গত ৭ জুলাই
দুপুরের কিছু টুকরো টুকরো ছবি। মিরপুর
স্টেডিয়ামের ড্রেসিং রুমের সামনে দাঁড়িয়ে সাকিব আল হাসান। দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছেন, ইতিউতি তাকাচ্ছেন। একটু পরে গেলেন পাশের একাডেমি ভবনে। জিমে একটু রানিং করলেন, হালকা
স্ট্রেচিং। সতীর্থদের
সঙ্গে খানিকটা খুনসুটি। কিন্তু
সবকিছুই প্রাণহীন। সাকিব তো তখন
নিজের মাঝেই নেই! অপেক্ষা ‘রায়’ জানার। বিকেলের দিকে জানতে পারলেন সেটি, ‘বাজে আচরণের’ জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ ছয় মাস! ঠিক চার মাস পর, তেমনই এক
পড়ন্ত দুপুর। মুশাঙ্গুয়ের
ব্যাট ছুঁয়ে বল মুশফিকের গ্লাভসে আশ্রয় নিতেই গ্যালারিতে গগনবিদারী চিৎকার, ‘সাকিব, সাকিব, সাকিব...।’ ওই আউটেই পূর্ণ হয়েছে ম্যাচে সাকিবের
১০ উইকেট। নাম উঠে গেছে
ইতিহাসেও।
সেঞ্চুরি
করেছিলেন আগেই। ১৩৭ বছরের
ইতিহাসে ২৭৭০ জন ক্রিকেটারের পদচারেণ সমৃদ্ধ হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট। কিন্তু রেকর্ড বইয়ের একটি পাতায় নাম
ছিল শুধু দুজনের। একই টেস্টে
সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট। সেখানে এখন
তিনজনের নাম। ইয়ান বোথাম
ও ইমরান খানের পাশে সাকিব আল হাসান! চার
মাস আগে নিজের নিষিদ্ধ হওয়ার খবরটি যখন শুনেছিলেন সাকিব, কাছ থেকে দেখা ঘনিষ্ঠ একজন বলেছিলেন, ‘সাকিবকে মনে হচ্ছিল বিধ্বস্ত, অসাড়।’ কাল
আরেকটি বিকেলে সেই সাকিব দারুণ প্রাণবন্ত। মাঠ
মাতালেন, নাচালেন
গ্যালারি। সেটি আরও
বেড়ে গেল বাংলাদেশ দলের জয়ে। খুলনা
টেস্টটা বাংলাদেশ জিতে নিয়েছে ১৬২ রানে। চট্টগ্রাম
টেস্ট হাতে রেখেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ জয়ও নিশ্চিত হলো। তাতে
বড় অবদান রাখলেন সাকিব। ম্যান অব দ্য
ম্যাচের নাম যখন ঘোষণা করা হলো কাল, আরেকবার ‘সাকিব, সাকিব’ চিৎকারে প্রকম্পিত চারপাশ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে, মাথা ঘুরিয়ে গ্যালারিতে তাকালেন জিম্বাবুয়ের
অধিনায়ক ব্রেন্ডন টেলর। দেখলেন
সাকিবের জনপ্রিয়তা। সংবাদ
সম্মেলনেও সাকিব হাসলেন, হাসালেন। কোচের
কণ্ঠে সাকিব স্তুতি। প্রধান
নির্বাচক বলছেন, সাকিব
বাংলাদেশের ক্রিকেট ছাড়িয়ে অন্য উচ্চতার একজন। ‘নিষিদ্ধ’ সেই সাকিব কাল উৎসবের মধ্যমণি। অথচ
এই ম্যাচ তাঁর দেখার কথা ছিল বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে, টিভিতে। কিংবা হয়তো দেখতেনই না! এখনো তাঁর নিষিদ্ধ থাকার কথা ছিল, মেয়াদ ছিল
আরও দুই মাস। ঠিক কোন বা
কোন কোন ‘বাজে আচরণে’ সাকিবকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেটা এখনো
জানা যায়নি।
তবে সেই
অজানা বাজে আচরণে ‘উন্নতি
হয়েছে’ জানিয়ে গত আগস্টে কমানো হয়েছে
নিষেধাজ্ঞা। এটি আদতে ছিল
কাপড়ে মোড়ানো আচ্ছাদন, আসল কারণটি বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বছরজুড়ে চলা
দুঃসময় আরও দীর্ঘায়িত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে। হাঁসফাঁস করতে থাকা এই দলের তাই প্রয়োজন ছিল অক্সিজেন। সাকিব অনেক দিন থেকেই বাংলাদেশ দলের
অক্সিজেন। পারফর্ম করুন
আর নাই করুন, সাকিবের
উপস্থিতিই দলকে করে চনমনে, এনে দেয় বাড়তি মাত্রা। আর সাকিব
পারফর্ম করছেন না, এই
কথাটিই বা কতবার উচ্চারিত হয়েছে তাঁর ক্যারিয়ারে! সাকিব আসলেই উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ধরাবাহিকতার চূড়ান্ত উদাহরণ। নিষেধাজ্ঞার ধাক্কা কাটিয়ে ফিরে
প্রথম টেস্টেই নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। দ্বিতীয়
টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেটের ইতিহাস। ব্রেন্ডন
টেলর বলছেন, ‘ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দেওয়ার জন্য
একজন সাকিবই যথেষ্ট।’ মুশফিকুর রহিম বলছেন, ‘অধিনায়ক হিসেবে আমি ভাগ্যবান যে সাকিবের মতো একজন পারফরমার
পেয়েছি।’ আর সাকিব? ‘দলের হয়ে, দলের জয়ে অবদান রাখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
আমার কাছে।’ এই চেষ্টা, এই পথচলাতেই ধরা দিচ্ছে ছোট-বড় অর্জন, দারুণ সব
কীর্তি। কালকেরটি
নিঃসন্দেহে সবকিছুর ওপরে। সাকিব নিজেও
এটিকে বলছেন নিজের সেরা। সঙ্গে অবশ্য
যোগ করেছেন, ‘আরও ভালো করতে পারি!’ এখানেই সাকিব ‘স্পেশাল’। ইমরান-বোথামের
পাশে বসে গর্বিত, কিন্তু
দৃষ্টি আরও অনেক দূরে। তাঁর আকাশ
অনেক বড়!
সাকিবের সাক্ষাৎকার-‘গ্রেটদের সঙ্গে থাকাও বড় ব্যাপার’
সংবাদমাধ্যমের
মুখোমুখি হতে এমনিতে খুব উৎসাহ নেই তাঁর। তবে
এমন ঝলক দেখাতে থাকলে তো বারবার আসতেই হয়! এই টেস্টেই যেমন সংবাদ সম্মেলনে এলেন
দুবার। প্রথমবার
সেঞ্চুরির পর, কাল
আরও বড় কীর্তি গড়ে। সাকিব আল
হাসান কথা বললেন নিজের আর দলের অর্জন নিয়ে
:দারুণ এক রেকর্ড ছুঁলেন, কেমন লাগছে?
সাকিব আল হাসান: রেকর্ড...এখনো
জানি না ঠিক কোন রেকর্ডটা করেছি। কিছু
একটা হয়েছে, একজন-দুজন
করেছে...।
:একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট নিয়ে ইমরান-বোথামের পাশে বসা...
সাকিব: দলের জয়টাই আমার কছে অনেক বেশি
গুরুত্বপূর্ণ। জয়ে অবদান
রাখাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
:প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট হওয়ার পর এমন কিছুর লক্ষ্য ছিল কি না...
সাকিব: লক্ষ্য এমন কোনো ছিল না। শুভ্রদা (প্রথম আলোর ক্রীড়া সম্পাদক
উৎপল শুভ্র) আমাকে বলেছিলেন, এমন একটা রেকর্ড আছে। তারপর ওনাকে আমি বলেছিলাম, ‘মাথায় থাকল’। এর আগে জানতামই
না এমন কিছু আছে। মাথায় থাকার
কারণে একটু হয়তো ইচ্ছে ছিল...সবচেয়ে বড় কথা আমরা জানতাম আমাদের স্পিনার বা
বোলারদের কেউ পাঁচ উইকেট নিতে পারলে আমাদের জেতার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ বেড়ে যাবে। এটা যে কেউ হতে পারে, তাইজুল, লিখন (জুবায়ের)। আমি ভাগ্যবান যে আমার ক্ষেত্রে
জিনিসটা হয়ে গেছে।
:ফিরেই এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স!
সাকিব: ফেরা তো আগের ম্যাচেই হয়েছে। এই ম্যাচে আমার যতটুকু সম্ভব দলের
জন্য করার ছিল আমি চেষ্টা করেছি।
:মিরপুর টেস্ট বা এখানে প্রথম ইনিংসের ৫ উইকেটের চেয়ে শেষ দিনের ৫ উইকেট বেশি গুরুত্বপূর্ণ কি না...
সাকিব: অবশ্যই, ওদের সামনে সুযোগ ছিল আড়াই সেশনের
মতো ব্যাট করে ম্যাচটা ড্র করার। উইকেট
নেওয়া খুব সহজ ছিল না এই উইকেটে। সেদিক
থেকে চিন্তা করলে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
:তৃতীয় দিন শেষে বলেছিলেন জিততে হলে তিনটি কঠিন শর্ত পূরণ করতে হবে। সেটাই হয়েছে, ভবিষ্যৎ দেখতে পান নাকি?
সাকিব: হা হা হা হা, নাহ, আমি ভবিষ্যৎ দেখায় বিশ্বাস করি না। তখন পরিস্থিতি অমনই ছিল। বলেছিলাম, এগুলো হলে আমাদের জেতা সম্ভব। আমাদের ভাগ্য ভালো যে সবকিছু ওভাবেই
হয়েছে।
:শেষ দিকে শাহাদাত যখন ক্যাচ ছাড়লেন, বেশ খেপে গিয়েছিলেন মাঠে!
সাকিব: ওসব মাঠে একটু থাকেই। বিশেষ করে ওই সময়ে। উত্তেজনা ছিল তখন। আমি শেষ করতে পারলে আরও ভালো লাগত। তবে এমন নয় যে খারাপ লাগছে। আমার তো তখন ৫ উইকেট হয়েই গেছে... (হাসি)।
:শুধু আপনিই নন, বাংলাদেশ দলে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স এখন অনেকেরই ভালো হচ্ছে...
সাকিব: আমরা যখন শুরু করেছি ,তখন এক রকম
পরিস্থিত ছিল। এখন আরেক রকম
পরিস্থিতি আসছে। যত দিন যাবে
আমাদের ক্রিকেট তত উন্নতি করতেই থাকবে। ব্যক্তিগতভাবে
উন্নতি করতে না পারলে দল হিসেবে উন্নতি করার সুযোগ কম থাকে। এখন দলে অনেক বেশি পারফরমার আছে, দলে অবদান রাখতে পারে বোলিং হোক বা
ব্যাটিংয়ে। দলে
প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। প্রথম
টেস্টের পর তাইজুল যেমন বলেছে, ‘এখানে
টিকে থাকতে হলে সবাইকেই পারফর্ম করতে হবে’। এই
কথাটা আমারও মনে ধরেছে। জায়গা ধরে
রাখতে হলে পারফর্ম করতেই হবে। আমার
মনে হয় এই জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধু
দলে থাকারাই নয়, দলের
বাইরে যারা আছে, যারা
আগামী দিনে আসবে, তাদের
মনে রাখা যে এখানে আসা অবদান রাখার জন্য। আর
এটাই দায়িত্ব। এই কারণেই
সবাই আসে বা সবাইকে বাছাই করা হয়।
:ক্যারিয়ারে দারুণ সব পারফরম্যান্সের অভাব নেই আপনার। এই ম্যাচের পারফরম্যান্সকে কোথায় রাখবেন?
সাকিব: পুরো ম্যাচের পারফরম্যান্স বিচার করলে তো অবশ্যই এটা ১ নম্বরে...এখন পর্যন্ত। তবে এর থেকেও তো আরও ভালো করা সম্ভব। খেলায় যেভাবে উন্নতি হচ্ছে, যদি ধরে রাখতে পারি এটা কে জানে হয়তো আরও ভালো হতে পারে!
:ইমরান-বোথামের পাশে নিজের নাম দেখে কেমন লাগছে? সোবার্স-কপিলরা কেউ এটা করতে পারেননি!
সাকিব: যাঁদের নাম বললেন, তাঁরা এত বড়, গ্রেট গ্রেট
খেলোয়াড়...তাঁদের সঙ্গে নাম থাকাও একটা বড় ব্যাপার। নাম আছে এটা ভালো লাগছে। কিন্তু
আমার কাজ দলের হয়ে অবদান রাখা, যত ভালো সম্ভব পারফর্ম করা, দেশের হয়ে
অবদান রাখা।
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।