সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: কালকের বাংলাদেশ সুন্দর হবেই

কালকের বাংলাদেশ সুন্দর হবেই


আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে? আমাদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও স্বপ্নের বিভিন্ন দিক নিয়ে বইপাঠে উ​দ্বুদ্ধকারী একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকার ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মুখোমুখি হলো নতুন প্রজন্ম
প্রশ্ন: শুরুতেই পলান সরকারের কাছে জানতে চাই, আপনি কী ভাবনা থেকে বই বিতরণ শুরু করেছিলেন?
পলান সরকার: এক কথায় কই, ‘পড়িলে বই আলোকিত হই, আর না পড়িলে বই অন্ধকারেই রইবই পড়া যত বেশি হবে, সবাই তত আলোকিত হবে, আনন্দিত হবেজীবন সুখী হবেআমি সবাইকে বই পড়তে দিয়েছি কারণ আমার মতে, পৃথিবীতে যত কাজ আছে তার মধ্যে সব থেকে মূল্যবান কাজ হলো জ্ঞানদানআর জ্ঞানের আধার হলো এই বইবই যে যত বেশি পড়বে, সে তত বেশি জ্ঞানবান হবে

কিন্তু আমার টাকাপয়সা ছিল না, বিদ্যা-বুদ্ধি ছিল নাশুরুতে এক লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করে নগদে, বাকিতে বই নিতামরাজশাহী অঞ্চলের ২০-২২টা গ্রামে হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমি বই পড়তে দিইআরেক দিন ফেরত আনিএভাবেই চলছে ৩০ বছরহাজার হাজার ছেলেমেয়েকে আমি বই পড়তে দিয়েছিআমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিতবই পড়ার প্রতি, পড়ালেখার প্রতি কারও আগ্রহ নেইতারপরেও কিছু লোক আসে, বইপত্র পড়েআর আমার আসল কাজ, পথে পথে বই বিতরণ চলছেই

প্রশ্ন: এবার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে আসিআপনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সব সময় বলেন, ‘আলোকিত মানুষ চাইএকজন আলোকিত মানুষের গুণাবলি কী কী? তাকে আমরা চিনব কীভাবে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তুমি কি এই পৃথিবীতে সুখ চাও না দুঃখ চাও? অবশ্যই সুখ চাওসব মানুষই তা চায়তাই যে তোমাকে সুখ দিতে পারবে, সে হলো আলোকিত মানুষবিপরীতভাবে যে তোমাকে দুঃখ দেয়, সে হলো অন্ধকারের মানুষতাই আমার মতে, যে সবাইকে একটা সুন্দর পৃথিবী দিতে পারবে, একটা সুখী আনন্দময় জীবন দিতে পারবে, সে হচ্ছে একজন প্রকৃত আলোকিত মানুষএখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মানুষের পক্ষে কি পুরোপুরি আলোকিত মানুষ হওয়া সম্ভব? আমার মনে হয় তা সম্ভব নয়কিছু পাপ, অপরাধ, নিষ্ঠুরতা এগুলো সবার মধ্যে থাকবেইতবে হ্যাঁ, আমাদের সবারই আলোকিত হওয়ার চেষ্টাটা থাকা চাইযে ব্যক্তি মন-প্রাণ, শক্তি দিয়ে ভালো মানুষ, সুন্দর মানুষ, আলোকিত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছে, সেই হলো আলোকিত মানুষ

প্রশ্ন: পরিচিতদের মধ্যে দেখি, বইপড়ুয়া বন্ধুদের সংখ্যা খুব কমকেন?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ১০ জনের মধ্যে যদি নয়জনও খেলাধুলা কিংবা এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তার পরেও মাথায় রাখবে যে একজন পাঠকও কমেনিবইপড়ুয়া মানুষের সংখ্যা সব দেশে সব সময়ই কম থাকে১০ জন মানুষের মধ্যে কেবল একজন মানুষ বই পড়তে পারে কারণ, বই পড়তে হলে চিন্তাশীল হতে হয়, মননশীল হতে হয়তাই বইপড়ুয়া মানুষেরাই পৃথিবী বদলাতে পারে

প্রশ্ন: এখনো দেশে অনেক অঞ্চল আছে, যেখানে বই পৌঁছায় নাসেখানকার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে না প্রত্যন্ত সেই সব অঞ্চলে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এখন পর্যন্ত সারা দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা ১৫ লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিকিন্তু বাংলাদেশে হয়তো পাঠক ৩৫ লাখ আছেআমরা এখনো তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনিসেই পৌঁছানোর কাজটাতে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে আসুক, এটাই আমার চাওয়াতোমার সাধ্য তুমি করো, আমার সাধ্য আমি করি, সকলের সাধ্য সকলে করুক, দেখো বাংলাদেশ পরিবর্তন হয়ে যাবেকথা দিয়ে হবে নাকাজ দিয়ে করে দেখাতে হবে

প্রশ্ন: পলান সরকার, আপনি কীভাবে লেখাপড়ায় আগ্রহী হলেন?
পলান সরকার: জন্মালেই মানুষ হয় নাশিক্ষাই মানুষকে মানুষ করেআমি নিজে কিন্তু কিছু নাপাঁচ মাস বয়সে বাবা মারা গিয়েছেনকলেজ-ভার্সিটি পড়তে পারিনিনিজে নিজে লেখাপড়া করেছিএক মাস্টার বিনা পয়সায় প্রাইমারি পড়িয়েছিলেন, তাও সেই স্কুলে ক্লাস ফাইভ ছিল নাচতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলামতাও ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনিপরীক্ষা দেওয়ার জন্য নাটোর যাওয়ার কথা ছিল, সেই নাটোরে যাওয়ার পয়সা দেওয়ার কেউ ছিল নাতাই যাওয়া হয়নি, পরীক্ষাও দেওয়া হয়নিআমার পড়াশোনা ওইটুকুইদুনিয়া আমার এভাবেই চলছেআজ যতটুকু আসতে পেরেছি, নিজের চেষ্টাতেই পেরেছি


প্রশ্ন: আমরা কিশোর-তরুণেরা সবাই কমবেশি স্বাপ্নিকআমাদের স্বপ্নপূরণের জন্য আমরা কী করতে পারি?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: স্বপ্ন তোমার, বাস্তবায়ন কাকে করতে হবে? অবশ্যই তোমাকেস্বপ্ন মানে আকাশে কিছু মেঘ উড়ে যাচ্ছে আর আমি তা দেখলাম, সেটাই আমার স্বপ্ন হয়ে গেল; এটা হতে পারে নাতুমি নিজে যে স্বপ্ন দেখো, সেই স্বপ্ন পূরণে তুমি কী কাজ করলে, সেই কাজটাই হলো আসল স্বপ্নআমরা মনে করি যে বসে বসে শুয়ে শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখলাম আর লাখ টাকা হয়ে গেল; সেটা স্বপ্ন হতে পারে না লাখ টাকা পাওয়ার জন্য তুমি যা করবে, সেটাই হলো তোমার স্বপ্ন

প্রশ্ন: আগামী দিনগুলোতে বইয়ের ভবিষ্যৎ কী? ছাপার অক্ষরে বই থাকবে, নাকি সবই ডিজিটাল হয়ে যাবে? তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পঠন-পাঠনের অবস্থা কেমন হতে পারে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: মানুষ যখন পাথরে লিখত তখন তা ছিল বই, তারপর মানুষ যখন গাছের ছালে, পাতায় কিংবা চামড়ায় লিখত তখন তা ছিল সেকালের বইএত দিন কাগজে লেখা হচ্ছেএখন আবার ডিজিটাল সিস্টেম শুরু হয়েছেকিন্তু আসল কথা, সেটা বই হলো কি না! ডিজিটালভাবে হলেও সেটা কি বই নয়? অবশ্যই সেটাও বইআমার ধারণা, পাঠ্যবই, তথ্যের বই, গবেষণার বইএই বইগুলো ডিজিটালভাবে এলে আমাদের সবারই সুবিধাআর কিছু বই আছে, যেগুলো স্বপ্ন দেখায়, যে বই ভাবায়, যে বই আমাকে বড় হওয়ার প্রেরণা দেয়, সাহিত্যের বই, আনন্দের বই, সৌন্দর্যের বই, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠেআমার মনে হয়, ওই ধরনের বইগুলো কাগজের বই হিসেবেই থেকে যাবেসামনের পৃথিবীতে কী হবে তা আমরা কেউই বলতে পারি নাতবে আমার মতে, দুই ধরনের বই-ই চলতে থাকবে

প্রশ্ন: আপনি যেসব গ্রামে বই বিতরণ করেন, সেখানে শুধু কি ছেলেরাই পড়ে, নাকি মেয়েরাও আছে?
পলান সরকার: ছেলে ও মেয়ে সবার কাছে আমি বই দিইশুরুর দিকে শুধু ছেলেরা ছিল, ছিল দু-একজন মেয়েএখন মেয়েরা অনেক পড়ছেমেয়েদের না হলে জাতির উন্নতি হয় না মেয়েদের কাজে লাগাতে হবেক্ষমতা দিতে হবেযত রকমের ক্ষমতা আছে, সব কাজেই তাদের লাগাতে হবে

প্রশ্ন: জীবন নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
পলান সরকার:জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন-নদে?’ এই জীবন নদীতে জোয়ার-ভাটা সবই আছেএসব থেকে বাঁচতে হলে দরকার জ্ঞানলেখাপড়াঅনেকেই এগুলো বিশ্বাস করে নানিজে কীভাবে ধনী হওয়া যাবে, আরেকজনকে কীভাবে জব্দ করা যাবে, তা নিয়েই ব্যস্ত থাকেএই প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই দেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছেমারামারি কাটাকাটিতে দেশ অস্থির হয়ে গেছেকে কার থেকে বড় হবে, ওপরে উঠবে তা নিয়েই ব্যস্ত ঠেলাঠেলি-মারামারি করে এরা অস্থিরআমি রাজনীতি বুঝি নাকিন্তু এরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেতমারামারি করে কোনো সমাধান আসবে নামিলিতভাবে কাজ করলে, আলোচনা করলে সমাধান আসবেসে জন্য দরকার ভালো মানুষ


প্রশ্ন: তাহলে ভালো মানুষ তৈরিতে আপনার পরামর্শ কী?
পলান সরকার: ভালো মানুষ চিনতে হলে নিজেকেও ভালো মানুষ হতে হবেসব দিক বিচার-বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবেনিজে ভালো মানুষ হওআরেকজন ভালো মানুষকে চিনতে পারবেসবাইকে চেষ্টা করতে হবেবসে থাকলে কিছু হবে নানিজের চেষ্টার কারণেই সবকিছু হবেযে চেষ্টা করবে, সেই বড় হতে পারবেআর কাজ করতে হবে ভালো ভালো কথা অনেকেই বলে কিন্তু কাজ কেউ করে নাকথায় আছে, ‘মনে বলে হেন কর্ম না করিব আরমনে সবাই বলে যে কেউ খারাপ কাজ করবে নাকিন্তু স্বভাবে পরিবর্তন না হলে সে কাজ সবাই করতেই থাকবেমনে মনে বলে কিছু হবে না স্বভাবের পরিবর্তন করতে হবে

প্রশ্ন: ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে? ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে আপনার আশা কী?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনো আছে, যাদের কাছে যদি আমরা সুযোগ-সুবিধাগুলো ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে সেই ঘুমন্ত মানুষ, শুয়ে থাকা মানুষগুলো জেগে উঠবেতোমরা জানো যে চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকেআবার সরবরাহ থাকলে চাহিদা তৈরি হয়এখন আমরা যদি সরবরাহটা দিতে পারি সারা দেশে, তাহলে সারা দেশের মানুষের মধ্যে নিদেনপক্ষে আলোকিত হওয়ার চেষ্টাটা জেগে উঠবেসেই কাজটায় নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসবে, এটাই আমার আশা

প্রশ্ন: ধরা যাক, আজ থেকে ২০ বছর পর বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ২০ বছর পর বিত্তবৈভবের দিক থেকে বাংলাদেশ যথেষ্ট সম্পদশালী হবে, এটা আমি বলতে পারিদুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখন অসৎনৈতিকতার দিক থেকে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছিক্ষমতার লোভে দেশে সুশাসন ধ্বংস হয়ে গেছেআমাদের সংবিধানে ৭০ ধারা থাকার কারণে দুইটা স্বৈরতন্ত্র তৈরি হয়েছে, যারা একে অপরকে শেষ করে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছেএই সংঘাত করতে গিয়ে দুই দল জনগণের বদলে নির্ভর করছে সন্ত্রাসীদের ওপরে, খুনিদের ওপরে, লাঠিয়াল বাহিনীর ওপরেএর ফলে রাষ্ট্রের সব ন্যায়নীতি নষ্ট হয়ে গেছে৷

প্রশ্ন: এই অবস্থা কবে বদলাবে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বদলটা রাতারাতি হবে নাহবে ক্রমাগতভাবেরাজনীতি এখন একমুখী হয়ে গেছে রাজনীতি নিজেও সংঘাতে সংঘাতে একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবেশক্তিহীন হয়ে যাবেআর ধীরে ধীরে দেখবে সাধারণ জনগণের মধ্য থেকেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নায়কেরা-নায়িকারা উঠে আসবেআমি মনে করি, আমরা একটা জাতি যখন একই ভাষায় কথা বলি, একই সংস্কৃতির মানুষ, তখন একসময় না একসময় এই সমস্যার সমাধান হবেইআমার মতে, তোমরা তোমাদের জীবদ্দশায় তা দেখে যাবেযদি তুমি সেই নায়ক হওআর যদি তুমি বসে থাক যে কখন কোন নায়ক উঠে আসবে, তাহলে তো আর হবে নানিজেকে আগাতে হবেঅন্যের দিকে তাকিয়ে থাকার লোকের সারিতে নিজেকে রাখলে হবে না। শুধু একটা কথা মাথায় রেখো, তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হলে তুমি একাই যথেষ্টতোমরা উঠে দাঁড়াওদেখো বাংলাদেশ একদিন বদলাবেই



 সূত্রঃ প্রথম আলো, ০১/০১/২০১৫ খ্রিঃ। 

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।