বিখ্যাত মোটরগাড়ি
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যারি ব্যাররা। ম্যারির জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। ২০১৪ সালে টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালী
ব্যক্তির তালিকাভুক্ত করে। ২০১৩ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন তাঁকে বিশ্বের ৩৫তম শক্তিশালী নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ম্যারি ব্যাররা ২০১৪ সালের ৩ মে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দেন।
উপস্থিত সব অভিভাবক, অতিথি আর সম্মানিত শিক্ষকদের ধন্যবাদ। আজকের অনুষ্ঠানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ যারা, সেই ২০১৪ সালের স্নাতক শিক্ষার্থীদের আমার শুভেচ্ছা। এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমি থাকতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।আজ কেন জানি বারবার আমি আমার শিক্ষাজীবনে ফিরে যাচ্ছি। সমাবর্তনের সেই উত্তেজনা, আনন্দের কথা আমাকে এখন শিহরিত করছে। সেই দিন আমি যে প্রত্যয় আর স্বপ্ন দেখেছিলাম তা বারবার মনে পড়ছে। সেই সময়ের পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে। এখন তো তোমরা একুশ শতকের স্নাতক। সমাজে তোমাদের বয়সের কিশোর আর তরুণদের সংখ্যাই বেশি।
তোমাদের
নিজেদের মধ্যে কিন্তু ভাবনার মিল কমই দেখা মেলে।
যেমন
ধরো, তোমাদের
মধ্যে সবাই কিন্তু সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা মুঠোফোনের মধ্যে ডুবে থাকো না। নানা পরিসংখ্যান বলে, কিশোর আর তরুণদের মধ্যে
প্রতি পাঁচজনের
মাত্র একজন এই যন্ত্র-বন্ধুটিকে ছাড়া রাতে ঘুমোতে যাও। তোমরা সবাই ধনী নও,
কিন্তু
পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ধনী প্রজন্মের সদস্য তোমরা।
চিন্তা
করে দেখো, আগের
সময়ের পৃথিবীর মানুষের চেয়ে তোমরা কত বেশি সুযোগ-সুবিধা লাভ করো। তোমাদের
ইন্টারনেট আছে, আছে
আইফোন।
তোমাদের আরেকটি কথা না বললেই নয়, তোমাদের এই প্রজন্মের
বেশির ভাগ কিশোর আর তরুণই
কিন্তু
অমনোযোগী। হ্যাঁ, আমি তোমাদের অমনোযোগী বলছি। তোমরা কারও কথাই যেন শুনতে চাও না। আমি কিন্তু সবাইকে অমনোযোগী বলছি না, কেউ কেউ। এই যে শেষ তিন মিনিটে আমার কথা শুনতে
শুনতে তোমাদের মধ্যে গুটি কয়েক নিজেকে খুদেবার্তা আর টুইট করা থেকে বিরত রাখতে পেরেছ। অন্যরা টুইট, স্ট্যাটাস আর টেক্সট নিয়ে ব্যস্ত।
আগের
পৃথিবীর সবকিছু এখন বদলে গেলে,
কিছু
কিছু জিনিস কিন্তু
এখনো আগের মতোই আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে
এসে তোমরা যে মানসিক দক্ষতা,
গাণিতিক
যুিক্ত, সমস্যা
সমাধানের কৌশল, যোগাযোগ
দক্ষতা, টিমওয়ার্ক
নিয়ে জ্ঞান
অর্জন করেছ তা কিন্তু অসাধারণ। ৩০ বছর
আগে এগুলো ছিল সফলতার সূত্র। এখনো
মানুষকে সফল হতে হলে এসব দক্ষতা প্রয়োজন। কিন্তু
আমার চেয়েও এই সব তত্ত্বকথা
তোমরা বেশি ভালো করে জানো,
বোঝো। কারণ, আগে এসব গুণ সফলতার পথ নির্মাণ করত। আর এখন
মানুষ এই সব দক্ষতা নিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করে। ইন্টারনেটের কারণে তোমরা আগে থেকেই সব
জানতে পারো। কিন্তু তার পরেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের দক্ষতা আর গুণ
মানুষকে অভিজ্ঞ করে তোলে। নিজেকে
অন্যের চেয়ে দক্ষ করে
তুলতে একাগ্রতার বিকল্প নেই। আমার
সমাবর্তনের পর থেকে জীবনে অনেক কিছু শিখেছি। যা
শিখেছি তার থেকে আধা ডজন নীতিকথা তোমাদের জানাতে চাই।
এক.
যে কাজ
একবার শুরু করেছ, তা
নিয়ে দ্বিধান্বিত হবে না। সফল
হওয়ার ইচ্ছা আর পরিশ্রম
দিয়ে সেই কাজ করে যাও। আমার
অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, স্কুল-কর্মস্থলে, পেশাজীবনে, খেলাধুলায় সব জায়গায়
অনেক প্রতিভাবান লোকের দেখা
মেলে। কিন্তু মনে রেখো, প্রতিভা দিয়েই সব হয় না। সফলতার জন্য তোমাদের প্রয়োজন প্রচণ্ড
ইচ্ছাশক্তি ও পরিশ্রম। সাফল্যের
দরজায় জোরে ধাক্কা
দাও। পরিশ্রম করো৷ যদি
তুমি কোনো প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী হও, তাহলে তোমার একাগ্রতা আর পাগলামি তোমার দলের অন্যদের উৎসাহ
জোগাবে। বড় কিছু অর্জনের জন্য যতটা সম্ভব পরিশ্রম করে যাও।
দুই.
সব সময়ের জন্য সৎ থাকতে
হবে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে নিজেকে সৎভাবে
প্রমাণিত করো৷ নিজের কাছে
সততা
সবচেয়ে বড় আত্মবিশ্বাস। কথা
ভঙ্গ করবে না। তোমার গ্রাহকদের জন্য, পিতামাতার জন্য, কর্মীদের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুদের জন্য এবং নিজের জন্য, যেটা ঠিক সেটাই করবে সততার
সঙ্গে।
তিন.
বন্ধু তৈরি করো৷ মনে রেখো,
সফলতা
কখনো একা আসে না। একসময় তোমরা নিশ্চয়ই বড় বড় সাফল্য
লাভ করবে। কিন্তু কখনোই একা একা তুমি কিছুই করতে পারবে না। বন্ধু তৈরি করো৷ সাফল্য সব সময় দলগত পরিশ্রমের
সমষ্টিগত ফলাফল। তোমরা আগামীর দলনেতা। নেতৃত্বের জন্য তোমাদের অন্য মানুষের কাছ
থেকে সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্য অর্জন করতে হবে। নিজের
কথা বলার চেয়ে অন্যদের কথা শোনার অনন্য যোগ্যতা অর্জন করতে হবে তোমার। সত্যি বলতে মানুষ তখনই তোমার প্রতি
সহানুভূতি দেখাবে, যখন
তুমি তাদের
সহানুভূতি দেখাবে। জীবনের
নানা প্রয়োজনীয় কাজের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে তোমাকে অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, বাড়াতে হবে বন্ধুর সংখ্যা।
চার. যেকোনো বাধা-বিঘ্নকে সামনে
থেকে মোকাবিলা করতে হবে। বাড়ি
কিংবা অফিসে যেখানেই
তুমি কোনো সমস্যা দেখবে, তার
সম্মুখীন হও। তোমার যা কিছু আছে তা নিয়েই সমস্যার সমাধান
করো৷ আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি,
যেকোনো
সমস্যা সমাধানে
পরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। মনে
রেখো, সমস্যার
সমাধান সামনে থেকেই
করতে হয়। সমস্যাকে যতই অবজ্ঞা করবে, ততই তা বড় হয়ে উঠবে।
পাঁচ. অন্যের জন্য কিছু করো৷
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর উদ্ভাবনী প্রযুক্তির এই সময়ে তোমাদের সামনে আছে অনেক সুযোগ। অনেক কিছু করে ফেলতে পারবে তোমরা।
কিন্তু
সবকিছুর আগে একটা কাজ করতে কখনোই ভুলবে না। নিজের
মেধা দিয়ে অন্যের জন্য
ভালো কিছু করবে সব সময়। আমি
জানি, আজকের
এই সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বেশ
কজন
স্পাইডারম্যান-ভক্ত আছে। স্পাইডারম্যান
সিনেমার সেই উক্তি নিশ্চয়ই
তোমাদের
মনে আছে? ‘অধিক
ক্ষমতা অন্যের প্রতি তোমার বড় দায়িত্ব তৈরি করে।’
সর্বশেষ, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো৷
আমি এই বিশেষ দিনে তোমার বন্ধু, পরিবার এবং নিজের ওপর
বিশ্বাস রাখার কথা বলছি। নিজের
বন্ধু আর পরিবারকে
সব সময় কাছে রাখবে। আমি
তোমাদের পরিবার আর বন্ধু কতখানি
গুরুত্বপূর্ণ
সেটা বলে বোঝাতে পারব না। তারাই
তোমার পথ চলাকে পরিপূর্ণ করে
তুলতে
পারে। ভালো সময়গুলো তাদের সঙ্গে উদ্যাপন করো৷
আর কঠিন সময়গুলোতে পরিবার
আর বন্ধুদের পরামর্শ নাও। নিজের
বিশ্বাসের ওপর আস্থা রাখো।আমি আজকের বক্তৃতার প্রথম দিকে
তোমাদের ধনী, সৌভাগ্যবান
প্রজন্ম বলে হালকা হেয় করলেও
একটা কথা কিন্তু এখনো বলিনি। তোমরা
পৃথিবীর ইতিহাসে এখন পর্যন্ত
সবচেয়ে
উদ্ভাবনী এবং প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ একটি প্রজন্ম। তোমাদের হাতের মুঠোয় এখন সমাজ বদলের
নানা অনুষঙ্গ। তোমাদের সামান্য চিন্তায় এখন বদলে যায় সমাজ। সামনে যে সুযোগ আসবে, সেটাই খপ করে ধরে ফেলবে। ক্যারিয়ারের শুরুতে যা করার সুযোগ পাবে
তা-ই করবে। সব নতুন অভিজ্ঞতা তোমার দক্ষতাকে বিকশিত করবে, দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেবে। যেকোনো কাজকে ভালোবাসো। কাজ উপভোগ করো। অভিজ্ঞতাই তোমার সাফল্যের গতি নির্ধারণ
করে দেবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে মনোযোগী হও। তোমাদের সবাইকে আমার অভিনন্দন। আমি তোমাদের প্রত্যেককে নিয়ে আজ
আনন্দিত ও গর্বিত। সবাইকে
ধন্যবাদ।
সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৯/১২/২০১৪
0 মন্তব্য:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।