প্রায় এক শতাব্দীর
দীর্ঘ জীবনকাল। পুরোটাই কেটেছে মানবতার মুক্তির সংগ্রামে। বন্ধুর সেই পথচলা। ছিলেন
কালো মানুষের নেতা। হয়েছেন বিশ্বনেতা। চলেও গেলেন বিশ্বকে কাঁদিয়ে। তিনি নেলসন
ম্যান্ডেলা। প্রতিবাদ দিয়ে যে জীবনের শুরু, ঐক্য ও শান্তি স্থাপনের মধ্য দিয়ে তার পূর্ণতা।
মাঝখানে ২৭ বছরের কারাবাস। ম্যান্ডেলা আর কালো মানুষের মুক্তির আন্দোলন সমার্থক
হয়ে ওঠা। নির্যাতন-নিপীড়ন, শতপ্রাণ
বলিদান। সাদা-শাসকের ওপর বিশ্ব জনমতের চাপ। অতঃপর মুক্তি। ‘জাতশত্রু শ্বেতাঙ্গদের’ ক্ষমা
এবং ঐক্য ও সমঝোতার দক্ষিণ আফ্রিকা প্রতিষ্ঠা। এই একজীবনের ইতি ঘটল গত বৃহস্পতিবার দক্ষিণ আফ্রিকার স্থানীয় সময়
রাত আটটা ৫০ মিনিটে। যৌবনে পরিবারবিচ্ছিন্ন মানুষ ম্যান্ডেলা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ
করেন জোহানেসবার্গের নিজ বাড়িতে, পরিবারের
সদস্য ও স্বজনদের মাঝে। বয়স ৯৫ বছর চার মাস ১৭ দিন।
পড়ুন
একজন মেন্ডেলার গল্প।
এই মর্মন্তুদ খবর দক্ষিণ আফ্রিকা
আর বিশ্ববাসীকে জানান দেশটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা বৃহস্পতিবার গভীর রাতে,
সরাসরি টিভি সম্প্রচারের মাধ্যমে। আবেগতাড়িত
কণ্ঠে জুমা বলেন, ‘
আমাদের প্রাণপ্রিয়
নেলসন রোলিহলাহলা ম্যান্ডেলা,
আমাদের
এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এ জাতি
তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছে,
আমাদের
মানুষ হারিয়েছে তাদের পিতাকে।’
দীর্ঘ
রোগভোগের কারণে অনেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতই ছিলেন ম্যান্ডেলার মহাপ্রস্থানের জন্য।
তবু বৃহস্পতিবার গভীর রাতে খবরটি এসেছে বজ্রাঘাতের মতো। এর পর থেকে কান্নাভেজা
চোখে যেন জোহানেসবার্গের রাস্তায় নেমে আসে কালো-সাদা মানুষের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা।
তারা ভিড় জমাতে শুরু করে ম্যান্ডেলার বাড়ির সামনে। প্রিয় মাদিবাকে স্মরণ করে তাঁরা গেয়েছেন বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের
গান, স্মরণ করেছেন এক
বর্ণাঢ্য ব্যক্তির জীবন। ফুলে ফুলে ভরিয়ে দিয়েছেন সোয়েটোতে ম্যান্ডেলার সাবেক
বাড়ির উঠান।
বছর
খানেক ধরে শতবর্ষীপ্রায় শরীর নিয়ে ভুগছিলেন ম্যান্ডেলা। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর
ফুসফুসে সংক্রমণ ও পিত্তথলিতে পাথর নিয়ে তিনি প্রিটোরিয়ার একটি হাসপাতালে ভর্তি
হন। পক্ষকাল চিকিৎসা শেষে জোহানেসবার্গের বাসায় ফেরেন। নিয়মিত চিকিৎসা চলতে থাকে
সেখানে। চলতি বছরের মার্চে আবার নিউমোনিয়া নিয়ে ১০ দিন কাটান হাসপাতালে। জুনের ৮ তারিখ
আবারও ফুসফুসে সংক্রমণ, আবারও
হাসপাতাল। তখন জ্যাকব জুমা ঘোষণা দিয়েছিলেন, ম্যান্ডেলার অবস্থা সংকটাপন্ন। জুমা বিদেশ সফর
বাতিল করেন, ম্যান্ডেলার
সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করতে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান জাতিসংঘের মহাসচিব বান
কি মুন। বিশ্বমানবের মুখে হাসি
ফোটাতে যাঁর জন্ম, সেই
মাদিবা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন, ১৮
জুলাই বিশ্ববাসীকে নিয়ে উদ্যাপন করলেন ৯৫তম জন্মদিন। কিন্তু আবারও অসুস্থ হলেন, গেলেন হাসপাতালে। সেপ্টেম্বরে হাসপাতাল থেকে
বাড়ি ফিরলেন। রাতে ম্যান্ডেলার
মৃত্যুর পর থেকেই জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল
পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলার মৃত্যুতে শোক
প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ইমেরিটাস
আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু বলেছেন, ‘ম্যান্ডেলা আমাদের
শিখিয়ে গেলেন, কীভাবে একটি
বিভক্ত জাতিকে একত্র করতে হয়।’
ম্যান্ডেলার
মৃত্যুতে বিশ্বনেতা ও বিশিষ্টজনেরা শোক প্রকাশ করেছেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমুখ
গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় ১০ দিনের শোক পালন করা হচ্ছে।
২০০৪ সালে
রাজনীতি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসরে যাওয়ার পর থেকে ম্যান্ডেলা জনসমক্ষে আসতেন অনেক
কম। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলে সর্বশেষ তিনি জনসমক্ষে
বের হয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার
রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থা এসএবিসি (সাউথ আফ্রিকান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) জানিয়েছে, ম্যান্ডেলার মরদেহ প্রিটোরিয়ার একটি সেনা
হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগামী সোমবার জোহানেসবার্গের উপকণ্ঠে ৯৫ হাজার আসনের
একটি স্টেডিয়ামে জাতীয় শোক অনুষ্ঠান পালন করা হবে। এরপর রাজধানী প্রিটোরিয়ায় তিন
দিনের জন্য তাঁর মরদেহ রাখা হবে। তিনি সমাহিত হবেন পূর্ব কেপটাউনের কুনু গ্রামে, যেখানে ১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই তিনি জন্মেছিলেন। শেষ বিদায়ের সময় পাশে থাকতে পারেননি, কিন্তু ম্যান্ডেলার সৃষ্টির পাশে ঠিকই ছিলেন
তাঁর সবচেয়ে দুই ছোট মেয়ে। ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা
চলচ্চিত্র লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এর উদ্বোধনী প্রদর্শনী দেখতে লন্ডনে ছিলেন
তাঁরা। এ সময় তাঁরা জানতে পারেন, ম্যান্ডেলা
আর নেই।
‘সন্ত্রাসী’ থেকে বিশ্বনেতা: একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ম্যান্ডেলাকে
বিশ্বজনতার কাছে ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে
চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সমঝোতা ও ঐক্যের এক অবিসংবাদী প্রতীক হিসেবে
তিনি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ২৭ বছরের কারাজীবন থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি হিংসার আগুন জ্বালাননি, বরং কালোদের পাশাপাশি সাদা মানুষের অধিকার বহাল
রেখেছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। তিনি সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। ‘মানুষকে যন্ত্রণা দেওয়ার মতো যন্ত্রণা হয়তো আর নেই’, কারাগার থেকে বেরিয়ে মাদিবা রাষ্ট্রশক্তিধারী
সাদাদের সেই যন্ত্রণাও ঘুচিয়েছেন। দক্ষিণ
আফ্রিকানদের জীবন বদলে দেওয়া এই নেতা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর
নিরাপত্তার দায়িত্ব তুলে দেন এক সাদা মানুষের হাতে। ১৮ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করা
ররি স্টেইনকে প্রেসিডেন্টের প্রধান দেহরক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০১ সালে
স্মৃতিগ্রন্থ ওয়ান স্টেপ বিহাইন্ড ম্যান্ডেলায় ররি স্টেইন লেখেন, ‘পুলিশে চাকরির সময় আমাদের শেখানো হতো, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রের শত্রু।
কারাগার থেকে বেরিয়ে ম্যান্ডেলা যখন বলেন, এ রাষ্ট্র হবে সাদা-কালো সব মানুষের, তখন ভেবেছিলাম, এটা তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য। কিন্তু দক্ষিণ
আফ্রিকার অর্ধশতকের বিরোধ দূর করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত, অনেকের মতো তিনি আমার জীবনকেও বদলে দেন।’
সমঝোতা, ঐক্য, ক্ষমা: ১২ জুন, ১৯৬৪। আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা
বিশ্বকে জানিয়ে দেন তাঁর দর্শন। ‘আফ্রিকার মানুষের জন্য লড়াইয়ে আমি নিজের জীবন
উৎসর্গ করেছি। আমি সাদাদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছি, আমি কালোদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়েছি। আমি
একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের আদর্শ বুকে ধারণ করি, যেখানে সব মানুষ মিলেমিশে ও সমান সুযোগ নিয়ে
বসবাস করবে। এটা এমন এক আদর্শ, যার
জন্য আমি বেঁচে থাকতে চাই এবং অর্জন করতে চাই।’ জীবনের
শেষ দিন পর্যন্ত এই আদর্শ নিয়েই বেঁচে ছিলেন ম্যান্ডেলা।
১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০। ২৭ বছরের কারাভোগ থেকে বেরিয়ে এলেন ২০ শতকের
রাজনীতির আলোকস্তম্ভ ম্যান্ডেলা। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হলেন।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৫ সালে গঠন করলেন ট্রুথ অ্যান্ড
রিকনসিলিয়েশন (সত্য ও সমঝোতা) কমিশন, আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুকে করা হলো ওই কমিশনের
চেয়ারম্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতো আদালত গঠন করে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলাতে পারতেন সেই সব
বর্ণবাদী নেতাকে। কিন্তু বিভক্ত রাষ্ট্রকে আরও বিভক্ত করা ম্যান্ডেলার উদ্দেশ্য
ছিল না। ডেসমন্ড টুটু তাঁর নো ফিউচার উইদাউট ফরগিভনেস বইয়ে লিখেছেন, ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতো ‘ভিক্টরস জাস্টিস’ অথবা সাধারণ ক্ষমা বাদ দিয়ে এই তৃতীয় ব্যবস্থা
বেছে নেওয়ার একটিই কারণ—সাদা-কালোতে বিভক্ত একটি রাষ্ট্রের বিভেদ যেন আরও
বেড়ে না যায়।
মনেপ্রাণে
তরুণ ম্যান্ডেলা এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। কিন্তু রেখে গেলেন অধিকার আদায়ের এক
অবিস্মরণীয় সংগ্রামের ইতিহাস। সঙ্গে মানুষকে ভালোবাসার ইতিহাসও। বিশ্বের
মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়েই থাকবেন তিনি।
এ সম্পর্কে আরো পড়ুনঃ আলোচিত খবর
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।