সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: যেভাবে খুন ইন্দিরা গান্ধী

যেভাবে খুন ইন্দিরা গান্ধী


ইন্দিরা গান্ধী। ছিলেন ভারতের দুই মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী। তিনি খুন হন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। সকাল ৯টা ২০ মিনিটে। এ সময় তিনি ছিলেন তার নয়াদিল্লির সফদর জং রোডের বাসভবনে। তাকে গুলি করে হত্যা করে তার দুজন শিখ দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং। এর কয় মাস আগে জুনের প্রথম দিকে ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে পাঞ্জাবের অমৃতসরে শিখদের স্বর্ণমন্দিরে পরিচালিত হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন ব্লু স্টার নামে সামরিক অভিযান। এ অভিযানে স্বর্ণমন্দিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলে। বলা হয়ে থাকে, সে অভিযান ইন্দিরা সরকারের প্রতি শিখসমাজকে ব্যাপকভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। অনুমান করা হয়, সে সূত্রেই সৃষ্ট ক্ষোভের জের হিসেবেই ইন্দিরা গান্ধী খুন তার দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে।

ইন্দিরা গান্ধীর পুরো নাম : ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী নেহরু। জন্ম ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর। খুন হন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর। ছিলেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্ব। তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত। আবার প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৮০ সালে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত। তিনিই ভারতের একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং দ্বিতীয় দীর্ঘতম সময়ের প্রধানমন্ত্রী।

তিনি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর একমাত্র সন্তান। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সময়ে তিনি তার বাবার অতিমাত্রিক কেন্দ্রীভূত প্রশাসনের চিফ অব স্টাফ হিসেবে। তখন তিনি অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব খাটাতেন। ১৯৫৯ সালে নির্বাচিত হন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। তাকে তার বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রস্তাব দেয়া হয়। ইন্দিরা গান্ধী তা গ্রহণে অস্বীকার করে বরং ক্যাবিনেট মিনিস্টার হওয়াটাকে বেছে নেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালে লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর উত্তরাধিকারী হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী পরিচিত হয়ে ওঠেন তার অভাবনীয়ভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করায় কঠোর মনোভাবের জন্য। তিনি পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। এ যুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এর ফলে উপমহাদেশে ও ভারতে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে যায়।

হত্যাকাণ্ড
ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনভকে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য যাওয়ার পথে সকাল ৯টা ২০ মিনিটের সময় তিনি খুন হন। এই ব্রিটিশ অভিনেতা আইরিশ টেলিভিশনের জন্য একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করছিলেন। ১ নম্বর আকবর রোডের অফিসের কাছের ১ নম্বর সফদর জং রোডের বাসভবনের বাগানের একটি পথ দিয়ে তখন হাঁটছিলেন। তিনি যখন সতওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিংহের প্রহরাধীনে উইকেট গেট (বিশেষ কোনো বড় দরজার পাশে বা ভেতরে থাকা ছোট দরজা) দিয়ে বের হচ্ছিলেন, তখন এরা তার ওপর গুলি ছোড়ে। সাব-ইনস্পেক্টর বেয়ান্ত সিং তার সাইড আর্ম থেকে তিনটি গুলি ছোড়েন তার তলপেটে। এরপর তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সতওয়ান্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়েন। গুলি করার পর উভয়ই তাদের অস্ত্র হাত থেকে ছুড়ে ফেলেন। তখন বেয়ন্ত সিং বলেন, যা করার ছিল, আমি তা করে ফেলেছি, তুমি যা করতে চাও করো। পরবর্তী ৬ মিনিটের মধ্যে ইন্ডো-তিব্বতান বর্ডার পুলিশের রমেশ সিং জামওয়াল ও রাম শরণ বেয়ান্ত সিংকে ধরে একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে হত্যা করে। কারণ অভিযোগে প্রকাশ বেয়ান্ত সিং এ কক্ষের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। 

অপর দিকে গান্ধীর অন্যান্য দেহরক্ষী সতওয়ান্ত সিংকে গ্রেফতার করে। তার সাথের পালাতে যাওয়া একজনও গ্রেফতার হন। বেয়ান্ত সিংয়ের হামলার সময় তিনি মারাত্মক আহত হন। বেয়ান্ত সিংকে তার সঙ্গী কেহার সিংসহ ১৯৮৯ সালে ফাঁসি দেয়া হয় দিল্লির তেহার জেলে। অভিযোগ আছে, ইন্দিরা গান্ধীর সেক্রেটারি আর কে দেওয়ানকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল ইন্দিরার পাহারা থেকে শিখ সদস্যদের সরিয়ে দিতে। আর কে দেওয়ান তা উপেক্ষা করেন। উল্লেখ্য, বেয়ান্ত সিং ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর খুবই প্রিয় দেহরক্ষী। তাকে তিনি চিনতেন ১০ বছর ধরে। ঘটনার সময় অন্য খুনি সতওয়ান্ত সিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২১ বছর। ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস আগে তাকে ইন্দিরার প্রহরী নিয়োগ করা হয়।

দূরদর্শনের অ্যাংকর টেলিভিশন সাংবাদিক সালমা সুলতানা ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দূরদর্শনের সন্ধ্যার খবরে ইন্দিরা হত্যার খবর প্রচার করেন। এ খবর প্রচারিত হয় তাকে গুলি করার ১০ ঘণ্টা পর। সকাল সাড়ে ৯টায় তাকে নেয়া হয় অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে। সেখানে তার ওপর অপারেশন চালানো হয়। বেলা ২টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এরপর চলে ময়নাতদন্ত। ময়নাতদন্ত দলের নেতৃত্ব দেন ডা: টি ডি ডোগরা। তিনি বলেন, কমপক্ষে ৩০টি বুলেট বিদ্ধ হয় ইন্দিরার শরীরে। বুলেট ছোড়া হয় স্টেনগান ও পিস্তল থেকে। খুনিরা ৩১টি বুলেট ছুড়লেও একটি তার গায়ে লাগেনি। গায়ে লাগা ৩০টি গুলির মধ্যে ২৩টি গুলি শরীরের এক পাশে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ৭টি গুলি দেহের ভেতরেই থেকে যায়। ডা: ডোগরা ইন্দিরার দেহ থেকে বের করে আনা বুলেটগুলোর ব্যালিস্টিক এক্সামিনেশনের মাধ্যমে নির্ণয় করেন এগুলো কী ধরনের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছে। এই বুলেটগুলো সিএফসিএল দিল্লির সংশ্লিষ্ট অস্ত্রের সাথে মিলে যায়। পরবর্তী সময়ে ডা: ডোগরা একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে হাজির হন শ্রী মহেশ চন্দ্রের আদালতে। আদালত কয়েকটি অধিবেশনে তার সাক্ষ্য নেয়। তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের উকিল শ্রী পি এন লেখি।

১ নভেম্বর তার মৃতদেহ একটি গানবহরে করে দিল্লির রাস্তা দিয়ে নিয়ে রাখা হয় তিন মূর্তি ভবনে। মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিসৌধ রাজঘাটের কাছের শক্তিস্থল নামে এক স্থানে তার শেষকৃত্য হয় ৩ নভেম্বর। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টেলিভিশন ও বিবিসিসহ রেডিওতে। তাকে দাহ করার পর শুরু হয় শিখবিরোধী দাঙ্গা। এতে প্রায় তিন হাজার শিখ প্রাণ হারায়। বাস্তুচ্যুত হয় আরো কয়েক লাখ শিখ। ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজিব গান্ধী সরাসরি টেলিভিশনে প্রচারিত এক অনষ্ঠানে বলেন, যখন বড় গাছ পড়ে তখন মাটি কাঁপে।

মৃত্যুর পর শিখবিরোধী দাঙ্গা
১৯৮৪ সালে শিখবিরোধী দাঙ্গা চলায় শিখবিরোধী ভারতীয় জনতা। শিখ ধর্মাবলম্বী দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ দাঙ্গা বাধে। এক হিসেবে এ দাঙ্গায় আট হাজারের মতো লোক নিহত হয়। শুধু দিল্লিতেই নিহত হয় তিন হাজার। দাঙ্গা চলে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। দফায় দফায় চলে এ দাঙ্গা। ভারতের মূল গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইর অভিমত (সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো) দিল্লি পুলিশের সহায়তায় এই রায়ট চলে। কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু কমকর্তাও এ কাজে সহায়তা জোগায়। মায়ের মৃত্যুর পর রাজিব গান্ধী হন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তিনি বলেছিলেন বড় গাছ যখন পড়ে, তখন মাটি কাঁপে।

১৯৭০-এর দশকে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন। তখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার শিখকে আটক করে কারাগারে রাখা হয়। তখন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র শিখেরা মাঝে মধ্যেই সন্ত্রাসী হামলা চালাত। ভারতীয় সরকারের কাছে এরা ছিল সন্ত্রাসী। ১৯৮৪ সালে জুনে ইন্দিরা গান্ধী আদেশ দেন শিখদের স্বর্ণমন্দিরে সামরিক অভিযান চালিয়ে এই মন্দিরকে বিচ্ছিন্নতাবাদীমুক্ত করতে। কারণ বলা হচ্ছিল, এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শিখেরা স্বর্ণমন্দিরে অস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলছে। এই সামরিক অভিযানের নাম অপারেশন ব্লু স্টার। পরবর্তী সময়ে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী নামানো হয় পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতাবাদমুক্ত করতে।

এ দ্বন্দ্বে সরকারি রিপোর্ট মতে, দুই হাজার ৭০০ জন নিহত হয়। রায়টের পর ভারত সরকার বলে এ রায়টে দিল্লি থেকে ২০ হাজার লোক বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। তবে পিপলস ইউনিয়ন ফর লিবারটিজের রিপোর্ট মতে, এ সংখ্যা কমপক্ষে এক হাজার জন বাস্ত্চু্যুত হয়। উল্লেখ্য, এই পিপলস ইউনিয়ন একটি মানবাধিকার সংস্থা। এটি সমাজবাদী নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ১৯৭৬ সালে পিপলস ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটিক রাইটস (পিইউসিএলডিআর) নামে প্রতিষ্ঠা করেন। সে যা-ই হোক এ রায়টের সবচেয়ে বেশি শিকার হয় দিল্লির শিখ অধ্যুষিত এলাকা। সারা ভারতের মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও পত্রপত্রিকার বিশ্বাস এই হত্যাযজ্ঞ ছিল সংগঠিত। এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের দ্বান্দ্বিক অবস্থান এবং কিলারের বিচারিক শাস্তি দেয়ার ব্যাপারে সাধারণ শিখদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয়। বেড়ে যায় খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন। আকালি তখত নামের শিখবাদের ধর্মীয় গভর্নিং বডি এই হত্যাকাণ্ডকে জেনোসাইড বা গণহত্যা বলে মনে করে।
  
২০১১ সালে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারত সরকারকে জানায়, এখনো এই মাস কিলিং-এর বিচার হয়নি। ২০১১ সালে উইকিলিকস ক্যাবল লিকস জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস পরিচালিত সরকার এই দুষ্কর্মে সহযোগিতা জুগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ কাজকে অভিহিত করে ভারত সরকারের শিখবিরোধী অপরচুনিজম হ্যাট্রিড নামে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এ রায়টকে গণহত্যা বলতে অস্বীকার করে। তবে যুক্তরাষ্ট্র বলে এটি ছিল ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। এ ছাড়া ২০১১ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদনে বলে, ভারতের হরিয়ানায় ব্যাপক শিখবিরোধী হামলার ঘটনা ঘটে বড় ধরনের প্রতিশোধপরায়ণতার অংশ হিসেবে।


প্রেক্ষাপট
১৯৭৩ সালে শিকদের রাজনৈতিক দল শিরোমনি আকালি দল ও অন্যান্য শিখ গ্রুপ ঘোষণা করে আনন্দপুর সাহিব রেজুলেশন নামের বিবৃতি। এতে অন্যান্য দাবিদাওয়ার মধ্যে পাঞ্জাব ও শিখদের জন্য বিশেষ মর্যাদা দাবি করা হয়। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে পাঞ্জাবের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে রাজ্যপর্যায়ে। এর ফলে রাজ্য সরকারকে বাতিল করা হয়। জার্নাল সিং বিন্দ্রাওয়ালের নেতৃত্বে পাঞ্জাবে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। কিছু বিদ্রোহী শিখ গোষ্ঠী সিদ্ধান্ত নেয় সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাঞ্জাবে খালিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। তারা লড়বে ভারত সরকার ও ভরতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। অন্যরা চাইল আনন্দপুর সাহিব রেজুলেশনের ওপর ভিত্তি করে ভারতের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত পাঞ্জাব। বিপুলসংখ্যক শিখ সশস্ত্র আন্দোলনের নিন্দা জানায়। 
১৯৮৩ সালে পাঞ্জাবের অবস্থা খুবই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সে বছরের অক্টোবরে কিছু শিখ বিদ্রোহী একটি বাস থামিয়ে বাসের ছয়জন হিন্দু যাত্রীকে হত্যা করে। একই দিনে অন্য একটি চরমপন্থী গোষ্ঠী একটি ট্রেনে দুইজন কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এ প্রেক্ষাপটে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকার পাঞ্জাবে কংগ্রেসের রাজ্য সরকার বাতিল করে সেখানে প্রেসিডেন্টের শাসন চালু করেন। অপারেশন ব্লু স্টার চলে ১৯৮৪ সালের ৩ জুন থেকে ৮ জুন পর্যন্ত। এর আগের চার মাস সময়ে গোটা পাঞ্জাবে বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনায় ২৯৮ জন লোক নিহত হয়। ব্লু স্টার অপারেশনের পাঁচ দিনে নিহত হয় ৪৮ জন। তখন সশস্ত্র শিখদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর জন্য বিভিন্ন মহল থেকে আহ্বান জানানো হয়। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অপারেশন পরিচালনার আদেশ দেন। আর স্বর্ণমন্দির থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সরিয়ে দেয়ার আদেশ দেন জুনের প্রথম দিকে। বিদ্রোহীদের সরিয়ে দিয়ে পাঞ্জাবের অমৃতসর শহরের হরমন্দির সাহিব কমপ্লেক্সের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং মন্দির কমপ্লেক্স ভবন থেকে জার্নেইল সিং বিন্দ্রাওয়ালে ও তার অনুসারীদের সরিয়ে দেয়ার আদেশও দেয়া হয়। বিন্দ্রাওয়ালে আগেই অবস্থান নিয়েছিলেন হরমন্দির সাহিবে এবং ১৯৮০ সালের এপ্রিল থেকে এটিকে ব্যবহার করে আসছিলেন তার সদর দফতর হিসেবে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি গুরুদুয়ারায় অস্ত্র মজুদ করে আসছিলেন পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের সশস্ত্র অভিযান পরিচালনার জন্য।

সেনাবাহিনীর সূত্র মতে, এ অভিযানে বেসামরিক লোক মারা গেছে ৪৯২ জন। আর সামরিক বাহিনীর লোক মারা গেছে ১৩৬ জন, আহত হয়েছেন ২২০ জন। বেসরকারি সূত্র মতে, লোকক্ষয় ঘটেছে আরো অনেক বেশি। কারো কারো মতে, নিহতের সংখ্যা ২০ হাজারের মতো। মার্ক টালি ও সতীশ জ্যাকব উল্লেখ করেছেন, যেসব বেসামরিক শিখ মার্চ করে অমৃতসরের দিকে যাচ্ছিল, তাদের ওপর দিয়ে সুলতানউইন্ড এলাকায় সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক চালিয়ে দিয়েছিল। হত্যার শিকার হয়েছিলেন বিন্দ্রাওয়ালে ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল সাবেগ সিং। এই অপারেশন মন্দির কমপ্লেক্সের কাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। আকাল তখত মন্দির সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। এর প্রতিবাদ আসে সারা ভারত থেকে। এমনকি ভারতের বাইরে থেকেও। এর প্রতিশোধের পথ ধরেই ঘটে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড। তার শিখ প্রহরীর হাতে তিনি পাণ হারান। আর হত্যাকাণ্ডের ফলে চলে শিখবিরোধী রায়ট।

কেমন ছিল এ রায়ট
ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন ৩১ অক্টোবর। রায়ট শুরু হয় ১ নভেম্বর থেকে। কিছু কিছু এলাকায় তা চলে কয়েক দিন ধরে। রায়টে দিল্লিতে মারা যায় তিন হাজার শিখ, আর সারা দেশের আরো ৪০টি শহরে মারা যায় আরো আট হাজার। সুলতানপুরি, মঙ্গলপুরি, ত্রিলকপুরি ও দিল্লিই ছিল সবচেয়ে বেশি হারে দাঙ্গার শিকার। জনতা রড, ছোরা ও কেরোসিনসহ আরো দাহ্য পদার্থ নিয়ে শিখ অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালায়। তারা যে শিখদেরই সামনে পেয়েছে নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে হত্যা করেছে। শিখদের বাড়িঘর ও দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়, আগুন ধরিয়ে দেয়া দেয়। জনতা বাস-ট্রেন থামিয়ে শিখদের টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে হয় কুপিয়ে মেরেছে, নয়তো কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। অনেককে বাড়িঘর থেকে বের করে এনে হত্যা করা হয়েছে। শিখ নারীরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

এ ধরনের দাঙ্গা পুলিশের সহায়তা ছাড়া ঘটতে পারে না। দিল্লি পুলিশের সর্বোচ্চ দায়িত্ব ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে নির্দোষ-নিরপরাধ শিখদের রক্ষা করা। এর বদলে পুলিশ পূর্ণ সহায়তা করেছে দাঙ্গাবাজদের। এসব দাঙ্গাবাজেরা কাজ করছিল নীতিবোধ বিবর্জিত নেতা জগদীশ টিটলার ও এইচ কে এল ভগবতের নেতৃত্বে। এটা সবার জানা, অনেক জেল, সাবজেল ও লকআপ তিন দিন পর্যন্ত খুলে দিয়ে বন্দীদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে টিচ দ্য শিখ অ্যা লেসন। তবে এটাও বলা ঠিক হবে না, দিল্লি পুলিশ কিছুই করেনি। যেখানে শিখেরা তাদের নিজেদের বাঁচাতে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সেখানে পুলিশ শিখদের বিরুদ্ধে কড়া অ্যাকশন নিয়েছিল। যেসব শিখ নিজেদের জানমাল বাঁচাতে গুলি করেছিল, তাদের দাঙ্গার পর বহু দিন কারাগারে কাটানোর ব্যবস্থাটি করে দিয়েছিল দিল্লি পুলিশ।

সূত্রঃ অন্যদিগন্ত, Nov 06, 2014 06:34 am

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।