সম্মানিত দর্শক আপনাকে স্বাগতম। আমাকে Facebook instagram Telegram এ পাবেন। কামরুলকক্স: Great Ocean Road-Australia

Great Ocean Road-Australia

 
পাহাড়ের পাদদেশে সাগর ঘেঁষে আঁকাবাঁকা গ্রেট ওশান রোড
Great Ocean Road-Australia

সাগরের পাশ দিয়ে পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ একটি রাস্তার নাম অস্ট্রেলিয়ার টুয়েলভ অ্যাপোস্টলসগ্রেট ওশান ড্রাইভএটি ভিক্টোরিয়া অঙ্গরাজ্যে এবং অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় ঐতিহ্যখ্যাত একটি স্থাপনাএর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪৭ কিলোমিটাররাস্তাটি অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব সমুদ্র উপকূল ধরে ভিক্টোরিয়ার টোরকে থেকে ওয়ার্নাম্বুল পর্যন্ত বিস্তৃত। সাগরের বিশালতা আর অসীম নীল জলরাশির গভীরতা ছুঁয়ে যায় প্রতিটি মানুষের মনের আঙিনাকেসঙ্গে ঘন সবুজের সমারোহ, পাহাড় যদি সাগরের তীর ঘেঁষে প্রেমের আশ্রয় চায় তাহলে তো কথাই নেই! প্রকৃতির এই নৈসর্গিক প্রেম, পাগল করা মন মাতানো রূপের গভীরে আমি হারাই প্রতিবার, প্রতিমুহূর্ত, সে এক অন্য প্রহর! অনিন্দ্যসুন্দর আর নির্জনতা এত বেশি মোহাচ্ছন্ন করে তোলে আমাকে, অবচেতন মনেই গেয়ে উঠি রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে কী হবে, তোমার কাছে কেউ না এলে আর মনের ওই এত মধু কেন জমেছে, যদি কেউ না থাকে নেবার

আকাশছোঁয়া স্বচ্ছ অথৈ নীল জলের দেয়াল আর আকাশের বুকে শুভ্র মেঘের লুকোচুরি, সব মিলিয়েই অদ্ভুত নৈসর্গিক সৌন্দর্যআমার অসম্ভব পছন্দ সবুজ বন, স্বচ্ছ নীল সমুদ্র আর পাহাড়ের সুউচ্চ হাতছানি প্রকৃতির নির্জনতা ও নিভৃতে সুযোগ পেলেই ছুটে যাই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতেসাগরের তীর ঘেঁষে মহাসড়ক ধরে ভ্রমণ সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চকর কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ওশান ড্রাইভে ভ্রমণ সত্যি অন্য রকম অনুভূতি দুই পাশে সৌন্দর্যদেবীর অকৃপণ নৈসর্গিক রূপ আর ইতিহাসের নানা রসদ এই ভ্রমণ নিঃসন্দেহে যেকোনো পর্যটকের ভ্রমণতৃষ্ণা মেটাবে
টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস
টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস
গ্রেট ওশান রোড নামেই পরিচিত মহাসাগর-সংলগ্ন মহাসড়কখুব ভোরে মেলবোর্ন থেকে রওনা দিলাম আমরামেয়ে অথৈ, ছেলে দীপ্র আর আমার স্বামী শাখাওয়াত হোসেন ও আমি বরাবরই মেলবোর্নের আবহাওয়া প্রকৃতির খেয়ালে বিচিত্র দিনে তিন-চারবার রং বদলায়অনেকটা প্রেমিক যুগলের খুনসুটির মতোই মান-অভিমানের এমন লুকোচুরি খেলায় এখানকার আবহাওয়া কখনো শীত, কখনো গরম, কখনো গোমড়ামুখে প্রথম অভিমান, তারপর অঝোর ধারায় কান্নার জল, কখনোবা রোদমাখা ঝলমলে দিন, লিলুয়া বাতাস পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের কাছে আগেই শুনেছিলাম এর মনোমুগ্ধকর রূপের গল্পএবার নিজের চোখে দেখে রীতিমতো পাগল হয়ে উঠেছিএমন সুন্দর দিনটি আমার জন্যও বিশেষ স্মরণীয় হয়ে থাকবে আরও একটি বিশেষ কারণেতা হলোসেদিনই প্রথম আমি লংড্রাইভ করেছি, তাও আবার মহাসাগরের তীর ঘেঁষে, প্রায় ২৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়ক ধরে। আমার সেদিনের অনুভূতি লিখে বা বলে প্রকাশ করা যাবে না, অন্য রকম একটি দিন ছিল সেটামেলবোর্ন থেকে ঘণ্টা দেড় ড্রাইভ করলেই জিলং নামে একটি জায়গা পড়ে ওয়াটারফ্রন্ট নামে খুব সুন্দর একটি জায়গার জন্যই মূলত পর্যটকদের কাছে এটি অনেক জনপ্রিয়একচিলতে বিচে ছোট ছোট ইয়ট, সাজানো-গোছানো পার্ক আর সর্পিল আঁকাবাঁকা পথ (পাথওয়ে) আমার স্মৃতিতে আমার প্রিয় জন্মভূমির অপূর্ব সুন্দর মেঠোপথের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছিল
টুয়েলভ অ্যাপোস্টলসে টম ও ইভা নামের শিলাখণ্ড
টুয়েলভ অ্যাপোস্টলসে টম ও ইভা নামের শিলাখণ্ড
গ্রেট ওশান রোড কোনো সাধারণ সড়ক নয়ভিক্টোরিয়া প্রদেশের দক্ষিণ মহাসাগরের তীর ঘেঁষে টোরকে থেকে ওয়ার্নাম্বুল পর্যন্ত প্রসারিত অনিন্দ্যসুন্দর এই মহাসড়ক১৮৮০ সালে এটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হলেও সার্ভের কাজ শুরু হয় ১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফিরে আসা সেনাদের দিয়েই শুরু হয় এর নির্মাণকাজ ঘন বন-জঙ্গল আর পাথুরে পাহাড় গ্রেনেড দিয়ে ভেঙে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেন সেনাশ্রমিকেরাইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সারা দিনে তাঁরা আট ঘণ্টা হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে একেকজন পেতেন ১০ শিলিং আর সিক্স পেন্স তাম্রমুদ্রা হাড়ভাঙা পরিশ্রম হলেও বিনোদনের খোরাক ছিল পর্যাপ্তগানবাজনার বাদ্যযন্ত্র, পিয়ানো, গ্রামোফোন, খেলাধুলা আর ক্যাসিনো সেনাসদস্যদের আনন্দ-বেদনামিশ্রিত বহু স্তরের নির্মাণকাজ শেষ করে ১৯৩২ সালের ২৬ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া শহীদ সৈনিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানোর প্রয়াসে এই মহাসড়কটি নির্মিত হয়। গ্রেট ওশান রোডের বিখ্যাত ও আকর্ষণীয় স্থান টুয়েলভ অ্যাপোস্টলসমাঝখানে অ্যাঞ্জেল বিচ, লরেন বিচের সাগরের সুনীল জলরাশি আর পরিকল্পিত বালুকাময় সমুদ্রসৈকত এই পর্যটন নগরকে দিয়েছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
উত্তাল সাগরের নোনাজল যখন আছড়ে পড়ে তখন ঝিরিঝিরি বাতাসে তৈরি হয় সফেদ ফেনাতা রৌদ্রময় আলোর ঝলকানিতে মুক্তোর দানার মতোই চিকচিক করেএ এক মাতাল করা দৃশ্য! এ দৃশ্য দেখে আনমনেই গেয়ে উঠলাম বেঁধেছি মনশয্যা বালির বিছানায় প্রতিটি সৈকতের পাদদেশেই গড়ে উঠেছে অত্যাধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিপণি, আন্তর্জাতিকমানের খাবার-দাবারের রেস্তোরাঁঅ্যাপোলো বে থেকে পোর্টক্যাম্বল যাওয়ার পথে গ্রেট ওটওয়ে ন্যাশনাল পার্কউঁচু-নিচু পাহাড়ে কোথাও ঢালু, কোথাও ঊর্ধ্ব সরু আঁকাবাঁকা পথ, গহিন জঙ্গল, সুনসান নীরব চারপাশমানুষজন বা বাড়িঘর নেইগা ছমছম করা নীরবতা চারদিকেমনে হয় স্তব্ধ প্রকৃতি। এভাবেই মনে অজানা শিহরিত মুগ্ধ নয়নে শেষ বিকেলে লালচে চকচকে সোনালি আলোর আভায় দেখা পেলাম টুয়েলভ অ্যাপোস্টলসএটি আসলে মূলত কতগুলো ক্ষয়ে যাওয়া পাললিক শিলা স্তম্ভের সমষ্টিযদিও ১২টি পাললিক শিলা স্তম্ভের সমষ্টি আমি মেলাতে পারিনি
Great Ocean Road as viewed from Teddy's Lookout, south of Lorne
পোর্টক্যাম্বলে এর অবস্থান হলেও এটি প্রিন্স টাউন থেকে পিটারবার্গ পর্যন্ত বিস্তৃতখারাপ আবহাওয়া আর দক্ষিণ মহাসাগরের উত্তাল ঢেউয়ের দাপটে এখানকার পাললিক শিলার পাহাড়গুলোর পাদদেশ ক্রমশ ক্ষয়ে ক্ষয়ে আজকের এই রূপ ধারণ করে আছেকিছু কিছু খাড়া পাহাড় খণ্ড সাগরের বুকে একাকী ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছেএমন দৃষ্টিসুখকর দৃশ্য নিমেষেই দূর করে দিল সারা দিনের ক্লান্তি টম আর ইভা নামে দুটি শিলাখণ্ড আছেযে কারোর কাব্যিক শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো আবিষ্কার করবে প্রেমের দুয়ারে আলিঙ্গনরত শিলাখণ্ডসাগরের বুকেই টমের সলিলসমাধি হয়েছে, তবে তা প্রেমের জন্য নয়বছর কয়েক পরে টম যখন পুরোদস্তুর নাবিক, তখন এক দুর্ঘটনায় সাগরের বুকেই চিরদিনের জন্য হারিয়ে যান তিনি টুয়েলভ অ্যাপোস্টলস থেকে কিছু দূরে পশ্চিমে অবস্থিত আরেকটি সেরা আকর্ষণীয় বিনোদন স্পট লক আরড জর্জ১৮৭৮ সালে লক আরড নামে একটি জাহাজ মেলবোর্নে পাড়ি জমিয়েছিল ইংল্যান্ড থেকেসৈকতের কাছাকাছি এসে দুর্ঘটনায় পড়ে ৫৫ জন যাত্রীর মধ্যে মাত্র দুজন বেঁচে যায়তাদের একজন ১৫ বছরের টম, যে পেশায় ছিল নবিশ নাবিকআর অপরজন ১৭ বছরের আইরিশ তরুণী ইভা কারমাইকেল, যে পরিবারের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল টম আর ইভার জন্য বিষণ্নতা ছেয়ে গেল মনের গভীরেঅন্যদিকে সাগরের বুকে অস্তমিত সূর্যের ম্রিয়মাণ আলোর রূপও আমাদের মনে সাক্ষী হয়ে রইলঅনেক কিছু হারানোর পরও আমরা সৌন্দর্যদেবী সাগরের বুকে অজানা মোহে অপার বিশ্বাসে স্বপ্ন বুনে যাই রঙিন সুতোয়!


হ্যাপি রহমান
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া

সূত্রঃ প্রথম আলো, ১৯:৪৫, নভেম্বর ২৩, ২০১৪

0 মন্তব্য:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Comments করার জন্য Gmail এ Sign in করতে হবে।