্গে ছিল ইতালি ও জাপান। এই যুদ্ধে প্রথমে রাশিয়া অংশগ্রহণ না করলেও পরবর্তীতে জার্মানি রাশিয়াকে আক্রমণ করে যুদ্ধে বাধ্য করে।

এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মিত্রশক্তির বিজয় হয়। জাতিসংঘ সৃষ্টি হয়। বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্দপ্রকাশ ঘটে আর রাশিয়া-আমেরিকা স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমে সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমার ব্যবহার হয় আর এর শিকার হয় জাপান। ১৯৪৫ সালে জার্মানি এবং জাপান উভয় দেশের নিঃশর্ত আত্দসমর্পণের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তবে আধুনিক সময়ের এই যুদ্ধের ভয়াবহতার কারণে মানুষ একে কখনো ভুলতে পারবে না।

১ জন হিটলার
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য এককভাবে একজন ব্যক্তিকে দায়ী করা হয়। কেবলমাত্র তার উচ্চাভিলাষ ও একগুঁয়েমির কারণেই গোটা বিশ্ব একটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তিনি আর কেউ নন। অ্যাডলফ হিটলার। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। তার বিস্ময়কর উত্থান যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এই ছবিটি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একজন সাধারণ সৈনিক ছিলেন তিনি। হাজারও মানুষের ভিড়ে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খলনায়ক হিটলারকে। তখনো কী কেউ ভাবতে পেরেছিল এই হিটলারই একদিন সারা পৃথিবীর অধিকর্তা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবেন? সারা পৃথিবীজুড়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দুঃস্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন তিনি। আর সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাজিয়ে তোলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। কিন্তু মানুষ চাইলেই তার সব স্বপ্ন ছুঁতে পারে না। পারেননি হিটলারও। ব্যর্থতা মেনে নিতে না পেরে ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল জার্মানির বার্লিন শহরের এক গোপন বাঙ্কারে আত্দহত্যা করেন। আর সেই সঙ্গে পৃথিবী মুক্তি পায় হিটলার নামক ভয়ঙ্কর এক অভিশাপের কবল থেকে।

অস্ট্রিয়ার ব্রাউনাউ শহরে ১৮৮৯ সালের ২০ এপ্রিল অ্যাডলফ হিটলারের জন্ম। জন্ম সূত্রে অস্ট্রিয়ান ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যতা ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এর পরও উচ্চাভিলাষ আর সৌভাগ্যের পিঠে চড়ে ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর এবং ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশের ফিউরার হিসেবে দেশ শাসন করেন। পৃথিবী জয়ের স্বপ্ন দেখতে পারে এমন কোনো পরিস্থিতি হিটলারের জীবনে কখনোই ছিল না। হিটলারের বাবার কোনো জাত ছিল না। সোজা বাংলায় বললে বলা যায় হিটলার ছিলেন একজন জারজ সন্তান। তিনি জীবনের অনেকটা সময় শেষ নাম হিসেবে তার মায়ের নাম ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৭৬ সালেই প্রথম হিটলার নামটি গ্রহণ করেন। সৎ বাবা সরকারি কাস্টমস থেকে অবসর গ্রহণের পর সপরিবারে অস্ট্রিয়ার লিনৎসে শহরে চলে আসেন। এখানেই হিটলারের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়। এ কারণে সারাজীবন তিনি লিনৎসকে ভালোবেসে গেছেন, কোনো শহরকে এর ওপরে স্থান দিতে পারেননি। বাবাকে তিনি পছন্দ করতেন না বরং ভয় করতেন। কিন্তু মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। ১৯০৩ সালে বাবা মারা যান। বাবার রেখে যাওয়া পেনশন ও সঞ্চয়ের অর্থ দিয়েই তাদের সংসার কোনোমতে চলতে থাকে। অনেক ভোগান্তির পর ১৯০৭ সালে মাও মারা যান। হিটলার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। পড়াশোনায় সুবিধা করতে না পেরে ভিয়েনায় গিয়ে চিত্রশিল্পী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন নিজের পুরনো শহরে। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর কেটেছে হতাশা আর গ্লানিতে।

১৯১৩ সালে হিটলার চলে আসেন মিউনিখ শহরে। তখনো চলছিল তার এলোমেলো জীবন। এখানে আসার পরের বছর ১৯১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি অস্ট্রিয়ান মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেও শারীরিক অযোগ্যতায় ব্যর্থই হচ্ছিলেন বলা চলে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে জার্মান সেনাবাহিনী এত কিছু আর যাচাই-বাছাই করেনি। জার্মানির ১৬তম ব্যারাভিয়ান রিজার্ভ ইনফেন্ট্রি রেজিমেন্টের ভলান্টিয়ার সদস্য হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ১৯১৬ সালের অক্টোবর মাসে যুদ্ধে গুরুতর আহত হন হিটলার। দুই বছর পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যখন সমাপ্তি ঘটে তিনি তখন পর্যন্ত হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। যুদ্ধে বীরত্ব দেখানোর জন্য তাকে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা দেওয়া হয়। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানির পরাজয় হিটলার মেনে নিতে পারেননি। এর মধ্যেই হিটলারের জীবন অন্যদিকে মোড় নেয়। ১৯১৯ সালে হিটলার মিউনিখের ছোটখাটো একটি ডানপন্থি দলে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই দলটি হিটলারের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এর মধ্যেই পার্টির নাম পাল্টে রাখা হয় নাৎসি। পার্টি জয়েন করার মাত্র দুই বছরের মধ্যেই হিটলার হয়ে উঠলেন পার্টির অবিসংবাদিত নেতা। জার্মান ভাষায় যাকে বলা হতো ফুয়েরার।

১৯২৩ সালের নভেম্বরে নাৎসিরা একটি অভ্যুত্থান চালিয়ে ব্যর্থ হলে হিটলারকে জেলে পাঠানো হয়। কিন্তু এক বছরেরও কম সময় জেল খাটার পর মুক্তি পেয়ে যান হিটলার। ইতোমধ্যে জার্মানির পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জার্মানির সাধারণ মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ১৯৩৩ সালের জানুয়ারি মাসেই জার্মানির শাসন ক্ষমতায় চলে আসে নাৎসিরা। আর হিটলার হয়ে যান জার্মানির চ্যান্সেলর। তার বয়স তখন ৪৪ বছর। চ্যান্সেলর হয়েই হিটলার খুব দ্রুত একনায়কত্ব কায়েম করতে শুরু করেন। তার প্রথম নীতিই ছিল বিরোধী এবং ইহুদি নিধন। হিটলার যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নকশা আঁকতে শুরু করেছিলেন তখন কারও পক্ষেই তাকে বাধা দেওয়া সম্ভব হয়নি। হিটলার যখন ভার্সাই চুক্তি অমান্য করেন তখন ব্রিটেন কিংবা ফ্রান্স কেউ কোনো প্রতিবাদ করার সময় পায়নি। এর পরের ঘটনা সবারই জানা। একে একে অনেকগুলো দেশ জড়িয়ে গেল একটি ভয়াবহ যুদ্ধে। আর সেই যুদ্ধই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সমগ্র বিশ্বে নিজের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যে যুদ্ধের নীল নকশা এঁকেছিলেন হিটলার নিজে, শেষ পর্যন্ত তার সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। ব্যাপক গণহত্যা আর যুদ্ধের ভয়াবহতা যখন চরমে তখন নিজের পরাজয় টের পেয়ে নিজের প্রেমিকা ইভাকে সঙ্গে নিয়ে আত্দহত্যা করেন হিটলার।

হিটলারের সেই বাঙ্কার সেই বাঙ্কার
জার্মানির একনায়ক অ্যাডলফ হিটলার তার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন একটি বাঙ্কারের ভেতর। পৃথিবীর ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জুড়ে আছেন হিটলার। স্বভাবতই তার শেষ দিনগুলোর সঙ্গী সেই বাঙ্কার সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ থাকবে। সেই আগ্রহ মিটেছে ক'দিন আগেই। সেই বাঙ্কারের অপ্রকাশিত কিছু ছবি প্রকাশ করেছে লাইফ ডট কম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকের ওই সময়টাতে হিটলার তার প্রেমিকা ইভা ব্রাউনকে নিয়ে বার্লিনের এক বাঙ্কারে থাকতেন। যুদ্ধে পরাজয় আসন্ন জেনে ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল প্রেমিকাসহ ওই বাঙ্কারে আত্দহত্যা করেন হিটলার। প্রকাশিত সাদাকালো ছবিগুলোতে ক্ষমতাধর একজন একনায়কের শেষ জীবনের বেশ অগোছালো ও সাদামাটা জীবনযাপন উঠে এসেছে। বাঙ্কারের যে সোফায় হিটলার ও ইভা ঘুমাতেন যুদ্ধকালীন প্রতিবেদকেরা তা পরীক্ষা করে দেখছেন। সোফার ফেব্রিকে লেগেছিল গুলিতে আত্দহত্যার পর ছিটকে পড়া ছোপ ছোপ রক্ত।


নিষ্ঠুরতার হলোকাস্ট
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম আলোচিত ঘটনা হচ্ছে 'হলোকাস্ট'। মানে হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদি ধর্মাবলম্বীদের ওপর চালানো গণহত্যা। হিটলারের অধীনস্ত জার্মান নাৎসি সামরিক বাহিনী ইউরোপের তদানীন্তন ইহুদি জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের বেশি অংশকে বন্দীশিবির ও শ্রম শিবিরে হত্যা করে। আভিধানিক অর্থে হলোকাস্ট শব্দটি এর আগে নানারকম দুর্ঘটনা, দুর্যোগ ও হত্যাযজ্ঞকে বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে তা বিশেষভাবে হিটলারের নাৎসি বাহিনী কর্তৃক জার্মানির ইহুদি এবং আরও কিছু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে নির্বিচারে হত্যার ঘটনাকে বোঝায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল সোসালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির পরিচালিত গণহত্যায় তখন আনুমানিক ষাট লাখ ইহুদি এবং আরও অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ প্রাণ দিয়েছে। হিটলারের বাহিনী ষাট লাখ ইহুদি ছাড়াও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, কমিউনিস্ট, রোমানী ভাষাগোষ্ঠীর (যাযাবর) জনগণ, অন্যান্য স্লাবিক ভাষাভাষী জনগণ, প্রতিবন্ধী, সমকামী পুরুষ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের মানুষদের ওপর এই অমানবিক গণহত্যা পরিচালনা করে। অনেক লেখক অন্যসব জনগোষ্ঠীর নিহত হওয়াকে হলোকাস্টের সংজ্ঞার আওতায় না এনে তারা শুধু ইহুদি গণহত্যাকেই 'হলোকাস্ট' নামে অভিহিত করতে চান যাকে নাৎসিরা নাম দিয়েছে 'ইহুদি প্রশ্নের চরম উপসংহার' বলে। নাৎসি অত্যাচারের সব ঘটনা আমলে নিলে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে নব্বই লাখ থেকে এক কোটি দশ লাখের মতো।


অ্যাটমিক বম্ব ডোম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতম ইতিহাস হয়ে আছে জাপানের হিরোশিমা আর নাগাসাকি। আর এখনো সেখানকার সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করিয়ে দেয় অ্যাটমিক বম্ব ডোম। বিভিন্ন সময় হিরোশিমা আর নাগাসাকির সেই ভয়াল বিস্ফোরণের পর গোলাকার স্তম্ভের একটা বিল্ডিং ঠিক রইল।


 তখন অনেকেই অবাক হয়েছিল। গোলাকার স্তম্ভের বিল্ডিংটার নাম অ্যাটমিক বম্ব ডোম। অ্যাটমিক বম্ব ডোম আসলে একটা নামকরা প্রেক্ষাগৃহ ছিল। যার চূড়াতে ক্ষেপণ করা হয়েছিল বিশ্ব মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমা। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সোমবারের সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে মাইলের পর মাইল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেলেও এই প্রেক্ষাগৃহের কাঠামোটি কোনোরকমে টিকে থাকে। কারণ, পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ কেন্দ্র থেকে বৃত্তাকারে ছড়িয়ে পড়েছিল চারপাশে, মূল কেন্দ্রটিকে তুলনামূলকভাবে অক্ষত রেখে।


পারমাণবিক যন্ত্রণা!
১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে মহা-লজ্জার একটি দিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের দিকে ৬ আগস্ট বেলা আড়াইটায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী বিশ্ব মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লীয় বোমা ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে চমৎকার ঝকঝকে শহরটি পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। লিটল বয় নামক বোমাটির ওজন ছিল ৬০ কেজি। নিজস্ব গন্তব্যে পৌঁছতে এটি সময় নেয় ৫৭ সেকেন্ড। এই সময়ে এটি অতিক্রম করে ৬০০ মিটার দূরত্ব। এ বিস্ফোরণটি ঘটে ১৩ কিলোটন (ঃহঃ)-এর সমান এবং সে সময় তাপমাত্রা হয়েছিল ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বিস্ফোরণের পর ১ মাইল ব্যাসার্ধের এলাকাজুড়ে ধ্বংসলীলা শুরু হয় এবং হিরোশিমার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ঘটনার পর ওই দিন সকাল ১১টায় হিরোশিমা শহরে দেখা গেল অসংখ্য মানুষের লাশ আর আহতদের চিৎকার। বোমা নিক্ষেপকারী পাইলট টিবেটস বিমান থেকে শহরের ভয়াবহ ধ্বংসের দৃশ্য দেখে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, হায় ঈশ্বর এ কি করলাম!


হিরোশিমার ভয়াবহতার কারণ বুঝে ওঠার আগেই এর ঠিক তিনদিন পর জাপানেরই নাগাসাকি শহরে দ্বিতীয় বোমা 'ফ্যাট ম্যান'-এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই কলঙ্কজনক ঘটনার নেপথ্যে ছিল অস্ত্রের উন্নয়নে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্লজ্জ অমানবিক প্রতিযোগিতা। আণবিক অস্ত্রের জন্ম হয়েছিল এই ভীতি থেকে যে, হিটলারের জার্মানি একচেটিয়া অধিকারী হয়ে গোটা বিশ্বে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু পরবর্তীতে প্রমাণ হয় যে, জার্মানিতে এ ধরনের বোমা তৈরিতে শুধুমাত্র একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া ছাড়া কোনো কার্যকর উদ্যোগ আদতেই নেওয়া হয়নি। কিন্তু এর আগেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারও আগে যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী হিসেবে বসবাস করা হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী ড. লিও জিলার্ড সর্বপ্রথম বোমা তৈরির উদ্যোগ নেন। এ বোমার মানবতাবিরোধী ভয়ঙ্কর ভয়াবহতার কথা বিবেচনা না করেই বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সমর্থন জোগান জিলার্ডকে। এরা দুজন যখন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানকে এ বোমার কার্যকারিতা উল্লেখ করে জানান, তখনো বিষয়টি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে গুরুত্ব পায়নি বিশেষভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই অস্ত্রকেই বেছে নিলেন তারা। আর মানবতা হার মানল সেই পৈশাচিক বর্বরতার কাছে।

১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে আনুমানিক প্রায় ১৪০,০০০ লোক মারা যান। নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪,০০০ লোক মারা যান। শুধু তাই নয় পরবর্তী সময়ে দুই শহরে বোমার পাশর্্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪,০০০ জন। জাপানের আসাহি শিমবুন-এর করা হিসাব অনুযায়ী বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগসমূহের ওপর হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য গণনায় ধরে হিরোশিমায় ২৩৭,০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। দুই শহরেই মৃত্যুবরণকারীদের অধিকাংশই ছিলেন বেসামরিক লোকজন। নাগাসাকি আক্রমণের ৬ দিন পর ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্দসমর্পনণ করতে বাধ্য হয় জাপান।

লিটল বয়

* তেজস্ক্রিয় পরমাণু : ইউরেনিয়াম-২৩৫
* ওজন : চার হাজার কেজি, দৈর্ঘ্য : ৯.৮৪ ফুট, পরিধি : ২৮ ইঞ্চি
* মূল আঘাত : শিমা সার্জিক্যাল ক্লিনিক
* বিস্ফোরণের মাত্রা : ১৩ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য
* বহনকারী বিমানের নাম : বি-২৯ সুপারফোর্টেস
* পাইলট এর নাম : কর্নেল পল টিবেটস
* বোমা পতনে সময় লাগে : ৫৭ সেকেন্ড



ফ্যাট ম্যান
* তেজস্ক্রিয় পরমাণু : প্লুটোনিয়াম-২৩৯
* ওজন : ৪ হাজার ৬৩০ কেজি, দৈর্ঘ্য : ১০.৬ ফুট, পরিধি : ৪ ফুট
* মূল আঘাত : মিতসুবিশি স্টিল ও অস্ত্র কারখানা এবং উরাকামি সমরাস্ত্র কারখানার মাঝে
* বিস্ফোরণের মাত্রা : ২১ কিলোটন টিএনটির সমতুল্য
* বহনকারী বিমান এর নাম : বি-২৯ বঙ্কার
* পাইলটের নাম : মেজর চার্লস ডব্লু সুইনি
* বোমা পতনে সময় লাগে : ৪৩ সেকেন্ড

কেন এই যুদ্ধ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রশ্ন ওঠতে পারে কী কারণে এই ভয়াবহ যুদ্ধের অবতারণা হয়েছিল। মূলত হিটলারকে দায়ী করা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পেছনে প্রাসঙ্গিক আরও কিছু কারণ ছিল।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী মিত্রপক্ষ পরাজিত জার্মানির ওপর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেয় ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে। সন্ধির শর্ত সম্পর্কে জার্মান প্রতিনিধিদের মতামত উপেক্ষা করে তাদের সন্ধিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই একতরফা চুক্তিকে জার্মানরা কখনোই মেনে নেয়নি। জার্মানির জনগণের সেই জনরোষকে কাজে লাগিয়ে তাই মাত্র বিশ বছরের মধ্যেই অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসি জার্মানি ভার্সাই চুক্তি ভেঙে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। অন্যদিকে হিটলারের প্রতি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের আপসমূলক তোষণ নীতি হিটলারকে আরও অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। জার্মানির বেপরোয়া অস্ত্রসজ্জা, রাইনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া দখল প্রভৃতি ক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কোনো রকম বাধা না দেওয়ায় জার্মানি আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। আরেকদিকে মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের চেষ্টায় জাতিসংঘ স্থাপিত হলেও মার্কিন সিনেট তা অনুমোদন করেনি। ফলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশাল দেশ জাতিসংঘের বাইরে ছিল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের হাতে জাতিসংঘের দায়িত্ব থাকলেও আমেরিকার অনুপস্থিতিতে তারা বিশ্ব উত্তেজনা প্রশমনে ব্যর্থ হয়। ফলে সবাই যে যার ইচ্ছামতো আচরণ শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা বিশ্বের অধিকাংশ উপনিবেশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ফলে জার্মানি, ইতালি ও জাপান উপনিবেশ দখলের চেষ্টায় রত হয়। পারস্পরিক উত্তেজনা বিশ্বকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাবিত করে। এর বাইরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। দুই বৃহৎ গণতন্ত্রী রাষ্ট্রের এই মতবিরোধ ফ্যাসিবাদী শক্তির বিস্তারকে পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। সবকিছু মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতে একটা অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছিল। হিটলার এই অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হতে চেয়েছিলেন। আর অন্যরা সবাই না বুঝে অথবা নিজেদের ভুলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।



হিবাকুসা!
হিফবাকুস। খাঁটি জাপানি শব্দ। অর্থাৎ বিস্ফোরণ আক্রান্ত মানুষজন। যন্ত্রণা আর চোখের পানিই যাদের একমাত্র অবলম্বন। মার্কিনি বর্বরতার নৃশংসতম ক্ষতচিহ্ন বহন করছেন এই 'হিবাকুসারা। হিরোশিমা-নাগাসাকির বীভৎসতার সময় থেকে পরবর্তী বংশ পরম্পরায়। কারা এই 'হিবাকুসা?' সংজ্ঞা নির্ধারিত 'দি অ্যাটমিক বোম্ব সারভাইভারস রিলিফ' আইনে। যারা বোমা বিস্ফোরণস্থলের সামান্য কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের দুই সপ্তাহের মধ্যে যারা বিস্ফোরণস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন। যারা বিস্ফোরণ নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত। এই তিন অবস্থার মধ্যে থাকা গর্ভবতী মহিলারা। জাপানে এরাই আইনমতে হিবাকুসা। মার্চ, ২০০৫ এরা সংখ্যায় ছিলেন ২,৬৬,৫৯৮। এদের বড় অংশই জাপানের। কয়েক হাজার ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোরিয়া ও তার আশপাশে। তথ্য জাপান সরকারের। হিবাকুসারা পেয়ে থাকেন সরকারি সহায়তা। অনুদান হিসেবে কিছু অর্থ দেওয়া হয় প্রতি মাসে। 


প্রতি বছর বিস্ফোরণের বার্ষিকীতে স্মরণ করা হয় নিহতদের। প্রতি বছর বিগত বছরে নিহত 'হিবাকুসা'দের নাম লিখে দেওয়া হয় হিরোশিমা নাগাসাকির বুকে। মার্কিনি বোমার তেজস্ক্রিয়তায় ঝলসে যাওয়া নিহতদের স্মৃতিফলকে। দীর্ঘ হয়ে ওঠা এই তালিকা হিবাকুসাদের মতোই বহন করে চলেছে মার্কিনি 'সভ্যতা'র কুৎসিত ক্ষতচিহ্ন। উল্লেখ্য, আগস্ট ২০০৫-এ হিরোশিমায় নিহত 'হিবাকুসাদের সংখ্যা ছিল ২,৪২,৪৩৭ এবং নাগাসাকিতে ১,৩৭,৩৩৯। 'হিবাকুসাদের জবানবন্দিতে এভাবেই উঠে এসেছে হিরোশিমা মার্কিনি নারকীয় পরমাণু বিস্ফোরণের সে দিনের কথা। 'হিবাকুসাদের এই নিদারুণ জীবন যন্ত্রণা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ-ধিক্কার ঘৃণায় পরিণত হয়ে চিরদিন দংশন করে চলবে মার্কিন বিবেককে।



সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪-০৯- ২০১৩ ইং

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।